রাজধানীর নয়াপল্টন বুধবার দুপুরের পর থেকে যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে চলা সংঘর্ষ ও পুলিশের অভিযানে একজন নিহত ও অন্তত ১৮ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ ডিসেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে আমান উল্লাহ আমান ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। দিন শেষে পুলিশ জানায়, অন্তত ৩০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে রাত ৯টার দিকে কার্যালয় এলাকায় গিয়ে সুনসান নীরবতা দেখা যায়। কার্যালয়টি যেন পরিণত হয়েছে ভূতের বাড়িতে। কার্যালয়ের ভেতরে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আসবাবপত্র। ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছে কিছু কক্ষের দরজা। এছাড়া অসংখ্য পানির বোতল, পেঁয়াজ, রসুনও পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
বুধবার রাত ৯টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পান গণমাধ্যমকর্মীরা। কলাপসেবল গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে মোবাইলের আলো ব্যবহার করতে হয়েছে।
নিচতলায় প্রবেশমুখেই জিয়াউর রহমানের একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যেটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে তা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
নিচতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে চোখে-নাকে অনুভূত হয় টিয়ারশেলের ঝাঁজ। ছয়তলা ভবনটি ছিল জনমানবশূন্য।
দ্বিতীয় তলায় আছে মহিলা দলের কার্যালয়। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। একটি কক্ষে স্তূপ করে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায় অসংখ্য পানির বোতল।
তৃতীয় তলায় জেনারেল সেক্রেটারির কক্ষ। সেটির দরজাও ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
চতুর্থ তলার ছাত্রদল, যুবদল ও কৃষকদলের কার্যালয়ে আসবাবপত্র এলোমেলা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মেঝেতে কিছু কাপড়ের পোড়া অংশ পাওয়া গেছে।
ধারণা করা হয়, টিয়ার শেলের ঝাঁজ থেকে মুক্তি পেতে কাপড় পোড়ানো হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি কক্ষের টেবিলে ছড়িয়ে ছিল কাগজপত্র।
পঞ্চম তলায় জাসাসের কার্যালয় এবং ষষ্ঠ তলায় জিয়া স্মৃতি পাঠাগার। অন্যান্য তলার মতো এই দুই তলাতেও আসববাবপত্র ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
কার্যালয় বা সড়কে বিএনপির কাউকে দেখা না গেলেও নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। রয়েছে রায়ট কার ও ব্যারিকেড। থমথমে পরিস্থিতি রিরাজ করছে পুরো নয়াপল্টন এলাকায়।
বুধবার বিকেলের দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন মকবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি।
নিহত মকবুল হোসেনের বড় ভাই আব্দুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তার ভাই বিএনপির সমর্থক ছিলেন। তবে মকবুল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন তার স্ত্রী হালিমা বেগম। সংঘর্ষে অন্তত ১৮ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে সংঘর্ষের পর দলীয় কার্যালয় থেকে পরোয়ানা থাকায় বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ১০ ডিসেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে আমান উল্লাহ আমান ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
রাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ জানান, বিএনপি কার্যালয় থেকে ৩০০ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে আটক করা হয়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ১৫টি ককটেল উদ্ধারের দাবি করেন তিনি।
বুধবার বিকেলে এ সংঘর্ষের পর পুরো এলাকায় তৈরি হয় থমথমে পরিবেশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুই পাশের রাস্তা ধরে পুলিশ হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে টিয়ার শেল ছুড়ে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করা নেতা-কর্মীদের দিকে এগিয়ে আসে। এ পর্যায়ে দলটির নেতা-কর্মীরা পিছু হটেন। মূল সড়কের পাশের অলি-গলিতেও লাঠিপেটা করে পুলিশ।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টন এলাকায় একাধিক সাঁজোয়া যান, প্রিজন ভ্যান ও পুলিশের অতিরিক্ত স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হয়।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০ তারিখের সমাবেশের এখনও চার-পাঁচ দিন বাকি আছে। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীরা আজকে নয়াপল্টনে রাস্তা বন্ধ করে মিছিল-মিটিং শুরু করেছিল।
‘আমরা তাদের এসব বন্ধ করতে বলায় তারা পুলিশের ওপর হামলা করে। এরপর আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিয়েছি। বিএনপি কর্মীদের চারপাশ থেকে হামলার কারণে বাড়তি ফোর্স আনাই। বাড়তি সতর্কতার জন্য সোয়াট সদস্যরাও ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ করেন।’
আরও পড়ুন:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন, অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির চার শিক্ষার্থীকে স্থায়ী ও ১০৯ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শৃঙ্খলা পরিষদের সভার সুপারিশ অনুযায়ী সোমবার অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের এক সভায় বহিস্কারের এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সভায় সভাপতিত্ব করেন। সিন্ডিকেট সভায় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালসহ সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও এর অধিভুক্ত কলেজের ১১৪ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী, সাময়িক ও বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কারের সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি। এর মধ্যে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন ও পরীক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের দায়ে ১০৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়।
রাজধানীর পল্লবীতে শনিবার দুপুরে একটি শুটিং হাউজে বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিনেত্রী শারমিন আঁখি দগ্ধ হন। এতে অভিনেত্রীর শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
ঘটনার পর অভিনেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, শুটিং হাউজের ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুত্যিক সংযোগের শর্ট সার্কিট থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
তবে প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ জানিয়েছে, বাথরুমে জমে থাকা কোনো ধরনের গ্যাসের সংস্পর্শে সিগারেটের আগুন থেকে এই বিষ্ফোরণ। ঘটনাস্থলে কোনো বৈদ্যুত্যিক শর্ট সার্কিটের আলামত পাওয়া যায়নি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন, একাধিক ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং নানা আলামত বিশ্লেষণ করে নিউজবাংলাও। তাতে পুলিশের ধারণার যথার্থতার প্রমাণ মিলেছে।
মিরপুরের পল্লবী এলাকার শুটিং হাউজটির তৃতীয় তলার ভাড়া করা ফ্লোরে চলছিল একটি টেলিফিল্মের শুটিং। প্রথম দিনের শুটিংয়ের এক ফাঁকে বেলা পৌনে ২টার দিকে অভিনেত্রী শারমিন আখিঁ মেকআপ রুমে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এমন সময় বিকট শব্দে বিষ্ফোরণ হয়। দগ্ধ অবস্থায় মেকআপ রুম থেকে আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে আসেন অভিনেত্রী। ঘটনার আকষ্মিকতায় উপস্থিত হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। দ্রুতই অভিনেত্রীকে হাসপাতালে পাঠান তার হাউজ মালিক ও সহকর্মীরা।
কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি হাউজ ও শুটিং-সংশ্লিষ্ট কেউই।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার কিছুক্ষণ আগে অভিনেত্রী শারমিন আঁখি মেকআপ রুমে মেকআপ নেয়া শেষ করেন। তখন তার পোশাক পাল্টানোর কথা ছিল বলে সঙ্গে থাকা মেকআপ আর্টিস্ট রুম থেকে বেরিয়ে যান। ফলে ওই সময় অভিনেত্রী ছাড়া মেকআপ রুমে আর কেউ ছিলেন না। এর কিছুক্ষণ পরই বিস্ফোরণের শব্দ হয় এবং দগ্ধ অবস্থায় মেকআপ রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আসেন আঁখি।
রোববার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, তৃতীয় তলার মেকআপ রুমের সঙ্গে একটি বাথরুম ও পোশাক পাল্টানোর জন্য পৃথক আরেকটি কক্ষ রয়েছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাথরুমের দরজা ভেঙে মেকআপ রুমের ভেতরে এসে পড়ে। আর বাথরুমের এক্সজস্ট ফ্যান ভেঙে ভবনের বাইরে গিয়ে পড়ে।
এতে স্পষ্ট যে বিস্ফোরণের কেন্দ্র ছিল বাথরুম। তবে অক্ষত ছিল বাথরুমের আয়না, বেসিন। ওই বাথরুমে কোনো বৈদুত্যিক সকেট লাগানো নেই, যার সাহায্যে কোনো বৈদ্যুত্যিক সরঞ্জাম চালানো সম্ভব। অন্যদিকে অক্ষত আছে বাথরুমের একমাত্র বৈদ্যুত্যিক বাতিটিও। পুরনো ভবন হওয়ায় বাথরুমের দেয়ালের বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে মোজাইক। তাছাড়া ওই বাথরুম বা মেকআপ রুমের আশপাশে কোনো রান্নাঘর বা গ্যাসের সংযোগও নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শুটিং-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি নিউজবাংলাকে জানান, বিস্ফোরণের সময় ভবনে কোনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়নি। বরং ঘটনার পর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা ছুটে গিয়ে বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে টেলিফোনে কথা হয় হাউজ মালিক ইরফান হাইউমের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, তিন মাস আগে ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা ভাড়া নিয়ে শুটিং হাউজ নির্মাণ করেন। এই টেলিফিল্ম শুটিয়ের প্রথম দিনেই এমন ঘটনা ঘটলেও আরও আগে থেকেই নিয়মিত শুটিংয়ের কাজ চলছে তার হাউজে। কখনও এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ধারণাই নেই। আমি এখনও শকের মধ্যেই আছি। ঘটনার সময় আমি পাশের রুমেই ছিলাম। হঠাৎ মেকআপ রুমে বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। ছুটে গিয়ে দেখি অভিনেত্রী চিৎকার করে মেকআপ রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমরা তাকে বাথরুমে নিয়ে গায়ে পানি ঢেলে গাড়িতে করে হাসপাতালে পাঠাই।
‘ভবনে যেন আগুন না লাগে সেজন্য মেইন সুইচ বন্ধ করে দিই। ফোন করে পুলিশকে জানাই। এখন কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো তা আমার জানা নেই। পুলিশ তদন্ত করছে, তারাই বের করবে কী ঘটেছিল।’
বাঁ থেকে- শুটিং হাউজে বিস্ফোরণের পর ক্ষতিগ্রস্ত বাথরুম, মেঝেতে পড়ে থাকা গ্যাস লাইটার ও পোড়া সিগারেটের অংশবিশেষ। ছবি: নিউজবাংলা
বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পল্লবী থানা পুলিশ। সে সময় মোবাইল ফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজ এখন নিউজবাংলার হাতে। তাতে দেখা যায়, বাথরুমের মেঝেতে একটি অক্ষত লাইটার ও সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। বেসিনের ওপর রাখা আছে একটি সিগারেটের প্যাকেট। এতে বুঝা যায় ঘটনার আগে কেউ বাথরুমে সিগারেট জ্বালিয়েছিলেন। আর সে সময় মেকআপ রুম ভেতর থেকে বন্ধ করে অভিনেত্রী পোশাক পাল্টান। পুলিশের ধারণা অভিনেত্রী নিজেই সিগারেট জ্বালিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে অভিনেত্রীর স্বামী রাহাত কবির টেলিফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমিও ওই ফ্লোরে ছিলাম। ঘটনার সময় আমি পাশের রুমে ছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে জানায় সে পোশাক পরিবর্তনের আগে চুল আয়রন করার জন্য সকেটে হেয়ার স্ট্রেইটনার লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে এই বিস্ফোরণ ঘটে। তবে আমার স্ত্রী বাথরুমে নাকি মেকআপ রুমে স্ট্রেইটনার কানেক্ট করেছিলেন, তা তার ঠিক মনে নেই।
‘তবে সে এটুকু নিশ্চিত করে বলেছে যে, স্ট্রেইটনার কানেক্ট করার সঙ্গে সঙ্গে রুমের বাতি স্পার্ক করে। এরপরই বিস্ফোরণ ঘটে। আমার ধারণা শুটিং হাউজটি যেহেতু নতুন রং করা, তাই রংয়ের গ্যাস জমা ছিল। সেখানে স্ট্রেইটনারের কানেকশন দেয়ার পরই স্পার্ক থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ স্ত্রী ধূমপায়ী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রী ধূমপায়ী। কিন্তু তার বাথরুমে বসে ধূমপান করার কোনো কারণ নেই। একই সঙ্গে বাথরুমে যে ব্র্যান্ডের সিগারেট মিলেছে সে ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট খায় না।’
তবে প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে কোনো বৈদ্যুত্যিক গোলযোগের আলামত পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে অভিনেত্রী যে হেয়ার স্ট্রেইটনারের কথা বলছেন সেটিও ঘটনাস্থলে মেলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি সম্পর্কে হাউজ মালিক ফোন করে জানালে আমরা তাৎক্ষণিক ছুটে যাই। এ বিষয়ে অভিনেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না করা হলেও আমরা অভিনেত্রী ও তার স্বামীর বক্তব্য নিয়েছি। তাদের বিবরণ অনুযায়ী বিস্ফোরণের স্থানটিতে শর্ট সার্কিটের আলামত মেলেনি।
‘আমরা যা পেয়েছি তা হল, বাথরুমে কোনো গ্যাস জমে ছিল। পরে সেখানে কেউ সিগারেট ধরাতে লাইটার জ্বালালে এই বিস্ফোরণ ঘটে।’
বাথরুমে গ্যাস কোথা থেকে জমা হল এবং কে সিগারেট ধরিয়েছিল তা জানতে চাইলে পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘এটি তদন্ত শেষ না হলে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’
থানা-সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র বলছে, অভিনেত্রী আঁখি সম্ভবত বাথরুম ব্যবহারের আগে সেখানে কোনো সুগন্ধি স্প্রে করেছিলেন। পরে হাই কমোডে বসেই সিগারেট ধরাতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। আর সে কারণে অভিনেত্রীর দুই উরু, দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ও মুখমণ্ডলের কিছু অংশ দগ্ধ হয়েছে।
তাছাড়া বাথরুমে অন্য কোনো গ্যাস জমা থাকার বিষয়টি পুলিশের ধারণায় থাকলেও এর সম্ভাবনা খুব একটা নেই বলে মনে করছে ওই সূত্র। তাদের যুক্তি, এদিন সকাল থেকে অনেকেই সেই বাথরুম ব্যবহার করেছেন এবং এগজস্ট ফ্যান থাকায় লম্বা সময় ওই বাথরুমে গ্যাস জমা থাকা সম্ভবও নয়।
আরও পড়ুন:শিক্ষক পদে ছাত্রলীগ কর্মীর চাকরি না হওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্যের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। একই সঙ্গে শাটল ট্রেন অবরোধ করে রেখেছে তারা।
চবির সিন্ডিকেট সভা চলাকালে সোমবার বিকাল চারটার দিকে ভাঙচুর চালানো হয়।
চবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মঈনুল ইসলাম রাসেল বলেন, ‘ছাত্রলীগের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ছেলেকে চাকরি না দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন নেতা ও জামাত-শিবির মদদপুষ্ট নিয়োগপ্রার্থীকে নেয়া হচ্ছে। আমাদের দাবি এদেরকে বাদ দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত জামাত-শিবির মদদপুষ্ট নিয়োগপ্রার্থীকে বাদ দেয়া হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেন অবরোধ থাকবে।’
চবির প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূইয়া বলেন, ‘ভাঙচুর কেন হয়েছে সেটা তদন্ত সাপেক্ষে বুঝা যাবে। নিয়োগের বিষয়ে এক্সপার্ট বোর্ড যাদের ভালো মনে করছে তাদের নিয়েছে। শাটলের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’
আরও পড়ুন:ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিডেটের ১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানসহ নয় জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আগামী ৪ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
মামলাটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের জন্য সোমবার দিন ধার্য ছিল। এদিন ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামান শুনানি শেষে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ৪ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এর আগে গত বছরের ১০ নভেম্বর ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন সরকার এ মামলাটি দায়ের করেন। শুনানি শেষে আদালত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের জন্য ৩০ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছিল।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা ঢাকা ওয়াসা থেকে রাজস্ব আদায় কাজ বাবদ পায়। ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ অর্থবছরে একই কাজ বাবদ সমিতি আয় করে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে সমিতির হিসাবে জমা হয় ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা।
অবশিষ্ট ১৩২ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা ৬টি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে আসামি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদে ও নির্দেশে অপর আসামিরা টাকাগুলো উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।
আত্মসাতের বিষয়টি সমবায় অধিদপ্তরের অডিট রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সমিতির গাড়িসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সমিতির হেফাজত থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ চুরির অভিযোগও আনা হয়।
ঢাকা ওয়াসার এমডি ছাড়াও মামলার অপর আসামিরা হলেন, সংস্থাটির প্রকৌশলী শারমিন হক আমীর, সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক মিঞা মো. মিজানুর রহমান, প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান, রাজস্ব পরিদর্শক মো. জাকির হোসেন, প্রকৌশলী মো. বদরুল আলম, জনতা ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম শ্যামল বিশ্বাস, উপসচিব শেখ এনায়েত উল্লাহ ও উপ প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মো. সালেকুর রহমান। এছাড়া এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও অনেককেই এ মামলায় আসামি করা হয়।
আরও পড়ুন:‘বাসের বাঙ্কার থেকে ব্যাগটা নামিয়ে পাশের ফুটপাতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে এই লোক কোথা থেকে এসে একটা রসিদ ধরিয়ে বলে ৪০ টাকা দেন। কাগজটা পড়ে দেখি এটা কুলি মজুরির রসিদ। অথচ আমি কোনো কুলি ডাকিনি এবং আমার ব্যাগ অন্য কেউ বহনও করেনি।’
রাজধানীর মিরপুর মাজার রোড এলাকায় পূর্বাশা বাস কাউন্টারের সামনে কথাগুলো বলছিলেন মেহেরপুর থেকে আসা বাসযাত্রী সনু বিশ্বাস।
এই প্রতিবেদক তার আগে দেখতে পান যে রাফি ট্রেডার্স লেখা অ্যাপ্রন পরিহিত এক যুবক বাস যাত্রী সনু বিশ্বাসের সঙ্গে কী একটি বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন।
এগিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে ওই যাত্রী বলেন, ‘আমি এসেছি মেহেরপুর থেকে। আমার ব্যাগ ছিল বাসের বাঙ্কারে। তেমন ভারি ব্যাগ নয় যে কুলি ডাকতে হবে। আমি নিজে বাঙ্কার থেকে ব্যাগ নামিয়েছি। এখন একটা সিএনটি অটোরিকশা ডেকে বাসায় চলে যাব। এর মাঝে তারা কোনো কারণ ছাড়াই এসে টাকা দাবি করছে।
‘আমি টাকা দেব না বললে সে আমার ব্যাগ আমাকেই নিতে দিচ্ছে না। এমনকি আমি যাওয়ার জন্য যেসব সিএনজি অটোরিকশ ডাকছি সে প্রতিটিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এটা তো ওপেন চাঁদাবাজি ভাই। যে আমার ব্যাগ ধরেইনি, আমি কেন তাকে কুলি মজুরি দেব?’
এ বিষয়ে সোহেল নামে রাফি ট্রেডার্সের ওই কর্মীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমরা এই এলাকা ইজারা নিয়েছি। এই এলাকার ফুটপাত আর রাস্তায় ব্যাগ রাখলে আমাদের টাকা দিতে হবে।’
এই ঘটনা রোববার দুপুরের। এর ঘণ্টাখানেক আগে একই স্থানে এমন চাঁদাবাজির শিকার হন খন্দকার বশির উদ্দিন মিলন নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাড়ি ঝিনাইদহ। সেখান থেকে পূর্বাশা পরিবহনের বাসে আমার পরিবার দুটি ব্যাগ পাঠিয়েছে। আমি সেই ব্যাগ নিতে এসেছি। বাস থেকে ব্যাগ নামিয়ে আমি সিএনজিতে উঠাতে গেলে এক লোক এসে হাতে রসিদ ধরিয়ে দিয়ে দুই ব্যাগ বাবদ ৮০ টাকা দাবি করে বসে।
‘আমি কোনো কুলিকে ডাকিনি। এমনকি আমার ব্যাগ তুলতে কেউ সাহায্যও করেনি। অথচ এই রাফি ট্রের্ডাসের লোক আমার কাছ থেকে জোর করে ৮০ টাকা নিয়ে গেল। প্রথমে আমি টাকা দেব না বললে সে আশপাশ থেকে আরও ৩-৪ জনকে ডেকে আমাকে মারতে আসে। পরে নিরুপায় হয়ে তাদের টাকা দিয়ে দিলাম।’
আরেক ভুক্তভোগী ইসহাক আলী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘মেয়রের নামে চাঁদাবাজি! ঢাকা শহরে ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে মেয়রকে চাঁদা না দিয়ে শহরে ঢোকা যাবে না। আমি তাদেরকে চাঁদা না দিয়ে গাড়ি ভাড়া করার যতবার চেষ্টা করেছি ততবার সেই গাড়ি তারা ভাঙতে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাগ প্রতি ৪০ টাকা হিসাবে দুইটা ব্যাগে ৮০ টাকা দিয়ে মাজার রোড থেকে বাসায় ফিরতে পেরেছি।’
রোববার ও আগের কয়েকদিন সরেজমিনে গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এমন আরও অনেক যাত্রীর কাছ অভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা এসব বিষয়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান।
আবার কুলি মজুরির নামে এই চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে জানালেন টার্মিনালের বিভিন্ন কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মীরা। তারা বলেন, ইজারা নেয়া প্রতিষ্ঠান রাফি ট্রেডার্সের কাছ আমরাও জিম্মি। আমাদেরও সব পরিষেবা বিল তাদের কাছেই জমা দিতে হয়।
ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কর্তৃপক্ষও কুলি মজুরির নামে রাফি ট্রেডার্সের এই চাঁদাবাজি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। জানে পুলিশ প্রশাসনও। তবে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন:রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ট্রেন ও বাস স্টপেজগুলোতে যাত্রীর ব্যাগ-বোচকা নিয়ে কুলি-মজুরদের টানাটানি নতুন কিছু নয়। গাড়ি থেকে ব্যাগ নামিয়ে দেয়ার বিনিময়ে জবরদস্তি অতিরিক্ত টাকা আদায়ও গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই বলে বাস থেকে নিজের ব্যাগটা নামিয়ে রাস্তায় রাখলেই চাঁদা দিতে হবে!
রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় প্রকাশ্যে এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে এমন চাঁদাবাজি চলছে। গাবতলী টার্মিনাল হয়ে বাসে কোনো গন্তব্যে যেতে বা আসতে হাতে ব্যাগ থাকলেই চাঁদা না দিয়ে নিস্তার নেই।
রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার গাবতলী হয়ে দেশের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের কাছ থেকে কুলি মজুরির নামে এই চাঁদাবাজি করে এই বাস টার্মিনালের ইজারাদার রাফি ট্রেডার্স।
বাড়তি ভাড়া আদায়, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, সময়ক্ষেপণ, পরিবহনকর্মীদের আপত্তিকর আচরণে এমনিতেই দিশেহারা বাসযাত্রীরা। এবার তাতে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে এই চাঁদাবাজি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গাবতলী এলাকায় বাসে উঠা-নামার পর যাত্রীদের ব্যাগ না ধরেই তাদের কাছ থেকে জোরজবস্তি ব্যাগ প্রতি ৪০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে রাফি ট্রেডার্সের কর্মীরা। এ নিয়ে প্রতিদিনই যাত্রীদের সঙ্গে রাফি ট্রেডার্সের কর্মীদের বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে তা হাতাহাতিতেও গড়াচ্ছে।
গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় নিউজবাংলার সরেজমিন অনুসন্ধানে এই চাঁদাবাজির সত্যতা মিলেছে। ইজারাদার রাফি ট্রেডার্সের এক কর্মকর্তা প্রথমে এমন চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে এর সত্যতা স্বীকার করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
তবে বাস্তবতা হলো, এই চাঁদাবাজদের কাছে পুলিশও যেন অসহায়। ওদের সঙ্গে পেরে না উঠে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন।
রোববার দুপুরে মিরপুর মাজার রোড এলাকায় পূর্বাশা বাস কাউন্টারের সামনে গিয়ে চোখে পড়ল এক যাত্রীর সঙ্গে ইজারাদার রাফি ট্রেডার্সের অ্যাপ্রন পরা এক কর্মী তর্ক করছেন।
জানা গেল, সনু বিশ্বাস নামে ওই যাত্রী মেহেরপুর থেকে এসেছেন। তার কাছ থেকে জোর করে কুলি মজুরি বাবদ ৪০ টাকা আদায় করাকে কেন্দ্র করে এই বিতণ্ডা।
সনু বিশ্বাস বলেন, ‘আমি বাসের বাঙ্কার থেকে ব্যাগ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে এই লোক কোথা থেকে এসে একটা রসিদ ধরিয়ে বলে, ৪০ টাকা দেন। পরে কাগজটা পড়ে দেখি এটা কুলি মজুরির রসিদ। অথচ আমি কোনো কুলি ডাকিনি এবং আমার ব্যাগ অন্য কেউ বহনও করেনি।’
এ বিষয়ে সোহেল নামে রাফি ট্রেডার্সের ওই কর্মীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমরা এই এলাকা ইজারা নিয়েছি। এই এলাকার ফুটপাত আর রাস্তায় ব্যাগ রাখলে আমাদের টাকা দিতে হবে। আর আপনি ঝামেলা করতাছেন ক্যান? আপনি এইখান থ্যইক্যা যান।’
আপনার বস কে- এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুজন নামে একজনকে দেখিয়ে দেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এই চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে সুজন বলে ওঠেন, ‘এসব রিপোর্ট করে আপনি আমাদের কিছুই করতে পারবেন না। ওই যে নাবিল বাস কাউন্টারের পাশে একটা চায়ের দোকান আছে। আপনার যা জানার সেটা আপনি ওই চায়ের দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন।’
এরপর ওই চায়ের দোকানদারের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার এই প্রতিবেদকের। তিনি নিজেকে শাহীন নামে পরিচয় দেন। চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। গাবতলী বাস টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় আমাদের অফিস আছে। আপনি সেখানে গিয়ে কথা বলেন।’ গাবতলী বাস টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় রাফি ট্রেডার্সের অফিসে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।
সনু বিশ্বাসের মতো আরও বেশ কয়েকজন বাস যাত্রী কুলি মজুরির নামে এভাবে গাবতলী বাস টার্মিনালে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন।
তাদের একজন খন্দকার বশির উদ্দিন মিলন নিউজবাংলাকে বলেন, পূর্বাশা পরিবহনের বাস থেকে ব্যাগ নামিয়ে সিএনজিতে উঠাতে গেলে এক লোক এসে রসিদ ধরিয়ে দিয়ে দুই ব্যাগ বাবদ ৮০ টাকা দাবি করে। অথচ আমি কোনো কুলিকে ডাকিনি। আমার ব্যাগ তুলতে কেউ সাহায্যও করেনি। অথচ এই রাফি ট্রের্ডাসের লোক আমার কাছ থেকে জোর করে ৮০ টাকা নিয়ে গেল।
ইসহাক আলী নামে আরেক ভুক্তভোগী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘মেয়রের নামে চাঁদাবাজি! শেষ পর্যন্ত ব্যাগ প্রতি ৪০ টাকা হিসাবে দুইটা ব্যাগে ৮০ টাকা দিয়ে মাজার রোড থেকে বাসায় ফিরতে পেরেছি।’
প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি
গাবতলী বাস টার্মিনালে এক কাউন্টারের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এরা মাফিয়া কায়দায় এই বাস টার্মিনাল চালায়। কেউ এদের কিছু বলে না। বাস টার্মিনালসহ পর্বত সিনেমা হল থেকে মাজার রোড পর্যন্ত পুরা এলাকা এই রাফি ট্রেডার্সের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে। এই এলাকায় কোনো যাত্রী ফুটপাত অথবা ফুটপাতের পাশে রাস্তায় কোনো ব্যাগ রাখলেই ওদেরকে টাকা দিতে হয়।
‘আমরা আমাদের কাউন্টারের ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পরিচ্ছন্ন বিলসহ এ বাবদ সে বাবাদ সব টাকাই এদের হাতে দিই। অথচ এরা এই বাস টার্মিনাল পরিষ্কার কী করে সেটা আপনারাই দেখেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই টার্মিনালসহ সামনের রাস্তায় এদের একশ’র বেশি কর্মী থাকে সব সময়। এর মধ্যে রাফি ট্রের্ডাসের নাম লেখা ড্রেস পরে থাকে ৩০-৪০ জন। বাকিরা সাধারণ মানুষের মতো থাকে। এই ড্রেস পরা কর্মীরা যাত্রীদের কুলি মজুরি রসিদ ধরিয়ে দিয়ে চাঁদাবাজি করে। এরা যাত্রীদের ছোট ব্যাগে ৪০ টাকা আর বিদেশ থেকে আসা যাত্রীর ব্যাগ প্রতি নেয় ১২০ টাকা।
‘এরা লক্ষ্য রাখে যে যাত্রীদের ব্যাগে বিমানবন্দরের কোনো ট্যাগ লাগানো আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সেই যাত্রীর আর রক্ষা নেই। ব্যাগ প্রতি ১২০ টাকা আদায় করে ছাড়ে। কোনো যাত্রী টাকা দিতে না চাইলে সাধারণ মানুষের বেশে থাকা ওদের বাকি সদস্যরা গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তুলে বসে।
‘অনেক সময় যাত্রীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। কিছু বললে তো আমরাই এখানে থাকতে পারব না।
আরেক কাউন্টারের এক কর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনিও পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘রাফি ট্রেডার্সের ড্রেস পরা কর্মীরা নামে কুলি হলেও এদের কাউকে দিয়ে আপনি কোনো মালামাল উঠাতে পারবেন না। এই ৩০-৪০ জনের একেক জন ১০ হাজার টাকার উপরে চাঁদাবাজির করে আয় করে।
‘সব মিলিয়ে দিনে তারা ৩-৪ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করে। এদের কাউকেই রাফি ট্রেডার্সের পক্ষ থেকে বেতন দেয়া হয় না। এরা চাঁদাবাজির কমিশন পায়। তাছাড়া এই টাকা পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে উপর মহলেও যায় বলে শুনেছি। তাই তারাও সব কিছু দেখে না দেখার ভান করে।’
রাফি ট্রেডার্সের এই চাঁদাবাজি নিয়ে মাজার রোড়ে কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্ট রাফিউল ইসলাম রাফির সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তিনি বলেন, ‘এই রাফি ট্রেডার্স ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসি) কাছ থেকে পুরো গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা ইজারা নিয়েছে। আমরাও যাত্রীদের ব্যাগ বহন না করে জোর করে টাকা নেয়ার অভিযোগ পাই। এ বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাত্রীরা এভাবে একের পর এক হয়রানির শিকার হলেও কেউ এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করে না। তাই আমরা কিছু করতে পারি না। এরা টাকা দাবি করলে সাধারণ মানুষ ঝামেলা এড়াতে টাকা দিয়ে চলে যায়। আমাদেরও কিছু জানায় না।’
সাধারণ মানুষ মামলা না করলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে আপনারা কেন এই চাঁদাবাজি বন্ধ করছেন না?- এমন প্রশ্নে তিনি কোনও উত্তর দেননি।
গাবতলী বাস টার্মিনালের প্রধান কর্তৃপক্ষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক (গাবতলী বাস টার্মিনাল) মোহাম্মাদ জাহিদ হাসান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যাত্রীদের কাছ থেকে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য চাঁদাবাজির অভিযোগ পাই। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর চিঠি দিয়ে সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখন দেখি স্যারেরা কী সিদ্ধান্ত নেন।’
ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে রাফি ট্রেডার্সকে ইজারা দেয়ার সময় বেশকিছু শর্ত দেয়া হয়। তার মধ্যে ২২ নম্বর শর্ত- কোনো যাত্রী সামান্য মালামাল উঠানো বা নামানোর জন্য কুলির সাহায্য না চাইলে কোনো কুলি ওই মালামাল স্পর্শ করা বা মজুরি দাবি করতে পারবে না। ওরা এই শর্ত ভঙ্গ করেছে।’
ডিএনসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ সেলিম রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাফি ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আমরাও এই অভিযোগ পেয়েছি। এর আগেও আমরা তাদের সতর্ক করেছি। এখন আমরা তাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছি।
‘এখনও যদি তারা এই কাজ করে তাহলে সিরিয়াসলি তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় এ ধরনের কুলি মজুরির রসিদ দিয়ে চাঁদাবাজি করার কোনো সুযোগ নেই।’
ইজারাদার রাফি ট্রেডার্স যা বলছে
রাফি ট্রের্ডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) লিয়াকত হোসেন সবুজ নামে এক ব্যক্তি। নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে রাফি ট্রেডার্সের প্রজেক্ট ডিরেক্টর সাইফুল ইসলাম শ্রাবণ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন চাঁদাবাজি হাওয়ার তো কথা না। আমাদের এখানকার কর্মীরা কোনো যাত্রীর মালামাল বহন করা নিয়ে জোরজবরদস্তি করে না। এরকম করার নিয়মও এখানে নেই। যাদের কুলির প্রয়োজন হয় শুধু তাদের কাছ থেকেই আমাদের কর্মীরা টাকা নেয়।’
যাত্রীদের অভিযোগ, উত্তর সিটি করপোরেশনের চিঠিসহ নিউজবাংলার কাছে এই চাঁদাবাজি চলার বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে জানালে শ্রাবণ বলেন, ‘আসলে কি, এরকম দুই/একটা ঘটনা হয়তো ঘটতে পারে। ওরা লেবার মানুষ তো। অনেক কিছুই হয়তো ওরা করে ফেলে। এর আগেও আমরা ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা সব সময়ই ওদের মনিটরিংয়ে রাখি। তারপরও আমি খোঁজ নিচ্ছি, যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে ব্যবস্থা নেব।’
আরও পড়ুন:খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশানের বাড়ি নিয়ে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের ফেসবুকে আপলোড করা দুটি ভিডিও সরাতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ নির্দেশ দেয়।
আদালতে রিটকারী সুমনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার অনীক আর হক। আবদুস সালাম মুর্শেদীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী, সাঈদ আহমেদ রাজা ও সালাম মুর্শেদীর মেয়ে সেরিনা সালাম ঐশী।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জাকির হোসেন মাসুদ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
সেরিনা সালাম ঐশী সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ২৩ ও ২৫ জানুয়ারি (ব্যারিস্টার সুমন) আমাদের বাড়ি নিয়ে লাইভ করেছেন। আদালত শুনানি নিয়ে সেই লাইভের ভিডিও অপসারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কোনো বিষয় নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাইভ বা ভিডিও প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন আদালত।’
আবদুস সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশানের বাড়ি নিয়ে অভিযোগ অনুসন্ধানে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে দুদক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আবদুস সালাম মোর্শেদীর বাড়ি-১০, গুলশান-২, ঢাকা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে রাজউকের চেয়ারম্যানের সহায়তায় পরিত্যক্ত বাড়ি দখলের প্রাপ্ত অভিযোগটি ২ সদস্যবিশিষ্ট টিমের মাধ্যমে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে মহাপরিচালক (তদন্ত-১) বরাবর পত্র প্রেরণের জন্য কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।’
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে জানান, অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেটি অনুসন্ধান শুরু করেছে।
দুদক ছাড়াও রাজউকের প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়, আবদুস সালাম মুর্শেদীর গুলশানের বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় নেই।
গত ১৬ জানুয়ারি আবদুস সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশানের বাড়ি সংক্রান্ত মূল নথি ও প্রতিবেদন অ্যাফিডেভিট করে এক সপ্তাহের মধ্যে জমার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
সরকারের সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে বাড়ি বানানোর অভিযোগে আবদুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ১ নভেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এ সম্পত্তি সম্পর্কিত সব কাগজপত্র ১০ দিনের মধ্যে আদালতে জমা দিতে (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) রাজউক, গণপূর্ত বিভাগ ও সালাম মুর্শেদীকে নির্দেশ দেয় আদালত।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য