বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জোট ভাঙল বিএনপি, জানে না শরিকরা

  •    
  • ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:৫০

বিএনপির সঙ্গে জোট আর নেই, সেই কথা ঘরোয়া আলোচনায় জামায়াতের আমির জানিয়েছিলেন গত ২৭ আগস্ট। কিন্তু কিছুই বলছিলেন না বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাদের জোট আর নেই। কিন্তু যে শরিকরা দুই যুগ ধরে জোটে ছিলেন, তারা নিজেদের এখনও শরিক ভাবছেন। কারণ, বিএনপি তাদের জানায়নি কিছুই।

প্রায় দুই যুগ আগে বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট যে আর নেই, সে বিষয়টি শরিকদের জানায়নি বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বিষয়টি জানালেও অন্ধকারে রেখেছে শরিক দলগুলোকে। জোটে আছে ভেবেই তারা বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

বিএনপির সেই জোটের আটটি শরিক দলের নয়জন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। এর মধ্যে কেবল একটি দলের একজন নেতা স্বীকার করেছেন জোট নেই। বাকি সাতটি দলের আটজন নেতা জানেন না কিছুই।

তবে মির্জা ফখরুলের সেই বক্তব্য এবং তার ওপর গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন পড়েছেন এখনও শরিক হিসেবে ভাবা দলগুলোর নেতারা। তবু বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের। কারও ধারণা, বিএনপি মহাসচিব হয়তো অন্য কিছু বুঝিয়েছেন। কারণ, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি কিছুই।

জোট নেই এই ঘোষণা জামায়াতের পক্ষ থেকেই জানানো হয়েছিল প্রথমে। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়, দলের ঘরোয়া এক আয়োজনে, যেটির ভিডিও চলে আসে গণমাধ্যমে। দলটির দুইজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। এদের একজন বলেছেন, ২০-দলীয় জোট নেই। আরেকজন নেতা বলেছেন, জোট আছে।

জোট না থাকার প্রশ্নে আরেক শরিক এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘এসব কথা কে বলেছে আপনাকে?’

মির্জা ফখরুলের সংবাদ সম্মেলনের পর গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পড়েছেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। তারপরও বিশ্বাস হয়নি তার। তার ধারণা, বিএনপি মহাসচিব হয়তো অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন।

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমও জানেন জোট আছে। বলেছেন, তারা বিএনপির সঙ্গে ছিলেন, আছেন।

জাগপার একাংশের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান বলেছেন, ‘জোট তো আছেই… ভাঙার ব্যাপারে তো আমাদের কিছু জানানো হয়নি।’

দুই যুগের জোটে ভাঙন প্রকাশ যেভাবে

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপির নেতৃত্বে যে জোট গঠন করা হয়, প্রথমে সেটি ছিল চারদলীয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী এবং আজিজুল হকের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এরশাদ জোট ছেড়ে চলে গেলেও তার দলের একাংশ বিজেপি নামে দল গঠন করে জোটে থেকে যায়।

এরপর ধীরে ধীরে জোটের দল বেড়ে হয় ১৭, পরে হয় ২০। এখন তা ২০-দলীয় জোট নামেই পরিচিত। এরপর ২০১৮ সালে বিএনপি গড়ে তোলে আরও একটি জোট, নির্বাচনে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেও।

১৯৯৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে বিএনপি গঠন করে চারদলীয় জোট। পরে জোটে দলের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হয় ২০টি

একই সঙ্গে দুটি জোটের অভিনবত্ব কাজে না আসার পর ভোট শেষে ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যায় দুটিই। আর চার বছরের মধ্যে ঘোষণা না দিয়েই জোট থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত জানায় বিএনপি।

চার থেকে পাঁচটি দল জোট থেকে ঘোষণা নিয়ে বের হয়ে আসার পর সেই দলগুলোর কয়েকজন নেতা একই নামে আলাদা দল গঠন করে ২০ দলে থেকে যাওয়ায় বিএনপির জোটের নাম ২০ দলই থেকে যায়। তবে সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে, সেটি আসতে থাকে গণমাধ্যমে।

এর মধ্যে সাড়ে তিন মাস আগে বোমা ফাটান জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গত ২৭ আগস্ট দলের কুমিল্লার একটি ইউনিটের রুকন সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি জানান, বিএনপির সঙ্গে জোটে আর নেই তারা।

তবে স্বীকার করছিল না বিএনপি। একের পর এক প্রশ্নে মুখ খুলছিলেন না মির্জা ফখরুল। এমনও বলেন, এ নিয়ে কথা বলতে না চাওয়া তার গণতান্ত্রিক অধিকার।

তবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ৮ ডিসেম্বর তিনি সংবাদ সম্মেলনে আসার পর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিনিধির এক প্রশ্নে জানান, তাদের জোট আর নেই। এখন হবে যুগপৎ আন্দোলন।

বিএনপি সেই কর্মসূচিটি করতে চেয়েছিল নয়াপল্টনে। কিন্তু পুলিশ অনুমতি দেয়নি। এরপরও সেখানে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে ৭ ডিসেম্বর হয় সংঘর্ষ, প্রাণ হারান একজন।

সেদিন সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানের সময় বাইরে বসে থাকা মির্জা ফখরুলের সঙ্গী এক কর্মী নিউজবাংলাকে জানান, সেদিন বিএনপি মহাসচিব অনেককে ফোন করেন। তাদের একজন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এতে খুবই ক্ষুব্ধ হন বিএনপি নেতা। পরে দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও প্রসঙ্গটি তোলেন।

এর পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসেই ফখরুল ঘোষণা করেন, তারপরও তারা নয়াপল্টনেই যাবেন। বাধা এলে ব্যবস্থা নেবে জনগণ।

এএফপির প্রতিনিধি ফখরুলের কাছে একপর্যায়ে জানতে চান, এ ক্ষেত্রে বিএনপির শরিক দলগুলোর কী অবস্থান।

তখন বিএনপি নেতা জানান তাদের জোট ভেঙে যাওয়ার তথ্য। বলেন, ‘আমাদের কোনো জোট নেই। আমরা বলেছি, অন্য দলগুলো গণতন্ত্রের জন্য তাদের নিজস্ব কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচি পালিত হবে একই সঙ্গে, যাকে আমরা যুগপৎ বলে থাকি। সবাই নিজের পছন্দের এলাকা বা অফিসে কর্মসূচি পালন করবে।’

সমমনা যে দলগুলো তারা কি তাহলে ১০ ডিসেম্বর আলাদা আলাদা সমাবেশ করবে?- এমন প্রশ্ন রাখেন দেশের একটি গণমাধ্যমের কর্মী।

ফখরুল জবাব দেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে মানেই এটা।’

জামায়াত আমির জানিয়েছিলেন গত ২৭ আগস্ট। সাড়ে তিন মাস গোপনের পর ৮ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল জানান, তাদের জোট আর নেই

গত জাতীয় নির্বাচনের আগে গড়ে তোলা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও অকার্যকর হয়ে যায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়েই। এর মধ্যে কেবল আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বের হয়ে যায় গণমাধ্যমকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে। বাকি দলগুলোর মধ্যে জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

কিন্তু দুই ভাগে বিভক্ত গণফোরামের মধ্যে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন অংশের সঙ্গে যোগাযোগই নেই বিএনপির। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যত সম্ভব বেশি দলকে নামানোর চেষ্টায় একের পর এক বৈঠক করলেও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বসেনি বিএনপি। আবার বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলেও ধানের শীষ নিয়ে জয়ী গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ এবং বিএনপির সমর্থনে জয়ী মোকাব্বির খান পদত্যাগ করেননি, করবেনও না।

ফখরুলের বক্তব্য শুনেছেন কেউ কেউ, বিশ্বাস হয়নি তবু

জামায়াতের আমির যা বলার বলে দিয়েছেন তিন মাস আগে। তবু কিছু স্বীকার করতে চান না দলের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আপনারাও শুনেছেন, আমিও শুনেছি (ফখরুলের বক্তব্য)। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসা পর্যন্ত এটি কার্যকর না বলেই আমি মনে করি।’

ফখরুলের বক্তব্যের পর আর আনুষ্ঠানিকতা বলতে কী বলতে চাচ্ছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নানা কৌশল থাকে। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এটি পরিষ্কারভাবে বলার সময় হয়নি।’

তবে দলের ঢাকা মহানগর শাখার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জোট ভেঙে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘জোট তো নেই সেই কবেই। মা-ছেলের যুদ্ধের মধ্যে জোট ভেঙে গেছে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখন একটা ফরমালিটিস জাস্ট।’

২০-দলীয় জোট না থাকার প্রসঙ্গে প্রশ্ন শুনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান অলি আহমদ করেছেন পাল্টা প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘জোট ভাঙার কথা কে বলেছে আপনাকে? মহাসচিবের (ফখরুল) এমন কোনো বক্তব্য আমি শুনিনি। ২০-দলীয় জোট এখনও আছে, আমরা সেই জোটে আছি। ইটস স্টিল অ্যাকটিভ।’

১৩ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয় পরিদর্শনে যাওয়া বিভিন্ন ছোট ছোট দলের নেতারা জানতেন তারা তখনও জোটের অংশই।

সেখানেই প্রশ্নের মুখে পড়েন কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম। জবাবে বলেন, ‘আমরা ২০-দলীয় জোটে আছি কি না জানি না; তবে বিএনপির সঙ্গে ছিলাম এবং আছি। আন্দোলনের বিষয়বস্তু যেখানে এক, সেখানে এটা ২০-দলীয় জোট নাকি নতুন কোনো জোট, সেটার তেমন সম্পর্ক নাই।’

জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) একাংশের মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জোট ভাঙা নিয়ে আমাদের সাথে কোনো বৈঠক হয়নি।’

১৩ ডিসেম্বর দলগুলোর নেতারা যখন বিএনপির কার্যালয়ে যান, তখনও তারা ২০ দলের শরিক বলেই জানতেন

২০-দলীয় জোটে আছেন কি না, বিএনপি আপনাদের জানিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি। বলেন, ‘যা বলার বলে দিয়েছি।’

একই নামে দলের আরেক অংশের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘মহাসচিব (ফখরুল) এভাবে বলতে পারেন না। উনি হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, জোটের অ্যাকটিভিটি এখন কম। তবে জোট না থাকার প্রশ্নই আসে না।

‘আমাদের সঙ্গে জোট ভাঙা নিয়ে কোনো বৈঠক বা আলাপ হয়নি। আলাদা আলাদাভাবে যুগপৎ আন্দোলনের কথা আলাপ হয়েছে। তবে ২০-দলীয় জোট, এই বন্ড…বন্ড স্টিল দেয়ার।’

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপার একাংশের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমানও বলেন, ‘জোট তো আছেই। আমরা আগামী সপ্তাহে একটি প্রোগ্রাম করেছি, সেখানে জোটের নেতা-কর্মীরা অংশ নেবেন।’

মির্জা ফখরুল তো যা বলার বলেছেন। এরপর কীভাবে দাবি করেন জোট আছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনি হয়তো এভাবে বলতে চাননি। আমরা তো বিচ্ছিন্ন না। আমরা যুগপৎভাবে যার যার জায়গা থেকে আন্দোলন করছি। সে রকমটাই বলা হচ্ছে।’

অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘জোট ভাঙা নিয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। আমি জানি না।’

লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘২০-দলীয় জোট ভাঙা কিছু নেই, এটা তো কখনই ভাঙবে না। তবে জোট এখন কার্যকর না। মহাসচিব ভাঙার কথা বলেননি, যুগপৎভাবে যার যার জায়গা থেকে আন্দোলন করতে বলছেন।’

মহাসচিবের সেদিনের স্পষ্টভাবে বলা বক্তব্যের রেকর্ড আছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে আলাদা করে কিছু বলেনাই। আমরা সেটা জানি না।‘

ন্যাপ (ভাসানী) সভাপতি আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘মহাসচিবের (ফখরুল) কথা আমি শুনেছি। উনার কথাও একদিক দিয়ে ঠিক, ২০ দলীয় জোট আর নেই। কারণ আমরা ২০-দলীয় জোটটাকে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে নিয়ে যেতে যুগপৎ আন্দোলন করছি। সামনের যে গণমিছিল, সেটায় আমরা জয়েন করছি। ঘুরে ফিরে সেই ২০ দলের সদস্যই আমরা।’

এ বিভাগের আরো খবর