বিড়ালদের নিয়ে ফেসবুক-ইউটিউবে আলোচিত ‘পুচি ফ্যামিলি’র তাপসী দাশের বিরুদ্ধে বিড়াল নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। বিড়ালপ্রেমীদের চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ জানিয়ে মামলার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে লিখিত আবেদনও জমা পড়েছে।
অভিযোগকারীরা রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসে তাপসী দাশের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে সেখানে থাকা বিড়ালগুলোকে তার কবল থেকে বাঁচানোর অনুরোধ করেছেন। তাপসীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হিসেবে তারা বলছেন, পুচি ফ্যামিলির ফেসবুক পেজে ফলোয়ার প্রায় ৯ লাখ। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার আছে ১ লাখ ৪০ হাজার। এসব ফলোয়ারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিড়ালের প্রতি নিষ্ঠুরতা শেখাচ্ছেন তাপসী দাশ।
তাপসীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে প্রাণীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারও। সংস্থাটির কর্মীরা নিষ্ঠুরতার শিকার প্রাণীদের হেফাজতে নিয়ে চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে সারিয়ে তোলেন।
সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দীপান্বিতা রিদি রোববার নিউজবাংলাকে জানান, পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশের ডিওএইচএসের বাসায় অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। এই বাসায় অভিযান পরিচালনার আগে পরিষদের অনুমতি নিতে হয়। সেটার জন্যও আবেদন করা হয়েছে। থানা-পুলিশের কাছে আগেই অভিযোগ করা হয়েছে।
এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারের লিখিত অভিযোগ
রোববার এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারের পক্ষে তাজকিয়া দিলরুবা পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে তাপসী দাশ বিড়ালদের নিয়ে ফানি ভিডিও তৈরির নামে অ্যানিমেল অ্যাবিউজ অ্যাক্টের যত ধারা আছে, সব ধারাতেই অপরাধ করে যাচ্ছেন। অভিযোগে বিষয়টির আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বিড়াল ফিরে পেতে পুলিশের দারস্থ মনিরা
রোববারই মনিরা আক্তার নামে এক নারী তার বিড়াল ফিরে পেতে পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এতে তিনি বলেছেন, ‘২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পুচি ফ্যামিলি নামের ফেসবুক পেজের মালিক মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসিন্দা তাপসীর কাছে আমার এক মাস বয়সী বিড়ালছানাকে লালন-পালনের জন্য দিই। তাপসী ফেসবুক লাইভে এসে আমার বিড়ালছানাটিসহ অন্য বিড়ালছানাদের মারধর করে আসছেন। বিষয়টি দেখে তাপসীর কাছে আমার বিড়ালছানাটি ফেরত দিতে বলি। তিনি না দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন।’
পুচি ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
এএলবি অ্যানিমেল শেল্টার বলছে, তাপসী দাশ ফেসবুকে বিড়ালকে নিয়ে যাচ্ছেতাই আচরণ করে থাকেন। নির্মম আচরণের ভিডিও ধারণ করে তার প্রায় ৯ লাখ ফেসবুক ফলোয়ার ও দেড় লাখ ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারকে নিষ্ঠুরতা শেখাচ্ছেন। এদিক থেকে আইসিটি অ্যাক্টেও তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নিয়েছে সংস্থাটি।
তাপসীর নিষ্ঠুরতার উদাহরণ দিতে গিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান দীপান্বিতা রিদি বলেন, এক বিড়ালের মূত্র মেশানো পানি আরেক বিড়ালকে পান করানো হয়। এটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। শুধু ভিডিও বানানোর জন্য তিনি চরম অস্বাস্থ্যকর ও নির্মমতার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
তাপসী দাশ মাছের নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার না করে কেবল সেদ্ধ করে বিড়ালকে খাওয়ান। এভাবে খাওয়াতে উৎসাহ দেন অনুসারীদের। এতে বিড়ালের বদহজম, ডায়রিয়া ও পেটে ক্রিমি জন্ম নেয়ার শঙ্কা থাকে।
এ ছাড়া তার অনেক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি প্রায়ই বিড়ালের ছোট ছোট বাচ্চার লেজ বা গলা ধরে টান মারেন। এতে ছানাদের মেরুদণ্ড থেকে লেজ আলাদা হয়ে যেতে পারে। সেটা জোড়া লাগানোর চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। ফলে বিড়াল সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
তার দেখাদেখি অনুসারীরাও এসব শিখছেন এবং বিড়ালের ওপর এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। এসবের প্রমাণও আছে। তার ভিডিওতে ক্রমাগত মেটিংকে (মিলন) উৎসাহ দেয়া হয়। কীভাবে মেটিং করাতে হয় তার প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন তিনি। তবে টানা মেটিংয়ের ফলে মরণব্যাধি হওয়ার শঙ্কা থাকে বিড়ালের।
এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারের চেয়ারম্যান দীপান্বিতা রিদি আরও অভিযোগ করেন, ‘পিওর পার্শিয়ান বিড়ালগুলোর কখনোই স্পে, নিউটার করান না তাপসী দাশ। কিন্তু ফলোয়ারদের দেখান, তিনি স্টেরিলাইজেশন করান। এভাবে তিনি তার অনুসারীদের ভুল ধারণা দেন। এ ছাড়া ব্রিডিং করে পিওর ব্রিড বলে মিক্সড ব্রিড সেল করেন বিড়ালপ্রেমীদের কাছে। এভাবে অনেক মানুষ তার মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, তাপসী যেসব টিস্যু দিয়ে বিড়ালের মূত্র পরিষ্কার করেন, সেগুলো দিয়েই বিড়ালের মুখ পরিষ্কার করেন। এ ছাড়া ছোট ছোট বাচ্চাকে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়ে অনেক ছানার মৃত্যু ঘটিয়েছেন তাপসী দাশ।
‘আলো’র বিরুদ্ধে অপয়া অপবাদ! কী হয়েছিল আলোর?
এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারের কর্মী ও প্রাণিপ্রেমিকরা নিউজবাংলাকে বলছেন, আলো নামের একটি অন্ধ বিড়াল ছিল তাপসী দাশের কাছে। সেটির সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রাণিপ্রেমীদের কাছে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেন তাপসী। আলোকে মেন্টাল টর্চার করা হয়।
তাপসীর হেফাজতে থাকা যত বিড়াল মারা যায়, তার সব দায় চাপানো হয় আলো নামের এই বিড়ালের ওপর।
তাপসী দাশের ফেসবুক লাইভে ভেটেরেনারি চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বলা হয়, আলো এমন এক অসুখ বহন করে, যার জন্য আলো সুস্থ থাকলেও আশপাশের সবাই মারা যায়। যদিও চিকিৎসককে বলতে শোনা গেছে, আলোর পরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব না তার থেকে অসুখ ছড়িয়েছে কি না।
আরও পড়ুন: বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ, দুই পক্ষকে ডেকেছে পুলিশ
বিড়ালপ্রেমীদের দাবি, আলোকে কোনো রকম চেকআপ করানো হয়নি। অনেকেই আলোর চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাপসী দেননি। শুধু তা-ই নয়, আলোকে তার আসল মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার পর সেই মালিককে পুচি ফ্যামিলি থেকে ভয় দেখানো হয়েছিল, যাতে কোনো চিকিৎসা না করান। একপর্যায়ে আলো মারা যায়।
বিড়ালপ্রেমীরা জানান, পুচি ফ্যামিলি থেকে আলোর ব্যাপারে যা যা বলা হয়েছে, তার বেশির ভাগই মিথ্যা। তাপসী দাশ টেস্ট না করিয়েই সবকিছু বলেছেন। আলোর মৃত্যুর জন্য তাপসী দাশ দায়ী এবং অবশ্যই এটা অ্যানিমেল অ্যাবিউস ও ক্রুয়েলটি।
পুচি ফ্যামিলি পেজের স্বত্বাধিকারীর বক্তব্য
পুচি ফ্যামিলি পেজের মালিক তাপসী দাশের স্বামী পার্থ চৌধুরী। তাপসী দাশের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন তিনি।
পার্থ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনারা আমাদের ভিডিওগুলো দেখেন। একেবারে স্বচ্ছ। আমার স্ত্রী তাপসী দাশ অনেক আগে থেকেই বিড়াল পালন করে। কয়েকজনের পরামর্শে পেজ খোলে। অল্প সময়ের মধ্যে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ফলোয়ার হয়েছে। এটা অনেকেরই পছন্দ হচ্ছে না।
‘তাপসী একটি লাইভে এক হাতে মোবাইল ফোন ধরে রাখার কারণে আরেক হাত দিয়ে বিড়ালের লেজ বা গলা ধরেছিল। এটা অনেক আগের ঘটনা। সামুদ্রিক মাছ সেদ্ধ করে কাঁটা ছাড়িয়ে বিড়ালকে খাবার দেয়া হয়। কোনো অস্বাস্থ্যকর খাবার দেয়া হয় না। নির্যাতনও করা হয় না।’
থানার পুলিশের কাছে করা লিখিত অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পার্থ দাশ বলেন, ‘ওরা যদি মামলা করে, আমরাও আইনজীবী নিয়োগ করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
পুলিশের বক্তব্য
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিড়াল নির্যাতন নিয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। যেহেতু ঘটনাস্থল ডিওএইচএস এলাকা, তাই সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে অভিযোগটি পোষ্য প্রাণী রক্ষা বা নিরাপত্তা আইনে মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’