বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘নয়া দামানের’ সেই শাইল ধান কোথায়

  •    
  • ৫ মে, ২০২১ ২০:০৫

সিলেট অঞ্চলে একসময় ব্যাপক হারে শাইল ধানের আবাদ হতো। এখন শখের বসে কেউ কেউ এর চাষ করে। এই ধানের ফলনে দীর্ঘ সময় লাগে এবং ফলন কম হয়, তাই কৃষক বর্তমানে হাইব্রিড ধানের দিকেই ছুটছেন।

‘আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা

বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা।।

দামান বও, দামান বও।

গানের এই লাইনগুলো এখন দেশজুড়ে অসংখ্য মানুষের মুখে মুখে। এই নয়া দামান, মানে নতুন বর, তার বসার জন্য যে বিছানা বিছিয়ে দেয়া হচ্ছে তাতে শাইল ধানের নেরা (নেরা মানে খড়) কেন? এই ‘নেরার’ বিশেষত্ব কী? শাইল ধানই বা কোনটা?

শাইল ধান নিয়ে এমন প্রশ্নে আক্ষেপ ঝরে পড়ে মৌলভীবাজারের বড়লেখার প্রবীণ কৃষক বেনু দাসের কণ্ঠে। স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘আগে এই অঞ্চলে প্রচুর শাইল ধানের চাষ হতো। এই ধানের চাল সুগন্ধি ও খেতে সুস্বাদু। শাইল ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন জাতের পিঠা, চিড়া ও মিষ্টান্ন তৈরি হতো।’

প্রবীণ এই কৃষক বলেন, এখন আর শাইল ধান বা এ রকম পুরনো জাতের ধান খুব একটা চাষ হয় না। এখন সবাই হাইব্রিড জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানে ঝুঁকেছেন।

সিলেট বিভাগ হাওরবেষ্টিত। বিভাগের চার জেলাতেই রয়েছে হাওর। হাওরের প্রধান শস্য বোরো ধান। তবে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে আউশ এবং আমনেরও আবাদ হয়।

স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, শাইল ধানের স্থানীয় পর্যায়ের একটি জাত। যা রোপা আমন মৌসুমে, সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে চাষ হয়। আবার শাইল ধানের মধ্যেও কয়েকটি জাত রয়েছে। যেমন ইন্দ্রশাইল, কাকশাইল, ময়না শাইল, কামিনীশাইল, মোটাশাইল, কার্তিক শাইল প্রভৃতি। জাতভেদে স্বাদ ও গন্ধে রয়েছে তারতম্য। শাইল ধানকে অনেকে শালি ধানও বলে থাকেন।

সিলেট অঞ্চলে একসময় প্রচুর পরিমাণে শাইল ধানের চাষ হতো। তবে বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এটিসহ স্থানীয় পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৩ চিকিৎসকের নাচের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। ছবি: সংগৃহিত

ধানের মতো সিলেট অঞ্চলের গানেরও খ্যাতি রয়েছে। এই অঞ্চলের অসংখ্য বাউল-বৈষ্ণব সাধক, লোককবি, শিল্পী সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গান ও সংস্কৃতিকে। তাদের গানে উঠে এসেছে এ অঞ্চলের ফসল, প্রকৃতি ও জীবনাচরণ। স্বভাবতই এসেছে এ অঞ্চলের ধানের কথাও।

আরও পড়ুন: ‘নয়া দামানে’ ভাইরাল ঢামেক হাসপাতালের ৩ চিকিৎসক

হবিগঞ্জে জন্ম নেয়া কিংবদন্তি গণসংঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘উজান গাঙ বাইয়া’তে লিখেছেন, ‘অঘ্রাণে আমাদের দেশ ভারী সুন্দর হয়ে ওঠে। ধানের দেশে বাড়ি আমাদের। ধানের গন্ধে বড় হয়েছি। এই ধানই আমায় গান দিয়েছে। এই গানই কৃষক আন্দোলনকে আরও স্ফূরিত করেছিল।’

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই বইয়ে শাইল ধানের বর্ণনাও রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘শালি ধানের মাঠ। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সড়কের মাথার কাছে ঢেউ দুলিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ত ময়না শাইল, কার্তিক শাইল, কালিজিরা, কৃষ্ণচূড়া- কত রকমের ধান। কত বর্ণ, কত গন্ধ। ধানের শিষ টেনে কচি ধানের দুধ বের করে খেতাম। ...আমাদের দেশে আউশ আর শালি ধানের চাষ হতো খুব। মাঝেমাঝে আখের চাষ হতো।’

১৯১২ সালে জন্ম নেয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজের এলাকায় শাইল ধানের খুব চাষ দেখলেও এখন সিলেট অঞ্চলে এই ধরনের ধান হয় না বললেই চলে। শৌখিন কোনো কোনো কৃষক সামান্য পরিমাণে চাষ করছেন। এসব ধান চাষে কৃষি অফিসেরও কোনো উৎসাহ নেই। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের বৈচিত্র্য। হারিয়ে যাচ্ছে সুগন্ধি ধান। কেবল গানেই উল্লেখ থাকছে এসব ধানের, বাস্তবে তা মিলছে না।

শাইল সুনামগঞ্জ অঞ্চলেরই ধান বলে দাবি করেছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন। তিনি বলেন, ‘একসময় ব্যাপক হারে এই ধানের আবাদ হতো। এখন শখের বসে কেউ কেউ এর চাষ করেন। এই ধানের ফলনে দীর্ঘ সময় লাগে এবং ফলন কম হয়, তাই কৃষক বর্তমানে হাইব্রিড ধানের দিকেই ছুটছেন।’

আরও পড়ুন: ‘নয়া দামানের’ উৎসের সন্ধানে

শাইল ধান সুনামগঞ্জে এখন আর তেমন হয় না বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদুল হাসান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক তমিজ উদ্দিন ও মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক কাজী লুৎফুর বারী জানান, এই দুই জেলায় সামান্য পরিমাণে শাইল ধানের আবাদ হয়।

নয়া দামানের সবশেষ কাভারের গায়িকা তোশিবা বেগম। ছবি: নিউজবাংলা

শাইলসহ সুগন্ধি জাতের এসব ধান কেন এখন আগের মতো চাষ হচ্ছে না, এমন প্রশ্নে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা সরকারি চাকরিজীবী দেবল সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই ধান দেরিতে পাকে। উৎপাদনে সময় বেশি লাগে। তখন হাওরে বন্যা হলে ফসল তলিয়ে যায়। এ ছাড়া এটার ফলনও হয় কম। তাই আগের মতো চাষ হয় না। এখন আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল ব্রি ২৮, ২৯ ধানের কারণে এই ধানটা আর চাষ হচ্ছে না।’

একই ধরনের তথ্য জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘শাইল ধান প্রতি বিঘায় দুই থেকে আড়াই মণ হয়। অথচ উচ্চফলনশীল জাতের ধান প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১২ মণ হয়। এ কারণে শাইলসহ ধানের স্থানীয় পুরনো জাতগুলো চাষে কৃষকের আগ্রহ কম। তবে কেউ কেউ শখে সামান্য পরিমাণে এসব ধান চাষ করে থাকেন।’

এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘উৎপাদন কম হলেও এই ধানের চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এ ছাড়া সুগন্ধি জাতের চাল বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।’

আরও পড়ুন: যার কণ্ঠে ভাইরাল ‘নয়া দামান’

ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন জিনবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবেদ চৌধুরী। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থায় গবেষক হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি নিজের এলাকা কুলাউড়ায় নতুন ও হারিয়ে যাওয়া জাতের ধানের উৎপাদন ও প্রসারে কাজ করছেন।

ড. আবেদ মনে করেন, ধানের নতুন জাতের উদ্ভাবন, পুরনো জাতের সংরক্ষণ, গবেষণা ও চাষাবাদকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহ দেয়া হয় না বলে এগুলোর ব্যাপারে সবাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

সিলেট অঞ্চলে আবাদ করা শাইল ধানের ক্ষেত

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত আবেদ চৌধুরী ২০১৭ সালে দেশে অবস্থানের সময় এই প্রতিবেদককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একমাত্র বাংলাদেশেই বিজ্ঞানকে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ধরা হয় না। বিজ্ঞানীরা এখানে বুদ্ধিজীবী নন। আমি ধানের নতুন জাত আবিষ্কার করি, পুরনো জাতকে সংরক্ষণ ও নতুনভাবে চাষ করি; কিন্তু বুদ্ধিজীবী নই। অথচ আমি যদি এসব না করে ধান নিয়ে কবিতা লিখতাম তা হলে আমাকে বুদ্ধিজীবী বলা হতো।’

আরও পড়ুন: ‘নয়া দামান’ কপিরাইট ফ্রি

‘নয়া দামান’ গানে নয়া দামানকে বসানোর জন্য বিছানায় শাইল ধানের খড় বিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে কেন- তার উত্তরও খুঁজেছে নিউজবাংলা।

সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকার বাসিন্দা দেবল সরকার বলেন, ‘এই ধানের খড়গুলো খুব সুন্দর। ক্ষেতে ধান কাটার পরে এই ধানের খড় দেখলে দূর থেকেই চেনা যায়। এটি দীর্ঘ ও বসার জন্য আরামদায়ক।’

একই তথ্য জানিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শাইল ধানের খড় অনেক দীর্ঘ ও সরু। ফলে বসতে আরাম। তাই এই খড় বসার জন্য ব্যবহৃত হয়।’

হাওরাঞ্চলের একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, হাওরে যাত্রাপালা, গানের আসর, পূজাপার্বনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শক-অতিথিদের বসতে দিতে আগে শাইল ধানের খড় ব্যবহৃত হতো।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিউজবাংলার মৌলভীবাজার প্রতিনিধি এমএ হামিদ, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি কাজল সরকার ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি মোসাইদ রাহাত।

এ বিভাগের আরো খবর