হলুদের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) একদল গবেষক। নাম দিয়েছেন বিনাহলুদ-১।
গবেষকদের দাবি, রোগ সহনশীল এই জাতের ফলন প্রচলিত জাতের দ্বিগুণ। সারা দেশের কৃষক নতুন এই জাতের উৎপাদনে নামলে বাজারে হলুদের ঘাটতি থাকবে না। বাজারে সবচেয়ে সস্তা মসলার নামটি হবে হলুদ।
বিনার বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে হলুদ বিপ্লবের অপেক্ষায় আছেন।
হলুদের নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষকদের নেতৃত্ব দেন বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম। সহযোগী গবেষক ছিলেন একই বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু, সাদিয়া তাসমীন, ফরিদ আহম্মেদ ও নাজমুল হাসান মেহেদী।
বিনা জানায়, ভারতের আসামে উৎপাদিত একটি জাত থেকে হলুদের জার্মপ্লাজম আনা হয়। ২০১৭ সালের শুরুতে পুরোদমে গবেষণা শুরু হয়। সংগৃহীত জার্মপ্লাজম বিনার প্রধান কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন উপকেন্দ্রে বাছাই প্রক্রিয়ায় BHL-1 নামক কৌলিক সারি শনাক্ত করা হয়।
সারিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১৯ সালে সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। একই বছর জাতীয় বীজ বোর্ড কৌলিক সারিটিকে বিনাহলুদ-১ নামে নিবন্ধন করে। এখন কৃষক পর্যায়ে হলুদের নতুন জাতটি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
জাতটির সহযোগী গবেষক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন বছর গবেষণা করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি চাষে অধিক ফলন পাবেন কৃষক। জাতটি সারা দেশে কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা এটি চাষাবাদে আগ্রহী হলে বাংলাদেশে হলুদের বিপ্লব ঘটবে।’
বিনাহলুদ-১-এর বৈশিষ্ট্য
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘নতুন জাতে প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৩ টন ফলন হয়। যা প্রচলিত জাতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতে গাঢ় হলুদ ও শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ শতকরা ৩৮ থেকে ৪০ ভাগ। গাছ লম্বা আকৃতির, পাতা গাঢ় সবুজ ও লম্বা। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১২৫ থেকে ১৪৫ সেন্টিমিটার। প্রতি গাছে ছড়ার সংখ্যা ২৫ থেকে ২৮টি। ছড়া ১২ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার চওড়া।
‘এটি পাহাড়ি ও সমতলে চাষ উপযোগী। সেদ্ধ করে শুকালে রঙের পার্থক্য হয় না এবং রান্নায় তিতাভাব থাকে না। লিফব্লচ ও রাইজোম রট রোগসহনশীল। বপনের ৩১০ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়।’
চাষ পদ্ধতি
ড. শামসুল আলম মিঠু চাষাবাদ সম্পর্কে বলেন, ‘চৈত্র (মধ্য মে থেকে মধ্য এপ্রিল) মাস কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে, মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে (বৈশাখের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত) হলুদের কন্দ রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য পরিপুষ্ট, চকচকে ও রোগবালাইমুক্ত কন্দ নির্বাচন করতে হয়।
‘রোপণের ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা আগে ব্যভিস্টিন/স্কোর ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কন্দ ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি থেকে কন্দ তুলে ছায়ায় শুকিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। গাছের ওপরের অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে ফসল সংগ্রহ করা লাগে। ফেব্রুয়ারি ফসল তোলার উপযুক্ত সময়।’
ফলন বাড়ানোর পরিকল্পনা
বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিনাহলুদ-১ জাত নিয়ে নানা পরিকল্পনা রয়েছে। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, নীলফামারী ও পার্বত্য জেলাগুলোতে জাতটি ব্যাপক চাষাবাদের জন্য কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে ফুলবাড়িয়ায় প্রদর্শনী হিসেবে ৫০ শতাংশ জমিতে বিনাহলুদ-১ চাষ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক কৃষককে নতুন জাতটি বিনা মূল্যে দেয়া হয়েছে। কৃষকরা জাতটি একবার চাষে দ্বিগুণ ফলন পেলে প্রতিবার চাষ করবেন। কৃষকদের দোরগোড়ায় জাতটি ছড়িয়ে দিতে পারলে বাজারে সবচেয়ে সস্তা মসলার নাম হবে হলুদ।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, ‘ময়মনসিংহের কৃষকরা কুমারিকা জাতের হলুদ আবাদ করেন। জেলায় গত বছর ১ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে এটি চাষ হয়েছে। এ জাতে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫ থেকে ২০ টন ফলন হয়। বিনাহলুদ-১ উদ্ভাবনের তথ্য কৃষকদের জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিনাহলুদ-১ চাষে প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৩ টন ফলন হলে কৃষকরাই লাভবান হবেন। নতুন এ জাত চাষের আওতায় আনতে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’