বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শালের দ্য সিক্রেট অফ হাউ লাইফ অন আর্থ বিগ্যান অবলম্বনে এই লেখা। এবার থাকছে ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের সমর্থনে নানা দলে ভাগ হয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বিজ্ঞানী দল তাদের নিজস্ব চিন্তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন, কিন্তু বেশির ভাগ যুক্তিই ছিল আকাশকুসুম অনুমানের অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা।
যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ কাজে দিয়েছিল, কিন্তু প্রাণ বিকাশের প্রতিটি সম্ভাবনাময় ধারণা বা অনুমান শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। যে কারণে কিছু গবেষক এবার প্রাণ বিকাশের গবেষণায় আরও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদিনের অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলেন।
প্রাণের উৎপত্তির উৎস সন্ধানে এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার প্রয়াস কয়েক বছর আগে বেগবান হয়। সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বের বহুল চর্চিত ‘আরএনএ প্রথম নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করেছিল’ মতবাদের ওপর কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা আবার একটি বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়ে গেলেন।
পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ঠিক কীভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা তাদের মতবাদের পক্ষে প্রাণের মৌলিক উপাদান আরএনএর গাঠনিক উপাদান নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন। যে কারণে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ মোটেও আরএনএ থেকে হয়নি, এমন ধারণাই করতে লাগলেন লোকে।
ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক জন ডেভিড সুদারল্যান্ড ১৯৮০ সাল থেকে এই সমস্যা অথবা সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জন ডেভিড সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আপনি যদি প্রমাণ করে দেখাতে পারেন, আরএনএ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে সক্ষম, তাহলে সেটা হবে অসাধারণ এক কাজ।‘
কিছুদিন পরেই সুদারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে গবেষণার চাকরি পান। বেশির ভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানই গবেষক দলকে নতুন উদ্ভাবনে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ‘মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি’ কখনও কাজের জন্য চাপ দেয় না। সুতরাং সুদারল্যান্ড কৃত্রিমভাবে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করা এত দুরূহ কেন, সেটা নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন এবং বছরের পর বছর পার করে দিলেন এবং ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে লাগলেন।
এই দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল।
জন সুদারল্যান্ড বলেন, ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট ‘আরএনএ’র কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ঠিকঠাক কাজ করে না। প্রতিটি আরএনএ নিউক্লিওটাইড শর্করা, একটি ভিত্তিমূল এবং ফসফেট দিয়ে তৈরি। কিন্তু গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, আরএনএর মূল উপাদানের সঙ্গে শর্করাকে মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মলিকিউলের বেমানান আকার শর্করাকে মিশতে বাধা দেয়।
সুতরাং সুদারল্যান্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন উপাদান দিয়ে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করার জন্য গবেষণা শুরু করলেন। যথারীতি তার গবেষক দল ভিন্ন ধরনের শর্করা এবং সায়ানাইডের যৌগ সিনামাইডসহ পাঁচটি সাধারণ মলিকিউল দিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।
গবেষক দল উপাদানগুলোকে কয়েক ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করলেন। ফলশ্রুতিতে চারটি আরএনএ নিউক্লিওটাইডের দুটি উৎপন্ন হলো। এই গবেষণা প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, সেই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিল এবং জন ডেভিড সুদারল্যান্ডের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
অনেক পর্যবেক্ষক সুদারল্যান্ডের গবেষণার ফলাফলকে আরএনএ ঘরানার পক্ষে নতুন প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড নিজে ওই পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে একমত ছিলেন না। আরএনএ ঘরানার ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব অনুসারে, প্রথম অণুজীবের ভেতরে প্রাণের সব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিল আরএনএ। কিন্তু সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের সেই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, তাদের মতামত ‘হতাশাজনকভাবে আশাবাদী’। তিনি বিশ্বাস করতেন আরএনএ সেখানে ছিল, কিন্তু তা একমাত্র উপাদান নয়।
সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার তত্ত্ব পরিহার করে সোসটাকের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন। সোসটাক আরএনএ ঘরানার ‘নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে প্রথমে’ এবং ইতালির বিজ্ঞানী পিয়েরে লুইগি লুইজি প্রস্তাবিত ‘কোষের কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই দুই তত্ত্বের সমন্বয় করে মত দিয়েছিলেন দুটো কাজ একসঙ্গেই ঘটেছিল।
তবে সুদারল্যান্ড আরও সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘প্রাণের সবকিছুই প্রথমে, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’।
তিনি চেষ্টা করলেন পারস্পরিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে একবারে স্বয়ং সম্পূর্ণ কোষ সৃষ্টি করতে। তার প্রথম সূত্র ছিল নিউক্লিওটাইডের সংশ্লেষণ সম্পর্কে কিছুটা বেমানান বিবরণ, যেটাকে শুরুতে মনে হয়েছিল ঘটনাচক্রের ফল।
সুদারল্যান্ডের কর্মপ্রক্রিয়ার শেষ ধাপে সুদারল্যান্ড নিউক্লিওটাইডে ফসফেট যুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি গবেষণায় যা পেলেন তা হলো, বিক্রিয়ার শুরুতেই ফসফেট মিশিয়ে দিলে সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল পেতে পারতেন। কারণ, এতে নিউক্লিওটাইডের প্রাথমিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিক্রিয়ার জন্য আগেই ফসফেট যুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয় হলেও কাজটি ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ, কিন্তু সুদারল্যান্ড ঝামেলার মাঝেই দেখতে পেলেন দারুণ সম্ভাবনা।
এ থেকেই সুদারল্যান্ড ভাবতে শুরু করলেন, ফসফেটের মিশ্রণটি ঠিক কতটা জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবীর শৈশবকালে অবশ্যই শত শত রকমের রাসায়নিক উপাদানের একত্রে উপস্থিতি ছিল এবং এদের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল তরল গাঁদ বা কাদামাটির মতো বস্তু এবং সেগুলো যথাসম্ভব পরস্পর বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল।
১৯৫০ সালে স্ট্যানলি মিলার ঠিক একই ধরনের কাদার মিশ্রণ বানিয়েছিলেন। স্ট্যানলি মিলারের কাদার মিশ্রণ ছিল সুদারল্যান্ডের মিশ্রণ থেকেও জটিল ও ঘন। সেই কাদার মধ্যে ছিল অণুজৈবিক মলিকিউল। কিন্তু সুদারল্যান্ড বলেন, ‘কাদার মিশ্রণের মধ্যে প্রচুর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানও মিশে ছিল যাদের বেশির ভাগই অজৈবিক।‘
সুদারল্যান্ডের নতুন গবেষণার অর্থ দাঁড়ায়, মিলারের গবেষণা পদ্ধতি যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিল না। বরং মিলারের গবেষণার প্রক্রিয়া ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ফলে ভালো রাসায়নিক উপাদানগুলো মিশ্রণের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং সুদারল্যান্ড পৃথিবীর আদি অবস্থার সেই ‘গোল্ডিলকস কেমিস্ট্রি’ বের করার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেন, যা এতটা বিশৃঙ্খল নয় যে তা অকেজো হয়ে পড়বে, আবার এতটাও সরল নয় যে তার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে। রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণটিকে যথেষ্ট জটিল হতে হবে যাতে প্রাণের সব উপাদান একই সঙ্গে গঠিত হতে পারে এবং এরপর একসঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
অন্যভাবে বলা যেতে পারে, প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগেকার আমাদের পৃথিবীতে ছিল একটি উত্তপ্ত পুকুরের মতো জলাশয় এবং তা সেভাবেই পতিত অবস্থায় ছিল বছরের পর বছর, রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রাণের বিকাশের জন্য উপযোগী হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর একসময়ে হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রথম প্রাণকোষটি সৃষ্টি হয়ে যায়।
মনে হতে পারে এ তো অসম্ভব, যেমনভাবে মধ্য যুগের অপরসায়নবিদরা বলতেন নানা অলীক গল্প। তবে সুদারল্যান্ডের তথ্য-প্রমাণ কিন্তু ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি দেখাচ্ছেন, একই রাসায়নিক উপাদান, যা তার গবেষণার জন্য দুটো আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করেছিল, তারাই প্রাণের অন্যান্য অণুজীব উপাদান সৃষ্টিতে সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
তাহলে অবশ্যই পরের পদক্ষেপ হবে আরও বেশি আরএনএ নিউক্লিওটাইড তৈরি করা। যদিও তিনি অধিক পরিমাণে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে পারেননি। কিন্তু ২০১০ সালে তিনি প্রায় কাছাকাছি ধরনের অণুজীব সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যেগুলোকে নিউক্লিওটাইডে রূপান্তর করা সম্ভব। একইভাবে ২০১৩ সালে সুদারল্যান্ড অ্যামাইনো অ্যাসিডের মূল উপাদান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যা প্রাণের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। এ পর্যায়ে তিনি গবেষণায় বিক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে আগের রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে কপার সায়ানাইড যুক্ত করে দেন।
সায়ানাইডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাসায়নিক উপাদানে প্রাণের কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রমাণ উঁকি দিয়ে যায় এবং ২০১৫ সালে সুদারল্যান্ড সায়ানাইডযুক্ত রাসায়নিক উপাদান নিয়ে পুনরায় গবেষণা করতে মনোনিবেশ করেন। গবেষণায় তিনি দেখালেন, একই রাসায়নিক মিশ্রণ প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিপিড সৃষ্টিরও পূর্বশর্ত। লিপিড হলো সেই মলিকিউল, যা কোষের দেয়াল তৈরি করে।
সুদারল্যান্ডের সব গবেষণার রাসায়নিক বিক্রিয়া অতিবেগুনি আলোর প্রতিফলনে করা হয় এবং বিক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয় গন্ধক এবং বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহৃত হয় তামা।
জ্যাক উইলিয়াম সোসটাক বলেন, ‘প্রাণ বিকাশের প্রতিটি উপাদান মূলত রাসায়নিক বিক্রিয়ার একটি সাধারণ মর্মস্থল থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।‘
যদি সুদারল্যান্ডের গবেষণা সঠিক হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে ৪০ বছর ধরে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে, সে বিষয়ে যে গবেষণা চলমান সেটা ভুলভাবে চলছিল। কোষের জটিলতা এখন পরিষ্কার হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করছিলেন যে, আদি কোষের উপাদানগুলো পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিল একটি একটি করে।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আরএনএ প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল’- লেসলি ওরগেলের এমন প্রস্তাবনার পরেই আসলে বিজ্ঞানীরা একটি উপাদানকে আরেকটি উপাদানের আগে পেতে চাইলেন এবং এরপর সেটি থেকে আরেকটি উপাদানকে উদ্ভাবন করতে চাইলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড মনে করলেন, প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রাণের সব উপাদান একই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল কি না, সেটা আগে খুঁজে দেখা।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমরা যেটা করলাম সেটা হলো, একই সঙ্গে প্রাণের সব উপাদান সৃষ্টি হওয়াটা অসম্ভব- এই সেকেলে ধারণাকে বাতিল করে দিলাম।‘
প্রাণের সব মৌলিক উপাদানই একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সুদারল্যান্ড।
ফলে সোসটাক এখন সন্দেহ করছেন, প্রাণের অণুজীব উপাদানগুলো সৃষ্টি এবং সেগুলোকে একত্রিত করে জীবন্ত কোষে পরিণত করার যেসব গবেষণা চলছিল, সেসব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় একটি কারণে। গবেষণাগুলো ছিল অতি বেশি মাত্রায় পরিষ্কার। এতদিন বিজ্ঞানীরা শুধু তাদের পছন্দের সামান্য কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়েই গবেষণা করতেন এবং পৃথিবীর প্রথমদিককার পরিবেশে হাজির ছিল এমন অন্যান্য সব রাসায়নিক উপাদানকে গবেষণার বাইরে রেখেছিলেন তারা।
কিন্তু সুদারল্যান্ডের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রাণের উৎস সন্ধানে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াতে আরও কিছু রাসায়নিক উপাদান যোগ করলে বিক্রিয়ার ফলাফলে আরও জটিলতা এবং বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করা সম্ভব।
২০০৫ সালে আদি কোষে আরএনএ এনজাইমের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গিয়ে সোসটাক এ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এনজাইমের দরকার হয়েছিল ম্যাগনেসিয়াম। কিন্তু তা আবার কোষের চারপাশের ঝিল্লির মতো আবরণটা ধ্বংস করে দেয়।
এই সমস্যার সমাধানে অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। একটি নির্ভেজাল ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে ভেসিকল সৃষ্টির বদলে বিজ্ঞানীরা দুটির মিশ্রণ থেকে ভেসিকল সৃষ্টি করলেন। এই নতুন জটিল যৌগের ভেসিকল ম্যাগনেসিয়ামের সঙ্গে টিকে থাকতে পারে এবং তার মানে হলো তারা কার্যকর আরএনএ এনজাইমকেও ধারণ করতে পারবে। প্রথম জিনও সম্ভবত এই জটিলতাকে ধারণ করেছিল।
আধুনিক অণুজীব তাদের জিন বহনের জন্য নির্ভেজাল ডিএনএ ব্যবহার করে। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির সময় সম্ভবত নির্ভেজাল ডিএনএর অস্তিত্ব ছিল না। সে সময় সম্ভবত আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণ ছিল। ২০১২ সালে সোসটাক দেখালেন, আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের এই জটিল মিশ্রণ ‘মোজাইকের’ মতো দেখতে মলিকিউলে একত্রিত হয়েছিলো এবং এর আচার-আচরণ প্রায় খাঁটি আরএনর মতই ছিল। এই আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণের শিকল ভাঁজও হতে পারত।
এ থেকে বোঝা যায় আদি প্রাণকোষ খাঁটি আরএনএ বা ডিএনএ তৈরি করতে পারল কি পারল না, সেটা কোনো সমস্যা ছিল না। সোস্টাক বলেন, ‘আদি কোষে হয়ত আরএনএ সদৃশ কোনো উপাদান ছিল, যা আরএনএর আরও জটিল কোনো সংস্করণ।‘
হয়ত গবেষণাগারে সৃষ্ট টিএনএ এবং পিএনএ-র মতো আরএনএ-র বিকল্প কোনো উপাদানের জন্যও জায়গা ছিল। টিএনএ এবং পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ফলে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ত্ব কখনও ছিল কি না নিশ্চিত নয়। তবে তারা যদি থেকে থাকে তাহলে প্রথম দিককার প্রাণকোষগুলো হয়ত আরএনএ-র পাশাপাশি তাদেরকেও ব্যবহার করেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে আরএনএ দিয়ে- এই ধারণা ঠিক নয়, বরং সেখানে আরএনএ ছাড়াও আরও নানা উপাদান ছিল।
এই গবেষণাগুলোর শিক্ষা হলো যে, আদি প্রাণকোষ সৃষ্টি করে দেখানোর কাজকে এক সময় যতটা কঠিন মনে হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়ত ততটা কঠিন নয়।
কিন্তু একটা সমস্যার সমাধান সুদারল্যান্ড বা সোসটাক কেউই দিতে পারেননি এবং সেটা অনেক বড় একটা সমস্যা। প্রথম প্রাণের অবশ্যই শক্তি উৎপাদনের জন্য যে কোনো ধরনের বিপাক ক্রিয়ার ব্যবস্থা ছিল। যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন, প্রাণকে অবশ্যই শক্তি আহরণ করতে হয় আর নয়ত তা বেঁচে থাকতে পারবে না।
এই ইস্যুতে মাইক রাসেল, বিল মার্টিন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ‘বিপাক ক্রিয়া প্রথমে’ এই তত্ত্বের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করেন সুদারল্যান্ড। তিনি বলেন, ‘আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা যখন বিপাক ক্রিয়া প্রথমে উদ্ভূত হয়েছে- এমন ধারণা পোষণকারী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন, তখন তারা একটা বিষয়ে একমত হন যে, যেভাবেই হোক না কেন, প্রথম প্রাণের উৎপত্তির সময় সেখানে বিপাক ক্রিয়ার উপস্থিতিও থাকতেই হবে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার শক্তির উৎস কী ছিল, সেটাই হলো বড় প্রশ্ন।‘
এমনকি প্রাণের সূচনা সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত খনিজ পানিতে বলে মার্টিন এবং রাসেলের তত্ত্ব যদি ভুলও হয়, তবুও তাদের তত্ত্বের অনেক উপাদান সঠিক। এর মধ্যে একটি হলো- প্রাণের বিকাশে নানা ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
প্রকৃতিতে অনেক এনজাইমেরই কেন্দ্রে একটি ধাতুর অণু পাওয়া যায়। অনেক সময় এই ধাতব অংশটাই এনজাইমের সবচেয়ে সচল এবং কর্মক্ষম অংশ। বাদবাকি অংশ এর সহায়ক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। প্রথমদিকের প্রাণের এckf জটিল এবং উন্নত এনজাইম ছিল না বরং প্রথম প্রাণ সম্ভবত আবরণবিহীন ধাতুকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
জার্মান বিজ্ঞানী গুনটার ভাসটারশাওজার এই বিষয়টির উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, প্রাণের সূচনা হয়েছিল লোহার পাইরাইটের ভেতর। একইভাবে জোর দাবি তোলেন, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানিতে প্রচুর পরিমাণ ধাতব ছিল এবং সেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করত।
এদিকে মার্টিন তার গবেষণায় দেখান, পৃথিবীতে প্রাপ্ত সব প্রাণীর সাধারণ পূর্ব পুরুষ যেই আদি-কোষ তাতে প্রচুর পরিমাণে লোহাভিত্তিক এনজাইম ছিল।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সুদারল্যান্ডের সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো তামা এবং ঘটনাচক্রে গন্ধকের উপর নির্ভর করে, ভাসটারশাওজারও বিক্রিয়াতে গন্ধকের নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং সোসটাকের আদি-কোষের আরএনএ’র জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হয়।
তবুও প্রাণের উৎপত্তির গবেষণায় সমুদ্রের গভীরের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সোসটাক বলেন, ‘আপনি যদি আধুনিক কোষের বিপাক ক্রিয়ার দিকে তাকান তাহলে সেখানে লোহা এবং গন্ধকের মিশ্রিত উপস্থিতি দেখতে পাবেন। যা থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া যায় যে, প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে, যেখানকার পানিতে প্রচুর পরিমাণে লোহা এবং গন্ধক ছিল।
তবে সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশের পানিতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে- এমন ধারণা একটি কারণে ভুল হতে বাধ্য। কেননা গভীর সমুদ্রে কখনো প্রাণের বিকাশ সম্ভব নয়। সুদারল্যান্ড বলেন, আমরা প্রথম প্রাণের যে রসায়নটি উদঘাটন করলাম`, তা কিন্তু অতিবেগুনী রশ্মির ওপর খুবই নির্ভরশীল। আর অতিবেগুনী রশ্মির একমাত্র উৎস হলো সূর্য। ফলে সুর্যের আলো পৌঁছাতে পারে এমন জায়গাতেই প্রাণের উৎপত্তি হতে হবে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে তো তা পৌঁছাতে পারে না।‘
সোসটাক স্বীকার করে নেন, গভীর সমুদ্রে প্রাণের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে অসম্ভবের বিষয় হলো, সমুদ্রের তলদেশ প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে, যেখান থেকে সায়ানাইডের মত প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান যোগ হতে পারে না।
কিন্তু এই সমস্যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা থেকে প্রাণের বিকাশ হয়েছে- এমন তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হতে পারে, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো ছিল সমুদ্রের অগভীর পানিতে যেখানে সূর্যের আলো এবং বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে সায়ানাইড সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
আরমেন মালকিদজানিয়ান বিকল্প একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত সমতল ভূমিতে পুকুরের মতো কোনো অগভীর জলাশয়ে, যেখানে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বের হওয়া লাভা এসে জমা হতো, এমন কোনো স্থানে প্রাণের উৎপত্তি হয়।
আরমেন মালকিদজানিয়ান গভীরভাবে কোষের রাসায়নিক গঠন পর্যবেক্ষণ করলেন- বিশেষত কোন ধরনের রাসায়নিক উপাদানকে কোষ নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় আর কোনোগুলোকে বাইরে রাখে। তিনি দেখলেন, সব ধরনের প্রাণকোষ প্রচুর পরিমাণে ফসফেট, পটাশিয়াম এবং আরও কিছু ধাতব উপাদান ধারণ করে। কিন্তু সেখানে সোডিয়ামের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
আজকের দিনের কোষগুলো পাম্প করার মাধ্যমে কোষের ভেতরে প্রয়োজনীয় উপাদান ঢুকাতে পারে, আবার বাইরে বেরও করে দিতে পারে। কিন্তু আদি প্রাণকোষের এই সুবিধা ছিল না। কারণ, আদি কোষে এমন কাজের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি ছিল না। সুতরাং মালকিদজানিয়ান দাবি করেন, আদি কোষ এমন কোনো স্থানে বিকশিত হয়েছিল, যেখানে আধুনিক কোষগুলোর রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণের মতো মিশ্রণের উপস্থিতিও ছিল।
সুতরাং এখানেই গভীর সমুদ্রে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে- এমন ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রতিটি কোষ অতি উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম এবং ফসফেট এবং খুব অল্প পরিমাণ সোডিয়াম বহন করে। অথচ সমুদ্রের পানিতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি।
এ থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, সমুদ্রের তলদেশে থাকা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এই তত্ত্ব ঠিক নয়। তার বদলে বরং ভূ-পৃষ্ঠের কোনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরির পাশের অগভীর গরম জলাশয়ে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে বললে সেটাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। এমন জলাশয়েই দেখা যায় তেমন পরিবেশ ঠিক যেমনটা প্রাণ বিকাশের জন্য দরকার। কারণ, এমন জলাশয়েই পাওয়া যায় সেসব ধাতব উপাদানের সমস্ত মিশ্রণ যেগুলো আধুনিক কালের প্রাণকোষে দেখা যায়।
সোসটাক নিজেও এমন দৃশ্যের ভক্ত। তিনি মজা করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার মনে হয় আমার প্রিয় দৃশ্য হতে পারে সমতল ভূপৃষ্ঠে সক্রিয় কোনো আগ্নেয়গিরি এলাকার অগভীর হ্রদ বা পুকুর। সেখানে হয়ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে গরম তরল প্রবাহ আছে, কিন্তু সেগুলো গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরি নয়, বরং আমেরিকার মনটানা এবং আইডাহো প্রদেশের ইয়েলোস্টোন পার্কের অগভীর জলাশয়ের তলদেশে থাকা জ্বালামুখের মতো।‘
সুদারল্যান্ড প্রস্তাবিত প্রাণ সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভবত এ রকম পরিবেশেই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। বসন্তকালেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের মেলবন্ধন ঘটে। কারণ, তখন পানির স্তর কমে যায় এবং কিছু স্থান শুকিয়ে যায় এবং সেখানে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পড়ে।
এছাড়া সোসটাক বলেন, ‘অগভীর হ্রদ বা জলাশয়ই হতে পারে আদি প্রাণকোষের উৎপত্তির জন্য উপযুক্ত স্থান। যেখানে আদি প্রাণকোষ বেশিরভাগ সময় অপেক্ষাকৃত শীতল ছিল। আর এই পরিবেশ আরএনএর প্রতিলিপি সৃষ্টি এবং অন্যান্য সরল বিপাক ক্রিয়ার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু ওই পরিবেশেই মাঝে-মধ্যেই আদি কোষ কিছুটা সময়ের জন্য উত্তপ্ত হত, যার ফলে আরএনএ সূতাগুলো আলাদা হয়ে যেত এবং পরের ধাপে প্রতিলিপি সৃষ্টি করার জন্য তৈরি হয়ে যেত। সেই অগভীর জলাশয়ে গরম পানির স্রোত ছিল। ফলে সেখানে হয়ত বিদ্যুৎশক্তি তৈরি হতো যা আদি কোষগুলোর বিভাজনে সাহায্য করত।
তবে সুদারল্যান্ড প্রাণের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে তৃতীয় একটি সম্ভাবনার প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, ‘উল্কা পতনের স্থানগুলোতেও প্রাণের বিকাশ হতে পারে।‘
পৃথিবীর জন্মের পর প্রথম ৫৫ কোটি বছর ধরে শুধু এতে উল্কাপাত ঘটেছিল এবং আমরা এখনও মাঝে মাঝে উল্কা পতন দেখতে পাই। বড়সড় একটি উল্কার আঘাতে সমতলে সৃষ্টি হতো বিশালাকার গর্ত। গর্তে পানি জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় সেখানেই হয়ত দেখা দেয় আরমেন মালকিদজানিয়ানের প্রস্তাবিত প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ।
প্রথমত, উল্কাপিণ্ডগুলো প্রধানত ধাতব উপাদানে তৈরি ছিল। সুতরাং উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গর্তে বিপুল পরিমাণ লোহা এবং গন্ধকের উপস্থিতি থাকার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উল্কার আঘাতে এবং অতি উচ্চ তাপে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পাথরের আবরণ গলে গিয়েছিল। যার ফলে পাথরে ফাটল ধরে ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো সৃষ্টি হয় এবং পানি গরম হয়।
সুদারল্যান্ড কল্পনা করেন, ছোট ছোট নদী এবং পানির প্রবাহ উল্কার আঘাতে সৃষ্ট খাড়ির ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে, আর পাথর থেকে বয়ে আনছে সায়ানাইডভিত্তিক রাসায়নিক, আর উপর থেকে সূর্য ঢালছে অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ। প্রতিটি স্রোতেই ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণ আছে ফলে প্রতিটি স্রোতের মিলনে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে এবং এভাবে সময়ের হাত ধরে জলাধারে উৎপাদিত হচ্ছে প্রথম প্রাণের আধার।
সবশেষে ওই স্রোতগুলো সেই গর্তের তলদেশে প্রায় সমুদ্রের তলদেশের মতো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো জলাশয় বা পুকুরে গিয়ে মিলিত হচ্ছে। এমন কোনো একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার পুকুরেই হয়ত প্রথম প্রাণকোষটি এর সবগুলো উপাদানসহ সৃষ্টি হয়।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘এটা প্রাণ সৃষ্টির খুবই সুবিন্যস্ত একটি দৃশ্য।’
পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভিত্তিতেই এই দৃশ্যটি কল্পনায় আঁকলেন তিনি। বললেন, ‘এই দৃশ্যটাই একমাত্র দৃশ্য যা কেউ রসায়নের সূত্র অনুযায়ী কল্পনা করতে পারেন।‘
সোসটাক কিন্তু কোনোটার সঙ্গেই পুরোপুরি একমত পোষণ করলেন না। তবে তিনি বললেন, সুদারল্যান্ডের তত্ত্ব গভীর মনোযোগের দাবিদার।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গভীর খাদের দৃশ্যকল্পটি বেশ সুন্দর। সেখানে জমা হওয়া রাসায়নিক মিশ্রিত পানিতেও হয়তো প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব। একই সঙ্গে আমি এও মনে করি যে, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশেও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে। দুটি বিতর্কের স্বপক্ষেই প্রচুর যুক্তি আছে।‘
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞান সভার বিতর্ক এবার যুক্তির লড়াইয়ের মঞ্চের মতো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু মনে হয় না কোনো পক্ষই দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। সিদ্ধান্ত হবে রসায়ন এবং আদি কোষের বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে। তবে এই দুটো স্থানের কোনো একটিতে যদি প্রাণ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর কোনো একটি উপস্থিত ছিল না বলে প্রমাণ হয়, তাহলে সেটি প্রাণের সম্ভাব্য উৎপত্তি স্থলের মর্যাদা হারাবে এবং অপরটি গৃহীত হবে।
এই বিতর্কের ইতিবাচক দিক হলো, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম দীর্ঘদিন ধরে চলমান পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্কের একটি ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখতে যাচ্ছি আমরা। সুদারল্যান্ড বলেন, ‘প্রাণের উৎপত্তির রহস্যটি এখন আরও বেশি সমাধানযোগ্য মনে হচ্ছে।’
তবে সোসটাক এবং সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত ‘প্রাণের সবকিছু একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব এখনও অসম্পুর্ণই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এটি আমাদের সামনে শুধুই একটি রেখাচিত্রের মতো একটি আখ্যান উপস্থাপন করে মাত্র। তবে এই দুই বিজ্ঞানীর পদক্ষেপগুলো বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল দিয়ে সমর্থিত।
‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত সবগুলো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সমন্বয়ও সাধন করে। এটি অন্যান্য প্রতিটি তত্ত্বের ইতিবাচক দিকগুলোকে একই সূতায় বাঁধার চেষ্টা করে এবং একই সঙ্গে সেগুলোর সমস্যাগুলোও সমাধানের চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব রাসেলের সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানির স্রোতের এলাকায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল- সেই তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে না। বরং সেটার সবচেয়ে ভালো দিকগুলোকে গ্রহণ করে নেয়।
আমরা আসলে কখনই পুরপুরি নিশ্চিত করে জানতে পারব না ৪০০ কোটি বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল। মার্টিন বলেন, ‘যদি কৃত্রিমভাবে এখন আদি পৃথিবীর সেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং এসচেরিচিয়া কোলি নামের ব্যাকটেরিয়া উঁকি দেয় অন্য প্রান্তে, তবুও প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে আমরা (প্রাণ) ওভাবেই আবির্ভূত হয়েছিলাম।
‘আমরা সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হলো, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে, তার একটা সঙ্গতিপূর্ণ চিত্রকল্প আঁকতে পারি। গবেষণাগারে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়াভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়, আদি পৃথিবী সম্পর্কে আমরা যেসব তথ্য জানতে পেরেছি এবং জীব বিজ্ঞান প্রাণের সবচেয়ে প্রাচীন গঠন সম্পর্কে যা কিছু উদঘাটন করেছে, সেসবের ভিত্তিতেই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত এই চিত্রকল্পটি তৈরি করতে হবে।’
অবশেষে, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নানা গবেষণা প্রচেষ্টার পর পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্প দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
তার মানে, আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক বিভক্তির কাছাকাছি চলে আসছি। বিভক্তিটি হলো: একদল মানুষ যারা প্রাণের যাত্রা শুরুর কাহিনি জানে, আর অপর একদল যারা তা কখনই জানতে পারেনি।
১৮৫৯ সালে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের আগে যারা মারা গেছে, তাদের প্রতিটি মানুষ নিজেদের প্রকৃত উৎসের ইতিহাস না জেনেই মরে গেছে। কারণ, তারা কেউ বিবর্তনের বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানত না। কিন্তু বর্তমান কালের সকল জীবিত মানুষ, কিছু বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বাদে, চাইলেই প্রাণী জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তথা আত্মীয়তার বিষয়টি জানতে পারবে।
অনুরূপভাবে ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিনের পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর যারা জন্মেছে, তারা এমন একটা সমাজে বসবাস করছে, যে সমাজ মহাবিশ্বে ভ্রমণ করছে। এমনকি আমরা যদি কখনও সশরীরে মহাশূন্যে নাও যাই, তবুও মহাকাশ ভ্রমণ একটি বাস্তব সত্য। বিভিন্ন নভোযান কিন্তু ঠিকই বাস্তবে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই বাস্তব সত্য ঘটনাগুলো দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী আমুল বদলে দিচ্ছে। আমাদেরকে আরও বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞ করে তুলছে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আমাদেরকে এবং সব প্রাণকেও আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সংরক্ষণের শিক্ষা দেয় ও তাগিদ যোগায়। কেননা তারাও আমাদের মতোই।
মানুষসহ প্রাণিজগতের সব জীবই একই আদি প্রাণ থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বিবর্তনবাদ আমাদেরকে প্রতিটি প্রাণীকে মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছে। কারণ, মানুষ জানতে পেরেছে সব প্রাণীই তাদের দূর সম্পর্কের বা নিকটাত্মীয়। মহাকাশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্বকে দূর থেকে সার্বিকভাবে দেখত পারি এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারি; যা থেকে আমরা আমাদের পৃথিবীর অনন্যতা এবং তা যে কতটা ভঙ্গুর ও অসহায় তাও উপলব্ধি করতে পারি।
পৃথিবীতে আজ যারা জীবিত আছে তাদের মাঝে কিছু মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সততার সঙ্গে বলতে পারবে কোথা থেকে তারা এসেছে। মানুষ জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষ কে এবং কোথায় ছিল তার বসবাস।
এই জ্ঞান আমাদের আমূল বদলে দেবে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা হয়তো জানতে পারব কীভাবে মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং কোথায় তাকে খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে এ থেকে আমরা প্রাণের মর্মগত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট সম্পর্কেও জানতে পারব। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির পর, কীভাবে জন্ম নিল প্রাণের প্রজ্ঞা- সে সম্পর্কে আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানতে পারিনি।
লেখক: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:রাজধানী ঢাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মহাকাশ অভিযাত্রার গল্প শোনালেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর প্রধান নভোচারী জোশেফ এম আকাবা। কথা ও গল্পে শিক্ষার্থীদের সামনে মহাশূন্যের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এই যশস্বী মহাকাশচারী।
রোববার ‘ফ্রম আর্থ টু অরবিট: অ্যান অ্যাস্ট্রোনাটস টেল’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অসীম শূন্যতায় কাটানো সময়ের গল্প ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন নাসার এই নভোচারী।
জোশেফ এম আকাবা একজন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী, যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং একজন শিক্ষক। তিনি অনেক বার মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন। তিনি এখন পর্যন্ত মোট ৩০৬ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন। এছাড়াও তিনি দুবার মহাকাশে হাঁটার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
‘ফ্রম আর্থ টু অরবিট: অ্যান অ্যাস্ট্রোনাটস টেল’ অনুষ্ঠানটি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাসার একজন দক্ষ মহাকাশচারীর বাস্তব অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ করে দিয়েছে। এই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নাসার বিভিন্ন মিশন সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ পেয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে জোশেফ এম আকাবা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মহাকাশে থাকাকালীন বিভিন্ন বিষয়, মহাকাশ অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক বিস্ময়সহ এসটিইএম (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিক্স) শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ডাটা অ্যান্ড সায়েন্সেস-এর ডিন প্রফেসর মাহবুবুল আলম মজুমদার। আরও বক্তব্য দেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পাবলিক ডিপ্লোমেসি সেকশনের পাবলিক এনগেজমেন্ট-এর ডিরেক্টর স্কট ই. হার্টম্যান।
নাসার প্রধান মহাকাশচারী তার বক্তব্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেকেই আমাকে বলেছেন যে আমি তাদের অনুপ্রেরণা। কিন্তু আপনাদের মাঝে আসতে পেরে আমি নিজেই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আপনাদের জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণা আমাকে অভিভূত করেছে।’
নভোচারী আকাবা তার বক্তব্যে শিক্ষার্থীদেরকে লেখাপড়ায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে বলেন। তিনি বলেন, ‘একমাত্র লেখাপড়ার মাধ্যমেই নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব।’
মহাকাশ গবেষণায় আগ্রহীদের তিনি নাসার ওয়েবসাইট ভিজিটের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘যারা মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাদের উচিত নাসার ওয়েবসাইটটা ফলো করা। কারণ সেখানে অসংখ্য সুযোগ এবং পরামর্শ রয়েছে।’
জোশেফ আকাবা শিক্ষার্থীদের ভুলকে ভয় না পাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘ভুলকে ভয় পেলে চলবে না। ভুল মানুষকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।’
তিনি শিক্ষার্থীদেরকে নিজ জীবন ও চ্যালেঞ্জের গল্প বলেন এবং কীভাবে সেই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছে সেসব তুলে ধরেন।
সুন্দর এই পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে নাসার প্রধান নভোচারী বলেন, ‘আমাদের এই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। মহাশূন্যে একটিমাত্র ভুল পদক্ষেপ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। আমাদের পৃথিবীতে তেমনটা হয় না। আমার মনে হয় না এখন পর্যন্ত আর কোনো গ্রহ মানুষের বসবাস উপযোগী। তাই এই পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত।’
নাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আকাবা বলেন, ‘নাসার লক্ষ্য হলো অজানা সীমানার বাইরে অনুসন্ধান চালানো। একসঙ্গে কাজ করলে আমরা অনেকদূর যেতে পারব। এজন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
মহাকাশ নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের কৌতূহল আর উচ্ছ্বাস দেখে আকাবা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, অচিরেই এই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ নাসার আর্টেমিস স্কোয়াডে অংশ নেবেন।’
পুরো অনুষ্ঠানে আকাবা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অফিস অফ কমিউনিকেশন্স-এর ডিরেক্টর খায়রুল বাশার।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। তিনি তার বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের মহাকাশ গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি মহাকাশচারীদের তালিকায় একদিন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের নাম থাকবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পাবলিক ডিপ্লোমেসি সেকশনের পাবলিক এনগেজমেন্ট-এর ডিরেক্টর স্কট ই. হার্টম্যান, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিএসআরএম স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিন প্রফেসর আরশাদ এম চৌধুরী, ডিপার্টমেন্ট অফ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চেয়ারপারসন প্রফেসর সাদিয়া হামিদ কাজীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ।
আরও পড়ুন:বন্য খেজুর থেকে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ভিনেগার উৎপাদনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনিছুর রহমান মজুমদার ও তার গবেষক দল।
বন্য খেজুর থেকে ভিনেগার তৈরি বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক।
গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, ‘বন্য খেজুর থেকে ভিনেগার উৎপাদনে প্রক্রিয়াকরণের জন্য গাজন প্রক্রিয়াটি পরিবেশবান্ধব। স্থানীয় কৃষিসম্পদ কাজে লাগিয়ে এবং অপচয় কমিয়ে এ পদ্ধতি খাদ্য উৎপাদনের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতেও সহায়ক হতে পারে। গবেষণাটি বাংলাদেশের বৃহত্তর টেকসই উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’
উৎপাদিত ভিনেগারটির দেশের বাজারে প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক আনিছুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এই গবেষণার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভিনেগার উৎপাদন কেবল খাদ্য ও পানীয় হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্যাকেজিং, কসমেটিক ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পেও ব্যবহৃত হতে পারে।
‘বিশেষ করে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের কাছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পুষ্টিকর ভিনেগারের চাহিদা বাড়ছে, যা বাজারে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।’
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় কৃষি সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আনিছুর বলেন, ‘বাংলাদেশে বন্য খেজুর ইদানীং ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এটি বেশ সস্তা ও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য।
‘এই খেজুর গাছ সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় এবং রাস্তার পাশের জমিতে পাওয়া যায়, তবে নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও এই বন্য খেজুর দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অব্যবহৃত একটি সম্পদ।’
গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আনিছুর বলেন, ‘বন্য খেজুরের রস ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া মাধ্যমে ভিনেগারে পরিণত করা হয়েছে। এ গবেষণায় এক ধরনের ইস্ট ব্যবহার করে ওই রসে অ্যালকোহল তৈরি করা হয় এবং পরে অ্যাসিটোব্যাক্টর প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া দিয়ে অ্যালকোহলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে রূপান্তর করা হয়।’
গবেষক আরও বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে যে, রসের ঘনত্ব যত বেশি হয়, তত বেশি অ্যালকোহল ও অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি পায়। বেশি ঘনত্বের রসটি সবচেয়ে ভালো পুষ্টিগুণ, অ্যাসিডিটি ও ম্যাক্রো মিনারেলস (পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম) সমৃদ্ধ হয়। তাই এটি স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পণ্যও বটে।’
গবেষণাটি বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা এলসভিয়ারের নামী সাময়িকী অ্যাপ্লায়েড ফুড রিসার্চে সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।
ভিনেগার তৈরির এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও মাঠ পর্যায়ে সফলতা সম্পর্কে এ অধ্যাপক বলেন, ‘এই গবেষণা স্থানীয় কৃষকদের জন্য একটি নতুন আয় সৃষ্টির পথ খুলতে পারে। একদিকে খেজুর থেকে তৈরি ভিনেগারের উচ্চমান এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের স্থানীয় কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে।’
অধ্যাপক আনিছুর রহমানের নেতৃত্বে বাকৃবি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) আরও ছয় জন গবেষক এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। বাকৃবি থেকে গবেষক দলে রয়েছেন ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলিম, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. পলি কর্মকার এবং ওই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা ও আ ন ম ইফতেখার আলম।
এ ছাড়া সিকৃবির খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফাহাদ জুবায়ের এবং ডুয়েটের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক লোপা আনসারী গবেষক দলে যুক্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন:মানব বসতির পৃথিবী, সূর্য ও বৃহস্পতি গ্রহ একই সরলরেখায় অবস্থান করবে আগামীকাল শনিবার। এদিন সারারাত বৃহস্পতি আকাশে দৃশ্যমান থাকবে। এই অবস্থানকে বলা হয় ‘জুপিটার্স অপজিশন’। এমন বিরল মহাজাগতিক ঘটনা সৌরজগতের রহস্য ও সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের কৌতূহলকে বাড়িয়ে দেয়।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, শনিবার বৃহস্পতিকে দেখার জন্য এই সময়ের আগে-পরে এক মাস ধরে এই বিস্ময়কর ঘটনা পর্যবেক্ষণের সুযোগ থাকবে। এমনকি একটি ছোট টেলিস্কোপ বা সাধারণ দূরবীন দিয়েও এই গ্রহের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, শুক্রবার পৃথিবী থেকে প্রায় ৬১১ মিলিয়ন কিলোমিটার বা ৩৮০ মিলিয়ন মাইল দূরে থাকবে বৃহস্পতি। এই দূরত্বে বৃহস্পতিকে বেশ উজ্জ্বল দেখাবে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বিশ্বের বৃহত্তম প্রবালের সন্ধান পেয়েছেন একদল গবেষক। সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কাছে তিনশ’ বছরেরও বেশি পুরনো প্রবালটি খুঁজে পান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ভিডিওগ্রাফার মানু সান ফেলিক্স। দৈর্ঘ্যে ১১১ ফুট ও প্রস্থে ১০৪ ফুট প্রবালটির আকার একটি পূর্ণবয়স্ক নীল তিমির চেয়েও বড়।
ধারণা করা হচ্ছে, এক বিলিয়নের বেশি ক্ষুদ্র প্রাণী ও জলজ অণুজীবের উপস্থিতি রয়েছে প্রবালটিতে। এর মাধ্যমে জলজ প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
তিনশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল এই বিশাল প্রবাল। সদ্য আবিষ্কৃত এই জলজ বিস্ময়টি এখন পর্যন্ত জানা বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক প্রবাল বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
কোরাল বা প্রবাল এক ধরনের সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী। বছরের পর বছর ধরে একসঙ্গে থাকতে থাকতে, পুঞ্জিভূত হয়ে গঠিত হয় বিশাল প্রবাল প্রাচীর। সঙ্গে যুক্ত হয় শৈবাল, মৃত জলজ প্রাণীর দেহাবশেষ ও পলিপ। সব মিলিয়ে জীবন্ত প্রাণীর তৈরি এক আশ্চর্য স্থাপনা এই প্রবাল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক জীব-বৈচিত্র্য। আজারবাইজানের বাকুতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ এর মধ্যেই, সমুদ্র তলদেশের অবস্থা পর্যালোচনা করতে বৈজ্ঞানিক অভিযান চালায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।
অনেকটা দৈবক্রমেই প্রবালটি আবিষ্কার করেন ন্যাট জিও’র ভিডিওগ্রাফার মানু সান ফেলিক্স। সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কাছে স্বচ্ছ পানিতে ছেলেকে নিয়ে ডুব দেন তিনি। প্রথমে এটিকে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ মনে করে এগিয়ে গেলেও পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর বুঝতে পারেন জীবন্ত প্রাণীদের তৈরি অসামান্য সৌন্দর্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি।
গবেষকদের ধারণা, বিশ্বের বৃহত্তম জলজ প্রাণী নীল তিমির চেয়েও আকারে অনেকটা বড় এই প্রবাল।
এতোদিন যুক্তরাষ্ট্রের সামোয়াতে থাকা ‘বিগ মামা’ প্রবালটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছিল। তবে নতুন সন্ধান পাওয়া প্রবালটি ‘বিগ মামা’র চেয়েও প্রায় তিন গুণ বড়। ৩৪ মিটার দীর্ঘ প্রবালটি এতটাই বিশাল যে ধারণা করা হচ্ছে, মহাকাশ থেকেও দেখা যাবে এটি।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) মুনীরা সুলতানা।
এ নিয়োগ দিয়ে সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর ১৯৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আসে।
জাদুঘরটি বাংলাদেশের একমাত্র বিজ্ঞান জাদুঘর এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করে ২০২৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন রসায়নবিদ।
নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটে বুধবার জানানো হয়, এ বছর তিন গবেষকের মধ্যে একজনকে পুরস্কারের অর্ধেক এবং বাকি দুজনকে অর্ধেক দেয়া হয়েছে।
সাইটে উল্লেখ করা হয়, কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইন নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে ডেভিড বেকারকে। অন্যদিকে প্রোটিনের কাঠামো নিয়ে পূর্বাভাসের জন্য ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন এম. জাম্পারকে এ পুরস্কারের অর্ধেক দেয়া হয়।নো হ বু এ
তিন গবেষকের মধ্যে হ্যাসাবিস ও জাম্পার জ্ঞাত প্রায় সব প্রোটিনের কাঠামো নিয়ে পূর্বাভাস দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) সফলভাবে কাজে লাগান। অন্যদিকে ডেভিড বেকার প্রোটিনের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নতুন কিছু প্রোটিন উদ্ভাবন করেন।
পদার্থবিজ্ঞানে এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষক জন জে. হপফিল্ড ও কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির গবেষক জেফরি ই. হিন্টন।
সুইডেনের স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিট) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করে রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি।
নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, কৃত্রিম স্নায়বিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিংকে সক্ষম করা মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে জন জে. হপফিল্ড ও জেফরি ই. হিন্টনকে।
এতে উল্লেখ করা হয়, হপফিল্ড একটি কাঠামো নির্মাণ করেন, যেটি তথ্য মজুত ও পুনর্নির্মাণ করতে পারে। অন্যদিকে হিন্টন এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যা ডেটাতে স্বতন্ত্রভাবে প্রোপার্টি আবিষ্কার করতে পারে। বর্তমানে ব্যবহৃত বৃহদাকার স্নায়বিক নেটওয়ার্কের জন্য এ উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে ১৯০১ সাল থেকে। আজকের আগে ১১৭ জন এ পুরস্কার পান।
এ শাস্ত্রে সবচেয়ে কম ২৫ বছর বয়সে নোবেল পান লরেন্স ব্র্যাগ, যিনি ১৯১৫ সালে পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি ৯৬ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পান আর্থার অ্যাশকিন। তিনি ২০১৮ সালে পুরস্কারটি পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য