টোকিও অলিম্পিকসের এবারের আসরটি শুরু থেকেই ছিল নানা বিপত্তির মুখে। করোনাভাইরাসে এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার পরও নিশ্চিত হচ্ছিল না গেমসের ভাগ্য। জাপানে ক্রমাগত বাড়তে থাকা করোনা সংক্রমণ শঙ্কায় ফেলে দেয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরকে।কোয়ারেন্টিন, মাস্ক ব্যবহার, দর্শকশূন্য গ্যালারির বিধিনিষেধের মুখে কম্পিত হৃদয়ে ও দুরুদুর বুঁকে জাপান শুরু করে অলিম্পিকসের ৩২তম আসর।শুরুর মুহূর্ত থেকে উবে যায় সব ভয়, আতঙ্ক ও শঙ্কা। বিশ্বসেরা অ্যাথলিটদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে টোকিও ও অলিম্পিকস ভিলেজ। সেরাদের সেরা ক্রীড়া তারকা বিশ্বজুড়ে দর্শকদের চলমান ভয়াবহ পরিস্থিতি ভুলিয়ে রাখেন নিজেদের দক্ষতার মাধুরী দিয়ে।চীনের শুটার চিয়ান ইয়াংয়ের প্রথম দিনে জয় করা প্রথম স্বর্ণ থেকে শুরু করে শেষ দিন পুরুষদের ওয়াটার পোলোতে জেতা সার্বিয়ার শেষ স্বর্ণ পর্যন্ত পুরো বিশ্ব বুঁদ হয়ে ছিল অলিম্পিকসের মোহনীয়তায়।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ জাপানকে অলিম্পিকস সফলভাবে আয়োজনের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এবারের অলিম্পিকস এতটা ভালো হবে আশা করেননি তিনি।বাখ বলেন, ‘অলিম্পিকস থেকে যখন দর্শকদের বাদ দেওয়া হলো তখন ভেবেছিলাম একটা প্রাণহীন আসর হতে যাচ্ছে। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর বোঝা যায়নি যে দর্শক নেই। অ্যাথলিটদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও একাগ্রতা প্রাণ ফিরিয়ে দেয় অলিম্পিকসে।’বরাবরের মতোই সুইমিং, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ও জিমন্যাস্টিকস নিয়েই আলোচনা হয়েছে বেশি। কিন্তু চমক হিসেবে ছিল নতুন দুই ইভেন্ট সার্ফিং ও স্কেটবোর্ডিংয়ের দর্শকপ্রিয়তা।বিশেষ করে জাপানের ১৩ বছরের খুদে স্কেটবোর্ডার মোমিজি নিশিয়া স্বর্ণ জয় করে জিতে নেয় সবার হৃদয়।
১৩ বছর বয়সী মোমিজি নিশিয়া জেতেন স্কেটবোর্ডিংয়ের স্বর্ণ। ছবি: এএফপিঅলিম্পিকসের কুইন ইভেন্ট ১০০ মিটারের রাজা হন ইতালির মার্সেল জ্যাকবস। নারী এককে অবিশ্বাস্য স্প্রিন্ট ডাবল জেতেন জ্যামাইকার সুপারস্টার এলেইন টমসন।
জ্যামাইকার এলেইন টমসন জেতেন স্প্রিন্ট ডাবল। ছবি: এএফপিসাঁতারের পুলের দখল নিয়ে নেন যুক্তরাষ্ট্রের কেলিব ড্রেসেল। আসরের সর্বোচ্চ ৫টি স্বর্ণ জেতেন এই চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু। অস্ট্রেলিয়ার সাঁতারু এমা ম্যাককিওন পুল থেকে ৪টি স্বর্ণ জিতে হয়েছেন সেরা নারী অ্যাথলিট।বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত জেতে অলিম্পিকস আসরে তাদের দ্বিতীয় ব্যক্তিগত স্বর্ণ। জ্যাভেলিন থ্রোয়ার নিরাজ চোপড়া স্বর্ণ জিতে বনে যান ১৩০ কোটি ভারতীয়ের চোখের মনি।
আমেরিকার ক্যালিব ড্রেসেল জিতে নেন সর্বোচ্চ ৫টি স্বর্ণ। ছবি: এএফপিএকই সঙ্গে ৭১ হাজার জনসংখ্যার দেশ বারমুডার হয়ে স্বর্ণ জয় করে রেকর্ডের জন্ম দেন ফ্লোরা ডাফি। ট্রায়াথলনে স্বর্ণ জেতেন ডাফি। এ ছাড়া ৩২ হাজার জনসংখ্যার দেশ সান মারিনোর শুটার আলেসান্দ্রা পেরিল্লি জেতেন ব্রোঞ্জ।অঘটনও কম হয়নি আসরে। নোভাক জকোভিচ, নেওমি ওসাকার মতো বিশ্বসেরা তারকারা জ্বলে উঠতে পারেননি অলিম্পিকসের আসরে। সবচেয়ে বেশি আলো ছিল যে তারকার ওপর, সেই সিমোন বাইলস নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন জিমন্যাস্টিকসের ৫টি ফাইনাল থেকে।মানসিক চাপের কারণে অবসাদগ্রস্ত এই আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন রিওতে ৪টি স্বর্ণ জিতলেও এবারে একটি ব্রোঞ্জ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে।
বাধা পেরিয়ে এবারই প্রথম অলিম্পিকসে দেখা গেছে দুই ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলিটকে। নিউজিল্যান্ডের ভারোত্তলক লরেল হুবার্ড পদক না পেলেও প্রথম ট্রান্সজেন্ডার অলিম্পিয়ান হিসেবে জায়গা নেন ইতিহাসের পাতায়।
আর কানাডার ফুটবল খেলোয়াড় কুইন প্রথম ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলিট হিসেবে দলের সঙ্গে জিতে নেন স্বর্ণ। সব মিলিয়ে শেষ দিনে স্বর্ণ জয়ের দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই স্পোর্টিং সুপার পাওয়ারের জমে ওঠা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই প্রায় প্রতিটি ইভেন্টেই উপভোগ করেন দর্শকরা।
অলিম্পিকস পদক তালিকা।৩৯টি স্বর্ণ জিতে সেরা দল হিসেবে আসর শেষ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ৩৮ স্বর্ণ নিয়ে দুইয়ে আছে চীন। স্বাগতিক জাপান ২৭টি স্বর্ণ নিয়ে দখল করে তৃতীয় স্থান। ২২টি স্বর্ণ জিতে ব্রিটেন হয় চতুর্থ।২০ স্বর্ণজয়ী রাশিয়া শেষ করে পাঁচ নম্বরে থেকে। আর পুলে রাজত্ব করা অস্ট্রেলিয়া ১৭টি স্বর্ণ জিতে আছে ছয় নম্বরে। অজিদের ১৭টি স্বর্ণের ৯টিই এসেছে সুইমিং থেকে।
আর্চারির তৃতীয় রাউন্ডে খেলেন বাংলাদেশের রোমান সানা। ছবি: সংগৃহীতএতসব পদকের ভিড়ে বাংলাদেশের জন্য আসরে এবারও ছিল অংশগ্রহণের সান্ত্বনা। রোমান সানা, দিয়া সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ হেল বাকী, আরিফুল ইসলাম, জুনায়না আহমেদ ও জহির রায়হান বিশ্ব মঞ্চে উঁচিয়ে ধরেছেন লাল-সবুজের পতাকা।কোনো পদক না জিতলেও বাকী ছাড়া সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সকে ছাড়িয়ে গেছেন টোকিওতে।সব শেষে আশা, আলো ও শান্তির বার্তা দিয়েই বিদায়ের সুর টোকিও মহাযজ্ঞে। বিকেলে প্যারিসে পরবর্তী আসরকে স্বাগত জানিয়ে আসরের আনুষ্ঠানিক পর্দা নামবে সমাপনী অনুষ্ঠানে।