আসছে সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতা। আসরে অংশ নিতে আবেদন করেছেন দেশসেরা বডিবিল্ডাররা। এদেরই একজন নূর কবির।গেল মাসেই ব্রিসবেন রাজ্যে বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতা জেতা নূর প্রস্তুতি নিচ্ছেন মহাদেশের সবচেয়ে বড় আয়োজনের।অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা উঠতি বডিবিল্ডার নূরের গল্পটা একেবারেই অন্যরকম। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠার কোনোটাই অস্ট্রেলিয়ায় নয়।৯ বছর আগে নৌকায় চেপে অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখেন ১৬ বছরের রোহিঙ্গা কিশোর নূর কবির। তারপর থেকে শুরু তার জীবন বদলের সংগ্রাম। দুই বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকার পর পান ব্রিজিং ভিসা।নূর ছোটখাটো কাজ পান অস্ট্রেলিয়ায়। এভাবে কেটে যায় পাঁচ বছর। কাজের ফাঁকে নিয়মিত জিমে যেতেন তিনি।
একদিন তার সঙ্গে দেখা হয় ব্রিসবেনের রোহিঙ্গা কমিউনিটির প্রশিক্ষক ফিল নিক্সনের। শরীরচর্চায় ২১ বছরের নূরের আগ্রহ দেখে তাকে লেগে থাকার পরামর্শ দেন ফিল।অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নূর জানান তার শুরুর গল্প ও ফিলের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনা।‘বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার জন্যই জিমে যেতাম। ফিলই আমাকে বলেন যে এটাতে আমি বেশ ভালো ও আমার শরীরচর্চা নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত’, বলেন নূর।এরপরই শরীরচর্চা নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করেন তিনি। দুই বছরের মাথায় পারসোনাল ফিজিক্যাল ট্রেইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর বডিবিল্ডিংয়ের যাত্রা শুরু ২০২০ সালে ফিটনেস গুরু সাইমন স্ট্রকটনের হাত ধরে।বডিবিল্ডিং শুরু করার পর রোহিঙ্গা কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসেবে ভিন্ন কিছু করার তাগিদ থেকেই বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নেন নূর।তিনি বলেন, ‘আমি বডিবিল্ডিংয়ের কিছুই জানতাম না। প্রতিযোগিতা নিয়েও কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু আমি আমার লোকদের জন্য অংশ নিতে চাইতাম। স্ট্রকটন বিভিন্ন প্রদর্শনীর জন্য বিল্ডারদের ট্রেনিং করাতেন। আমি তার কাছে যাই ও আমার সম্পর্কে সব খুলে বলি।’স্ট্রকটনের অধীনেই দেড় বছরের মধ্যে বডিবিল্ডিংয়ে নিজের জায়গা করে নেন নূর। তার সবশেষ সাফল্য ব্রিসবেন আইসিএন ক্ল্যাসিকের শিরোপা জয়।
ব্রিসবেন ক্ল্যাসিক শিরোপা জয়ের পর পোডিয়ামে নূর কবির। ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ার সেরা বডিবিল্ডার হওয়ার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া নূর জানান, অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে আসার আগে মাকেও বলেননি তিনি।‘তিনি আমাকে আসতে দিতেন না। কিন্তু আমি আর থাকতে পারছিলাম না। একটা উন্নত জীবনের লক্ষ্য ছিল আমার। আমার মা সপ্তাহ দুয়েক পর যখন জানতে পারেন আমি কোথায়, তখন অনেক কান্নাকাটি করেছেন। তার ধারণা ছিল আমাকে বাংলাদেশিরা মেরে ফেলেছে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন ছেড়েছেন সেই কারণগুলোও জানান নূর। তার ভাষ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল তার পরিবার।তিনি বলেন, ‘যখন ক্যাম্পে থাকতাম, খাবারের কষ্ট ছিল। পর্যাপ্ত খাবার পেতাম না। পানির কষ্ট ছিল। পরিষ্কার পানির অভাব ছিল। তিন বেলা খাওয়ার জোগাড় হতো না।
‘অনেক সময় এক বেলা খেয়ে দিন পার করতে হতো। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। রেশনের ওপর নির্ভর করতে হতো। সেটা সব সময়ই কম পড়ত।’দুর্দশাগ্রস্ত জীবন তাকে হাঁপিয়ে তুলেছিল উল্লেখ করে নূর বলেন, ‘পাঁচ বর্গমিটারের একটা রুমে আমরা সাতজন থাকতাম। জীবনের ১৫টা বছর আমি সেভাবেই কাটিয়েছি। তাই সবকিছু ছেড়ে নতুনভাবে শুরু করতে চাইছিলাম।’অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় এক দশক নূরকে দিয়েছে উন্নত জীবন ও নতুন পরিচিতি। তারপরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বজনদের ভোলেননি তিনি। তার লক্ষ্য একজন সফল পুষ্টিবিদ হয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানুষদের সাহায্য করা।‘সেখানে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) জীবন খুব কঠিন। আমার অনেক বন্ধু ও স্বজন ঠিকমতো খেতেও পান না। তাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ হয় না। কারণ সেখানে ইন্টারনেটের ঝামেলা আছে। আশা করি ফিটনেস নিয়ে কাজ করে সেখানকার ভয়ংকর পরিস্থিত পাল্টাতে পারব’, বলেন আশাবাদী নূর।