ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিদায়ে কাঁদছে পুরো বিশ্ব। ভক্ত, সমর্থক ও সতীর্থরা মূহ্যমান আপনজন হারানোর বেদনায়। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো ফুটবল ভক্তের কাছে ম্যারাডোনা অতি আপনজন।আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক, নাপোলিকে শিরোপা জেতানো কিংবদন্তি, বার্সেলোনা ও বোকার মাঠে বল নিয়ে দৌঁড়ানো এক অমিত প্রতিভাধরের পরিচয় ছাপিয়ে ম্যারাডোনা হয়ে গেছেন গোটা পৃথিবীর অংশ।তার মৃত্যুতে তাই বিশ্বব্যাপী এমন হাহাকার। মহাতারকার প্রস্থানে বিষণ্নতা চারদিকে। এক দশকের কিছু আগে এমন আরেক মৃত্যু এসেছিল পৃথিবীতে। তিনি ম্যারাডোনার মতো ক্রীড়া ক্ষেত্রের কেউ নন, তবে একই রকম ক্ষ্যাপাটে, একই রকম বাউণ্ডুলে। যতটা আলোচিত, ঠিক ততটাই বিতর্কিত। কাকতালীয় ভাবে দুইজনের মৃত্যুর তারিখটাও এক। ২৫। নভেম্বরের ২৫ গেলেন ম্যারাডোনা। আর ২০০৯ এর জুনের ২৫ প্রয়াণ ঘটে সেই আরেক ট্র্যাজিক আইকন মাইকেল জ্যাকসনের।প্রশ্ন উঠতেই পারে ম্যারাডোনার সঙ্গে মাইকেল জ্যাকসনের প্রসঙ্গ কেন? দুই জনই নিজেদের ক্ষেত্রে সবার সেরা ও সবচেয়ে নন্দিত-নিন্দিত। আপাত দৃষ্টিতে মিল তো এটুকুই! জ্যাকসন বা ম্যারাডোনার কর্মক্ষেত্র ছাপিয়ে যদি নজর দেয়া যায় তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তাহলে সেখানে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে।ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্ম বুয়েনোস আইরেসের সুবিধাবঞ্চিত এলাকা ভিয়া ফিয়োরিতায়। ছোটবেলা থেকেই লড়তে হয়েছে অভাব, না পাওয়া এবং আর্থিক সংকটের সঙ্গে।মাইকেল জ্যাকসনের জন্মটাও একইরকম পরিবেশে, অন্য আরেকটি দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চল গ্যারিতে ১০ ভাইবোনের সঙ্গে দুই রুমের বাড়িতে বেড়ে ওঠা তার। ম্যারাডোনার চেয়ে বয়সে মাত্র দুই বছরের বড় জ্যাকসন।দুই তারকাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য পান একেবারে অল্প বয়সে। ১৩ বছর বয়সে জ্যাকসন হয়ে ওঠেন ভাইদের পপ গ্রুপ ‘জ্যাকসন ফাইভ’ এর মূল ভোকাল। তিন বছরের মধ্যেই হয়ে যান মাল্টি-প্ল্যাটিনাম আর্টিস্ট।আমেরিকার দক্ষিণের আর্জেন্টিনাতেও ম্যারাডোনা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান মাত্র ১৬ বছর বয়সে। সত্তরের দশক ছিল দুই ক্ষেত্রে দুই ভবিষ্যত মেগাস্টারের নিজেকে তৈরির সময়।কাকতাল খুঁজতে চাইলে পাওয়া যাবে এখানেও। ১৯৭৯ সালে ম্যারাডোনা যেমন আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছিলেন যুব বিশ্বকাপ। জ্যাকসনও ভাইদের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে একই বছর রিলিজ করেন তার সলো অ্যালবাম ‘অফ দ্য ওয়াল’। আশির দশকে দুই তরুণ পৌছান নিজেদের শিখরে। ৮৬ তে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ জয় আর এর তিন বছর আগে জ্যাকসনের অ্যালবাম ‘থ্রিলার’। দুটোকেই ধরা হয় তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রের বেঞ্চমার্ক।থ্রিলার সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রির রেকর্ড গড়ে, যা আজও টিকে আছে। আর ৮৬ বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সকে ফুটবল পণ্ডিতেরা এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবল দক্ষতার প্রদর্শনী।কিন্তু এই দুইজনের ট্রফি জয় বা অ্যালবাম বিক্রির সংখ্যার চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তাদের ‘কালচারাল ইমপ্যাক্ট’। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনা ও নেপলসের নিপীড়িত মানুষের কাছে মসীহা বনে যান বিশ্বকাপ ও স্কুদেত্তো জিতিয়ে। আর্জেন্টাইন ও নেপোলিতানরা তাদের সব অপ্রাপ্তি, হতাশা, বিষন্নতাকে ভুলতে চাইত ম্যারাডোনার একটি গোল বা পাস থেকে। দিনের পর দিন তাদেরকে ঠিক সেটি-ই উপহার দিয়ে ১০ নম্বর জার্সি পড়া পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির লোকটা মানুষ থেকে বনে গেছেন ঈশ্বর।জ্যাকসনও ভাঙতে থাকেন ‘অ্যামেরিকান স্টিরিওটাইপ’। প্রথম কালো শিল্পী হিসেবে পান মেইনস্ট্রিম জনপ্রিয়তা। প্রথম কালো শিল্পী হিসেবে তার মিউজিক ভিডিও মুক্তি দেওয়া হয় পপ সঙ্গীতের তীর্থস্থান খ্যাত এমটিভিতে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পরও অ্যামেরিকার সামাজিক শৃঙ্খলে বন্দি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-অ্যামেরিকানরা জ্যাকসনের মাধ্যমে প্রথম স্বাদ পান সর্বস্তরে সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার।দুই প্রান্তের দুই কিংবদন্তি সাফল্য দিয়ে স্থান করে নেন মানুষের হৃদয়ে। দুই জনই হয়ে ওঠেন আশি ও নব্বই দশকে বেড়ে ওঠাদের জন্য কালচারাল আইকন। কোনো স্থান, কাল, পাত্রের সীমারেখা দিয়ে থামানো যায়নি তাদের জনপ্রিয়তার অগ্রযাত্রা।নব্বই দশকেই পতনের শুরু হয় দুই সম্রাটের। ফুটবল সম্রাটের পরাজয় ঘটে মাদকের হাতে। আর পপ সম্রাটের বিপক্ষে আসতে থাকে একের পর এক যৌন কেলেংকারির অভিযোগ।দুইজনই অসংখ্যবার এইসব অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ম্যারাডোনা স্বীকার করেছেন কোকেন নেয়ার কথা, কিন্তু বারবার বলেছেন ফুটবল খেলতে তার মাদকের ‘সাহায্যের’ দরকার নেই।১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে জেতানোর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে- এই কথা বহুবার বলেছেন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার সময় নাপোলির কুখ্যাত মাফিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ বনে যাওয়া ম্যারাডোনা। জ্যাকসনকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় আদালত। তবে ততদিনে মানসিকভাবে তাকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টায় সফল ইউএস মিডিয়া। জ্যাকসন বারবার মিডিয়ার সামনে আনার চেষ্টা করেন কীভাবে সোনি কর্পোরেশনের মতো বিরাট একটা কোম্পানি চেষ্টা করছে তাকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরিয়ে দিতে। যেন তার গানগুলোর কপিরাইট তারা কিনে নিতে পারে বিনা বাধায়।তার লড়াইয়ের যৌক্তিকতা পরিস্কার হয়ে ওঠে যখন মৃত্যুর পরের বছরই তার গানের সম্পূর্ণ প্রচার স্বত্বের জন্য সোনি ২৫ কোটি ডলারের চুক্তি করে জ্যাকসনের কোম্পানির সঙ্গে।বারবার ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা লড়ে এসেছেন ফিফা সভাপতি জোয়াও হাভেলাঞ্জের দূর্নীতির বিরুদ্ধে। লড়েছেন সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। ‘রানির’ মুখের ভাষা বলে ইংরেজি শিখতে চাননি কখনও। অ্যামেরিকার কুনজর পড়বে জেনেও বন্ধুত্ব করেছেন ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে।একই ভাবে জ্যাকসন লড়েছেন অ্যামেরিকান মিডিয়াতে কৃষ্ণাঙ্গদের ইমেজের বিরুদ্ধে। গায়ের রঙ পাল্টানো নিয়ে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে জ্যাকসনকে। সমালোচকদের পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘আমার ভিটিলিগোর (চর্মরোগ) কারণে রঙ পরিবর্তীত হয়েছে। তারপরেও তারা আমাকে বারবার একই প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে। কিন্তু যখন দেখি সূর্যের নিচে শেতাঙ্গদের গায়ের রঙ পালটানোর জন্যে বিলিয়ন ডলারের সান ট্যানিং ইনডাস্ট্রি নিয়ে কেনো কেউ প্রশ্ন করছে না, তখন বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়’।এই প্রতিবাদ ও বিদ্রোহী স্বভাবের কারণে সাধারণ মানুষের আরও কাছে পৌছে গিয়েছিলেন দুই জগতের দুই মেগাস্টার। জ্যাকসনের বিদায়ে কান্নার রোল ওঠে লস এঞ্জেলিস থেকে লাগোস, ডারবান থেকে রেকিয়াভিক, বেইজিং থেকে ব্রাসিলিয়া পর্যন্ত। আশি ও নব্বই দশকে বড় হওয়া মিলেনিয়ালদের কাছে ২০০৯ সালের জ্যাকসনের মৃত্যু ছিল শৈশব হারিয়ে ফেলার মতোই কষ্টের।একই রকম কিংবা তার চেয়েও বেশি আবেগ ম্যারাডোনার ক্ষেত্রেও। পুরো এক প্রজন্মের কাছে আইকন তিনি। তার চলে যাওয়া যেন মাইকেল জ্যাকসনের মতোই সময়কে ধারণ করা আরেক বিয়োগান্তক চরিত্রের চির প্রস্থান।
বিয়োগান্তক দুই মহানায়ক ম্যারাডোনা-জ্যাকসন
প্রশ্ন উঠতেই পারে ম্যারাডোনার সঙ্গে মাইকেল জ্যাকসনের প্রসঙ্গ কেন? দুই জনই নিজেদের ক্ষেত্রে সবার সেরা ও সবচেয়ে নন্দিত-নিন্দিত। আপাত দৃষ্টিতে মিল তো এটুকুই! জ্যাকসন বা ম্যারাডোনার কর্মক্ষেত্র ছাপিয়ে যদি নজর দেয়া যায় তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তাহলে সেখানে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে।
-
ট্যাগ:
- ম্যারাডোনা
এ বিভাগের আরো খবর/p>