বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তালেবান উত্থানে সক্রিয় আনসার আল ইসলাম, সঙ্গে ‘গুনবীরা’

  •    
  • ২৫ জুলাই, ২০২১ ২০:১৩

ক্ষমতা দখল করে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আনসার আল ইসলাম। আর এর অংশ হিসেবেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গি সংগঠনটি। তাদের মধ্যে আছেন মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবীসহ তার মতো ২৫ উগ্রবাদী বক্তা, যাদের বেশির ভাগই হেফাজতে ইসলামের নেতা।

প্রকাশ্যে ‘দাওয়াতি’ কাজের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। সংগঠনটি ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কার্যক্রম জোরদার করেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে যাওয়ার পর তালেবান যে তৎপরতা শুরু করেছে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে সংগঠনটি।

‘বৈশ্বিক জিহাদের’ অংশ হিসেবে হেফজতে ইসলামসহ সমমনা সংগঠনগুলোর ‘অপারেশনাল উইং’ হিসেবে মাঠে থাকতে চাইছে আনসার আল ইসলাম। যার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা দখল করে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় সংগঠনটি। আর এর অংশ হিসেবেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গি সংগঠনটি। তাদের মধ্যে আছেন মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবীসহ তার মতো ২৫ উগ্রবাদী বক্তা, যাদের বেশির ভাগই হেফাজতে ইসলামের নেতা।

দেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নজরদারিতে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানতে পেরেছে নিউজবাংলা। তবে হেফাজতে ইসলাম বলছে, আনসার আল ইসলামের সঙ্গে তাদের কোনো নেতার সম্পর্ক নেই।

আনসার আল ইসলাম পরিচিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) নামেও। জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার ‘আদর্শিক মিল’ রয়েছে। আনসার আল ইসলাম যে উগ্রবাদীদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

কর্মকর্তারা মনে করছেন, সাধারণত যে ঘটনা নিয়ে বিশ্ব সরগরম থাকে সে ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদীরা। সবশেষ আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানকার জঙ্গিরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, যার প্রভাব থাকতে পারে বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জঙ্গিদের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করাও জরুরি। জনগণকে সচেতন করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিতে পারলে দেশে বাড়তে পারে জঙ্গিবাদী তৎপরতা।

হেফাজতের মতো সংগঠনের হয়ে ‘অপারেশনে’ থাকবে আনসার আল ইসলাম

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিউজবাংলাকে জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এসব নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশি কৌশলী ও গুছিয়ে কাজ করে আনসার আল ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা ইসলামি দলগুলোর ‘অপারেশনাল উইং’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে আনসার আল ইসলাম। তাদের উদ্দেশ্য ‘বৈশ্বিক জিহাদে’ অংশ নেয়া, যার মাধ্যমে দূরবর্তী শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা দখল করা। যে বিষয়টিকে তারা ইসলামি খেলাফত বলে প্রচার করে।

কর্মকর্তারা জানান, আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের উত্থানের খবরে তৎপরতা বাড়িয়েছে আনসার আল ইসলাম, চেষ্টা চালাচ্ছে প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজ করতে। তবে আফগানিস্তানের জঙ্গিদের নেতৃত্বে রয়েছে সালাফি মতাদর্শীরা। আর বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো ‘রিসোর্স’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য টার্গেট করেছে বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার উগ্রপন্থি শিক্ষক ও আলেমদের। চাইছে তাদেরকে সংগঠনের সদস্য হিসেবে ‘রিক্রুট’ করে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করতে।

এ ক্ষেত্রে কিছুটা সফলতাও পেয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। গ্রেপ্তার হওয়া মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী, হারুন ইজাহার, রফিকুল ইসলাম মাদানি ও আলী হোসেন ওসামা তাদের হয়ে যুব সমাজের ‘মগজধোলাই’ করছিলেন। আরেক আলোচিত মাওলানা আবু ত্ব-হা আদনানও তাদেরই অনুসারী।

হেফাজত ও সমমনা দলের ২৫ জন নজরদারিতে

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা ইসলামি দলগুলোর অন্তত ২৫ জন নেতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন। এসব নেতা কৌশলে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ভেতরে-ভেতরে আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করছেন। তারা জঙ্গি সংগঠনটির নীতিনির্ধারণী বোর্ড শরিয়া বা ফতোয়া বোর্ডের সদস্য।

কওমিপন্থি ধর্মীয় নেতা মাহমুদ হাসান গুনবী। ফাইল ছবি

আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামো

বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়ে একটা ধারণা পেয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, বেসরকারি ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী আনোয়ার ইব্রাহিম, মারুফ ও মোরসালিনসহ বেশ কয়েকজন জঙ্গিনেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামো বেশ শক্তিশালী।

৫-৬ সদস্যবিশিষ্ট ফতোয়া বোর্ডের মাধ্যমে সংগঠনটির পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দাওয়া, মিডিয়া, আইটি, লজিস্টিক ও আসকারি (হামলা বা হত্যা বাস্তবায়নকারী শাখা) শাখার মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এদের মধ্যে দাওয়া ও লজিস্টিক শাখার কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি।

‘দাওয়া’ শাখার মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহের পাশাপাশি ‘লজিস্টিক’ শাখার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের কাজ করছে আনসার আল ইসলাম। দাওয়া শাখার মাধ্যমে প্রত্যেক ‘মাদু’ (প্রাথমিক টার্গেট) ও মামুর’কে (প্রাথমিক সদস্য) প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান ও ‘ইমান-আকিদার ওপরে বয়ান’ দেয়া হয়।

দাওয়া শাখা সদস্য সংগ্রহের জন্য প্রথমেই যাকে টার্গেট করে, তাকে মাদু নামে ডাকা হয়। মাদুকে নিয়মিত বিরতিতে একাধিক কোর্স করিয়ে ইখওয়াহ বা মামুর হিসেবে দলভুক্ত করা হয়। এরূপ ৪-৫ জন মামুর মিলে একটি তৈয়ফা বা সেল বা মডিউল গড়ে তোলে সংগঠনটি। এই সেলের প্রধানকে মাশুল বলা হয়। একাধিক তৈয়ফার নেতাকে মাজমাহ মাশুল বলা হয়। মাজমাহ মাশুলদের প্রধান যিনি, তিনি আইডিএন বা হাদি হিসেবে ফতোয়া বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

‘আসকারি’ শাখার রয়েছে তিনটি অণু বিভাগ- ইনটেল, অপস ও ল্যাব। ‘ইনটেল’ বিভাগের জঙ্গিরা সাধারণত গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে টার্গেট করা যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে ‘অপস’ বিভাগের জঙ্গিরা ‘অপারেশন’ বাস্তবায়ন করে। এই অপারেশনের আগে ‘ফতোয়া বোর্ডের’ অনুমোদন নিতে হয়। ‘আসকারি’ শাখার ‘ল্যাব’ বিভাগের কাজ মূলত বিভিন্ন বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির উপকরণ নিয়ে গবেষণা।

আসকারি শাখা নিয়ন্ত্রণ করেন সংগঠনটির আমির। এই শাখার দায়িত্বশীল জঙ্গিদের সঙ্গে অন্য কোনো শাখার সদস্য বা নেতার কোনো সম্পর্ক থাকে না। দাওয়া বিভাগের অধীনে থাকা বিভিন্ন তৈয়ফা থেকে বাছাই করা মামুরদের পৃথক পৃথকভাবে আসকারি শাখায় স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আসকারি শাখার অপস অণু বিভাগের মাধ্যমে ‘অপারেশন’ চালানো হয়।

কর্মকর্তারা জানান, এ সংগঠনের জঙ্গিরাই বাংলাদেশে প্রথম মরিচবাতি দিয়ে ডেটোনেটর তৈরি করেন। ‘ক্লোজ কমব্যাটে’ ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি তৈরিতে পারদর্শী তারা। এ ধরনের একাধিক ডেটোনেটর ও আগ্নেয়াস্ত্র সিটিটিসি তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে।

‘লজিস্টিক’ শাখার কাজ মূলত দুটি- অর্থ সংগ্রহ ও যেকোনো হামলায় ব্যবহৃত ইকুইপমেন্ট জোগাড়। তবে তারা এখন যেকোনো ধরনের হামলা বা ‘টার্গেট কিলিং’ থেকে সরে এসেছে। আপাতত তারা প্রচার, অর্থ ও কর্মী সংগ্রহে বেশি মনোযোগী। এ তিন বিষয়ে শক্তিশালী হওয়ার পর তারা হামলার দিকে এগোবে।

কর্মকর্তারা আরও জানান, আনসার আল ইসলাম বা একিউআইএসের প্রাথমিক সদস্যকে ‘মামুর’ বলা হয়। কয়েকজন ‘মামুর’ মিলে তৈরি করা গ্রুপকে ডাকা হয় ‘তৈয়ফা’ নামে। এরূপ একটি তৈয়ফা বা একাধিক তৈয়ফা মিলে গঠন করে একটি সেল, যেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জঙ্গিদের ‘স্লিপার সেল’ হিসেবে পরিচিত।

এরূপ একটি স্লিপারের দায়িত্বশীল জঙ্গি নেতাকে সাংগঠনিকভাবে ‘মাশুল’ পদবি দেয়া হয়। কয়েকজন ‘মাশুল’-এর দায়িত্বশীল নেতাকে ‘মাজমাহ মাশুল’ বলা হয়। আবার কয়েকজন মাজমাহ মাশুলের দায়িত্বশীল নেতাকে ডাকা হয় ‘হাদি’ নামে। সংগঠনের কর্মকাণ্ডে এ ‘হাদিরা’ই ফতোয়া বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। যে বোর্ডটি যেকোনো অপারেশন, হত্যাকাণ্ড বা হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়।

কার্যক্রম চলে ‘কাট আউট সিস্টেমে’

জঙ্গি সংগঠনটি এমনভাবে তাদের কাজ করে যে দাওয়া শাখার সদস্যরা একে অপরের পরিচয় জানতে পারেন না। এক তৈয়ফার কোনো সদস্যই (মামুর) অন্য তৈয়ফা বা সেই তৈয়ফার সদস্য কারা, তারা কী কাজ করছেন- এর কোনো কিছুই জানতে পারেন না। তাদের সব কাজই চলে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। তাদের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে জানেন কেবল ‘মাশুল’ ও ‘মাজমাহ মাশুল’ শ্রেণির নেতারা। আবার এক মাশুলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারেন না অন্য কোনো মাশুল। শুধু মাজমাহ মাশুলদের কাছেই সব মাশুলের কর্মকাণ্ডের খবর থাকে। বিষয়টা পরিচিত ‘কাট আউট সিস্টেম’ হিসেবে।

জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কোনো অপারেশন, হামলার ঘটনার পর জড়িত নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও সংগঠনটির অন্যান্য পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত কাট আউট পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনার কারণেই তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার কম

কর্মকর্তারা জানান, আনসার আল ইসলামের নেতা-কর্মীরা অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে ডিজিটাল ডিভাইস কম ব্যবহার করেন। যোগাযোগের জন্য নিরাপদ হিসেবে পরিচিত কোনো অ্যাপ ব্যবহার করেন না। এমনকি মোবাইল ফোনেও তারা খুব কম যোগাযোগ করেন। কারও সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন থাকলে সরাসরি দেখা করেন বা ‘অন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে’ যোগাযোগ করে থাকেন।

আধ্যাত্মিক নেতা নন গুনবী, আমির মেজর জিয়া

পুলিশ জানায়, ১৫ জুলাই রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গুনবীকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে উগ্রবাদী কিছু বই ও প্রচারপত্র উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাবের ভাষ্য, মাহমুদুল হাসান গুনবী প্রকাশ্যে ওয়াজ করে পরিচিতি লাভ করেন। গোপনে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করেন তিনি। বর্তমানে সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও তিনি পরিচিত।

পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গিবিষয়ক এক কর্মকর্তা জানান, আনসার আল ইসলামের ফতোয়া বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে জসিমউদ্দিন রাহমানী ছিলেন, তিনিই আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। তবে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা বলে কোনো পদ নেই। জসিমউদ্দিন রাহমানী কারাগারে থাকায় তার পক্ষে ফতোয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব নয়। বোর্ডের অন্য সদস্যরা মিলে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সংগঠনটির সর্বোচ্চ নেতা আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন আত্মগোপনে থাকা ‘মেজর জিয়া’ বা অন্য কেউ। সংগঠনটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তামিম আল আদনানী মালয়েশিয়া আছেন। এই আদনানীই মিডিয়াসহ একাধিক শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, মেজর জিয়া আত্মগোপনে থাকায় আদনানীই দেশের বাইরে বসে নিষিদ্ধ সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সীমান্ত এলাকায় কার্যক্রম বেড়েছে

জঙ্গি কার্যক্রম অনুসরণকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, গ্রেপ্তার বিভিন্ন জঙ্গি নেতার মাধ্যমে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কার্যক্রম বাড়িয়েছে আনসার আল ইসলাম। প্রাথমিকভাবে ‘কাট আউট সিস্টেমেই’ সীমান্ত এলাকায় সদস্য বাড়াচ্ছে। এভাবে সদস্য বাড়ানোর মাধ্যমে প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কর্মকর্তারা মনে করছেন, আনসার আল ইসলাম আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিদের মতো প্রকাশ্যে ‘দাওয়াতি’ কাজ শুরু করলে তা হবে দেশের জন্য উদ্বেগজনক। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের পুনরুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের যে অপতৎপরতা দেখা দিয়েছে তা অ্যালার্মিং।’

‘গুনবী কেন তালেবান জঙ্গিদের পক্ষে’

কর্মকর্তারা জানান, গুনবীকে দুই দফায় চার দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন জায়গায় দেয়া বক্তবকে ভুল বলে স্বীকার করেছেন তিনি। কেন, কাদের নির্দেশে আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিদের পক্ষ নিয়ে প্রকাশ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন গুনবী। এসব স্বীকার করে শনিবার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন গুনবী।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই অনুসরণ করা হচ্ছিল গুনবীর কার্যক্রম। র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিটিটিসি।

সিটিটিসির উপকমিশনার আব্দুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গুনবী আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার কৃতকর্মের সবকিছুই স্বীকার করেছেন। শনিবার আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গুনবীর অনেক অনুসারী; তাদের অনেককেই উগ্রবাদী হিসেবে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

আনসার আল ইসলামের জন্ম যেভাবে

সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে আনসারুল্লাহ ফাউন্ডেশন নামে পাকিস্তানভিত্তিক একটি ওয়েবপেজ চালু করেন বাব-উল-ইসলাম নামে এক পাকিস্তানি। যেখানে উর্দু, পশতু, হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ব্লগ লেখা হতো। ২০১২ সালে আনসারুল্লাহ ফাউন্ডেশন থেকে পৃথক হন বাংলা ভাষাভাষী ব্লগার গ্রুপটি; যাদের বলা হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী কর্মকর্তাদের কাছে এবিটি আর আনসার আল ইসলাম অভিন্ন সংগঠন হিসেবেই পরিচিত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে এই সংগঠনের মাধ্যমে বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর আনসার আল ইসলাম তাদের টুইটার পেজে নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে।

আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩টি হামলার দায় স্বীকার করে। এসব ঘটনায় নিহত হন ১১ জন, যাদের অধিকাংশ ছিলেন ব্লগার। নিহতদের মধ্যে আরও ছিলেন প্রকাশক, শিক্ষক ও সমকামী অধিকারকর্মী।

বর্তমানে একিউআইএসের প্রধান হিসেবে রয়েছেন এক পাকিস্তানি নাগরিক, যিনি ওস্তাদ ফারুক নামে পরিচিত। তবে তার অবস্থান কোথায় সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজের ১০ দিন পর খোঁজ পাওয়া যায় আলোচিত ইসলামি বক্তা আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানের।

হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতার ওপর নজরদারির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে সংগঠনটির নতুন মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতারা যে নজরদারির মধ্যে আছেন, তা আমার জানা নেই।’

জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উগ্রবাদিতার উত্থান বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি। আফগানিস্তানে তালেবানরা সুসংগঠিত হয়ে একের পর এক অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। অনলাইনে ধর্মীয় উগ্রবাদ উসকে দেয়ার চেষ্টা চলছে। শুধু পুলিশি অভিযান দিয়ে সাময়িকভাবে স্বস্তি আসলেও সমস্যা কাটবে না। এ সমস্যা মোকাবিলায় পুলিশের অভিযানের পাশাপাশি জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াইয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে উগ্রবাদিতা কমার বদলে বাড়তে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, তাদের অনেককে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করে অনেক পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ধরনের আইনি বরখেলাপের মাধ্যমে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যাবে না, বরং বাড়বে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সিটিটিসির উপকমিশনার আব্দুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উগ্রবাদী এ সংগঠনটি উগ্রবাদীদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে। আমরাও উগ্রবাদী বক্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

গুনবীর ১৬৪ ধারায় দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘গুনবী বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে উগ্রবাদী বক্তব্য দিয়ে যুবসমাজকে বিপথে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি আদালতের কাছে বিষয়টি স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।’

পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) অপারেশন উইংয়ের এসপি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক্সট্রিম জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে যারা থাকে তারা সব সময় ইস্যু খোঁজে। দাওয়াতি কার্যক্রমে সফলতা নির্ভর করে ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুর ওপর। যে ঘটনা নিয়ে বিশ্ব সরগরম থাকে সে ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদীরা। সর্বশেষ আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর সেখানকার জঙ্গিরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। যার একটা প্রভাব থাকতে পারে বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের মধ্যে।’

তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা সব সময়ই বিশ্বের যেকোনো জায়গায় একটা ফ্রি ল্যান্ড চায়, যেখান থেকে তারা অবাধে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে। থিওরেটিক্যাল অ্যানালাইসিস অফ টেররিজম অনুসারে এটা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনলাইন ও অফলাইনে কার্যক্রম জোরদার করেছে আনসার আল ইসলাম।’

এ বিভাগের আরো খবর