পাবনার গণপূর্ত ভবনে অস্ত্রের মহড়ায় নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হোসেনকে নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ঠিকাদারি সংশ্লিষ্ট আরও দুটি সরকারি অফিসের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ফারুক হোসেন জোর করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতে ৬ জুনের ওই ঘটনার আগেও তাদের লাঞ্ছিত করেছেন; দিয়েছেন হত্যার হুমকিও।
তার ব্যাপারে মুখ খুলছেন স্থানীয় লোকজনও। তারা বলছেন, পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লার আতোয়ার হোসেনের ছেলে ফারুক হোসেন। তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। সংসার চলত নিউ মার্কেটের কসমেটিক্সের দোকানের আয়ে। অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া হয়নি ফারুকের। একসময় লেখাপড়া বাদ দিয়ে সিনেমা হলের সামনে বাদাম বিক্রি শুরু করেন তিনি।
পরে বাবার দোকানের সামনের ফুটপাতে কসমেটিক্সের দোকানও দেন ফারুক। একপর্যায়ে চলে যান সিঙ্গাপুর। প্রায় এক যুগ আগে দেশে ফেরেন। তারপর ঠিকাদারি কাজের সমঝোতা করতে করতে পরিচিতি পান ‘নিগো ফারুক’ নামে। কখনও নিম্নমানের কাজ করে, কখনও কাজ না করেই বিল তুলতে থাকেন। এভাবে গড়তে শুরু করেন সম্পদের পাহাড়।
এর একপর্যায়ে ‘নিগো ফারুক’ নামের বদনাম মুছতে বছর পাঁচেক আগে হজ করেন ফারুক। তারপর থেকে নিজেকে হাজি ফারুক পরিচয় দিতে শুরু করেন। বর্তমানে তার ‘সিগন্যাল’ ছাড়া কোনো দপ্তরের ঠিকাদারি কাজ পান না কেউ।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ফারুকের এত অল্প সময়ে এত ক্ষমতাধর হওয়ার পেছনে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা। তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে অষ্টম শ্রেণি ‘পাস’ ফারুক বাগিয়ে নিয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকের মতো পদ।
আওয়ামী লীগ নেতা নিগো ফারুক
ফারুক এখন নাইস কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। যে প্রতিষ্ঠানটির নামে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার গাড়ি ও ঠিকাদারির কাজের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।
তবে ফারুক হোসেন বলছেন, তিনি কোনো অনিয়মে জড়িত নন। জেলার সব প্রকৌশলীর সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ঠিকাদারি করেই বৈধভাবে এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
গত ১২ জুন ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ৬ জুন দুপুর ১২টার দিকে ফারুক হোসেন দলবল নিয়ে গণপূর্ত ভবনে ঢোকেন। তার পেছনে শটগান হাতে ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী রেজা খান মামুন। অস্ত্র হাতে ঢুকতে দেখা যায় জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ লালুকেও।
এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে আগ্নেয়াস্ত্র দুটি ও সেগুলোর গুলি জব্দ করে পুলিশ। ঘটনা তদন্তে আওয়ামী লীগ নেতাদের অস্ত্র আইনের শর্তভঙ্গের প্রমাণ পেয়ে লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশও করেছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: আ.লীগ নেতারা শটগান হাতে গণপূর্ত অফিসে
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ জুনের আলোচিত এই ঘটনার আগে ২৩ মে জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কার্যালয়ে এক প্রকৌশলীকে লাঞ্ছিত করেন ফারুক। আওয়ামী লীগের ‘প্রভাবশালী নেতাদের’ হস্তক্ষেপে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়। তারও আগে গত ১৯ অক্টোবর ফারুক জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে ঢুকে সুপারিনটেনডেন্ট মুশফিকুর রহমানকে লাঞ্ছিত করে হত্যার হুমকি দেন।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, ফারুক হোসেন পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার পর পাবনার বীণা বাণী সিনেমা হলের সামনে বাদাম বিক্রি করতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর নিউ মার্কেটে বাবার কসমেটিক্সের দোকানের সামনে ফুটপাতে কসমেটিক্সেরই কম দামি পণ্য বিক্রি শুরু করেন। তার কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর চলে যান ফারুক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফেরেন।আরও পড়ুন: শটগান হাতে গণপূর্ত অফিসে: অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ
ফারুক দেশে ফিরে প্রথমে বিভিন্ন ঠিকাদারের সাইট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। একপর্যায়ে স্থানীয় এক ‘প্রভাবশালী নেতার’ সুনজরে পড়েন। তার ছত্রছায়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), এলজিইডিসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতে শুরু করেন।
সাধারণ ঠিকাদারদের বাধা দেয়ার পাশাপাশি সিন্ডিকেট করে কাজ কেড়ে নিতে থাকেন। এভাবে টেন্ডার সমঝোতা কমিটির হর্তাকর্তা বনে যান ‘নিগো ফারুক’। ধীরে ধীরে এলজিইডির উন্নয়নকাজে আধিপত্য বিস্তার করে, কখনও নিম্নমানের কাজ করে, কখনও কাজ না করেই বিল তুলে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
গত বছর ফারুক তার নাইস কনস্ট্রাকশনের অধীনে কয়েক কোটি টাকার ঠিকাদারি মেশিনারিজ ক্রয় করেছেন। কিনেছেন একাধিক দামি গাড়ি। নিজস্ব বাহিনীর জন্যও নিয়েছেন বেশ কিছু মোটরসাইকেল। জেলা প্রশাসকের বাসভবনের ঠিক সামনেরই একটি বিলাসবহুল বাড়িও কিনেছেন ফারুক।
ফারুকের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন এলজিইডি পাবনার সহকারী প্রকৌশলী ও দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি আব্দুল খালেক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে পাবনার ফরিদপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকায় একটি রাস্তা নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
‘২৩ মে দুপুরে হঠাৎ হাজি ফারুক হোসেন আমার কক্ষে এসে কাজটি তাকে দেয়ার দাবি করেন। নিয়ম অনুযায়ী আবেদন, দরপ্রস্তাব ও কাগজপত্র ঠিক থাকলে কাজ পাবেন। আর যোগ্যতা না থাকলে বাতিল হবে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করে আমাকে মারতে উদ্যত হন। তিনি আমাকে দেখে নেয়ারও হুমকি দেন।’
এ বিষয়ে কেন আইনি ব্যবস্থা নেননি জানতে চাইলে এলজিইডির এই সহকারী প্রকৌশলী বলেন, ‘ঘটনা জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত জানিয়েছি। মামলার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রভাবশালী দুজন জনপ্রতিনিধি বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ নিয়ে আমাদের অফিসে আসেন। নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান তাদের উপস্থিতিতে বিষয়টি মীমাংসা করে নেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। সব বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় না।’ সমঝোতা বৈঠকে উপস্থিত জনপ্রতিনিধিদের নাম জানতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, ফারুকের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ এবং নিম্নমানের কাজ করে বিলের জন্য কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখানো নতুন কোনো ঘটনা নয়। ৬ জুনের আগেও কর্মকর্তাদের গালাগাল ও লাঞ্ছিত করেছেন তিনি। তার দাপটে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ ঠিকাদাররা অতিষ্ঠ। তারা আইনের আশ্রয় নেয়া তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে মুখ খোলারই সাহস করেন না।
জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট মুশফিকুর রহমানের অভিযোগ, গত ১৯ অক্টোবর হাজি ফারুক তাকে লাঞ্ছিত করেন এবং হত্যার হুমকিও দেন। তাই জীবনের নিরপত্তা চেয়ে সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
মুশফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলা ফিন্যান্স ও অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে সব সরকারি কর্মকর্তার বেতন ও উন্নয়ন কাজের বিলের অর্থ দেয়া হয়। নাইস কনস্ট্রাকশনের মালিক ফারুক হোসেন তার একটি ঠিকাদারি কাজের জামানতের পাঁচটি চালান হারিয়ে ফেলে জাল চালান দিয়ে বিল দাখিল করেন। বিষয়টি আইনসম্মত না হওয়ায় হারিয়ে যাওয়া জামানতের চালানের অনুকূলে থানায় সাধারণ ডায়েরিসহ বিল দাখিলের পরামর্শ দেয়া হয়।
‘এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ফারুক। বিকেলেই ম্যানেজার আসাদকে নিয়ে অফিসে এসে গালিগালাজ করে মারতে যান। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটে এসে তাকে থামাতে গেলে তিনি আমাকে হত্যার হুমকি দেন। পরে দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এসে আমার কাছে ক্ষমা চান।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রকৌশলী আব্দুল খালেকের সঙ্গে আমার কাজ নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। সামান্য কথাকাটি হয়েছিল।’
অন্য কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলার সব প্রকৌশলীর সঙ্গেই আমার খুব ভালো সম্পর্ক।’
অঢেল সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘অন্যায়ভাবে সম্পদশালী হইনি। ঠিকাদারি ব্যবসায় ভালো করায় সম্পদ বেড়েছে।’