বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পালিচড়া থেকে বিশ্বদরবারে

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২১ ১৫:১৩

রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের সদ্যপুস্কুরিনী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামের মেয়েদের ফুটবল খেলা শুরু হয় ১০ বছর আগে। গ্রামের মেয়েদের জন্যই পালিচড়ার নতুন নাম হয়েছে ‘ফুটবলারদের গ্রাম’। গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে তারা খেলছে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে।

গ্রামটিতে একসময় কিশোরী বয়স পেরোনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসত মেয়েরা। পাঠশালার বই-খাতার পরিবর্তে তারা ব্যস্ত থাকত হাড়ি-পাতিল নিয়ে। সেই গ্রামের মেয়েরা এখন স্বপ্ন দেখছে বিশ্ব জয়ের। ফুটবলার হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরছে বিশ্ব দরবারে।রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের সদ্যপুস্কুরিনী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামের মেয়েদের ফুটবল খেলা শুরু হয় ১০ বছর আগে। এ সময়েই দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে তারা।

গ্রামের মেয়েদের জন্যই পালিচড়ার নতুন নাম হয়েছে ‘ফুটবলারদের গ্রাম’। গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে তারা খেলছে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে।২৭ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া নারী ফুটবল লিগে অংশ নিচ্ছে স্থানীয় ফুটবলারদের দিয়ে তৈরি সদ্যপুষ্করিনী যুব ক্লাব।

এ বিষয়ে সদ্যপুষ্করিনী যুব ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলজার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১০ সালে এখানকার মেয়েরা খেলা শুরু করে। ওই সময় গ্রামের মানুষজন নানা ধরনের নেতিবাচক কথা বলত। তারপরও মেয়েরা মাঠে এসে নিজে নিজে খেলত।’

২০১১ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্ট চালু হয়। ওই টুর্নামেন্টে পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাদের ছাত্রীদের নাম লেখায়।সেবার জাতীয় পর্যায়ে রানার্স-আপ হয় পালিচড়ার মেয়েরা। ওই টুর্নামেন্টের পর গ্রামের মেয়েদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীদের উৎসাহ আর অভিভাবকদের এগিয়ে আসায় প্রতি বছর সাফল্য পাচ্ছে দলটি। চলতি বছরের ক্রীড়া পরিদপ্তর বিচ ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা।২০১৫ সালে কেএফসি জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠে পালিচড়া বিদ্যালয়। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও জিতেছিল ফেয়ার প্লে ট্রফি। ২০১৬ সালে কেএফসি সিনিয়র ন্যাশনাল উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে তারা অর্জন করে তৃতীয় স্থান।

২০১৭ সালে জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টে তারা রানার্স-আপ, ২০১৮ সালে ৪৭তম গ্রীষ্মকালীন ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়।সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়ন ও এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে কৃতিত্বের জন্য এই গ্রামের সুলতানা, লাভলী, রত্নাসহ বেশ কয়েকজন ফুটবলার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সম্মাননা পেয়েছেন।বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে পরপর দুই বছর সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বুট জিতেছেন পালিচড়ার রোকসানা পারভীন। এখন ঢাকায় বিজিএমসিতে খেলছেন। নিউজবাংলাকে তিনি জানান ফুটবলার তৈরিতে আর্থিক সংকটের কথা।‘আমি এএফসির বি-লাইসেন্স পাওয়া কোচ। এখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এই ফুটবলারদের বল, জার্সি, বুটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়।’লিগ শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। তাই নিবিড় প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ফুটবলাররা। অনুশীলনের ফাঁকে নবম শ্রেণির ছাত্রী রুমি আক্তার জ্যোতি কথা বলেন নিউজবাংলার সঙ্গে।

তিনি বলেন, “গ্রামে এসব পছন্দ করত না। বলত, ‘তুমি খেলতে যাও কী জন্য? খেলে কী হবে।’ কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।”২০১৪ সালে খেলা শুরু করা রুমি এখন অনুশীলন করান উঠতি ফুটবলারদের। বয়সভিত্তিক দলে খেলার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন কিশোরীদের মাঝে। তার চোখে ধরা পড়ে বদলে যাওয়ার দৃশ্য।‘পায়ের ইনজুরির কারণে বড় দলে খেলতে পারছি না। এখানে যারা আছে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। গ্রামজুড়ে এখন ফুটবলের আলোচনা। যারা খারাপ চোখে দেখত তারাও এখন ভালো বলছে।’একই রকম পরিবর্তনের কথা জানালেন ফারজানা আক্তার। পালিচড়া গ্রামের মাটি ভাটা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী তিনি। বলেন, “ফুটবল খেলতে ভালো লাগে। তাই খেলি। প্রথমে আমাকে অনেকে বাধা দিছে গ্রামের মানুষ ও আত্মীয় স্বজনেরা। এখন বলে, ‘তুমি এখন ভালো খেলো।’ আমাকে এখন সবাই উৎসাহ দেয়।”পালিচড়া সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুআরা বেগম জানালেন ফুটবলারদের নিয়ে গর্ব করেন এখন গ্রামবাসী। সঙ্গে যোগ করেন তাদের উন্নয়নে দরকার আরও অর্থের।‘নিভৃত পল্লী এই গ্রামটি। এখানকার অধিকাংশ মানুষই কৃষি কাজ করি। মেয়েদের খেলার মাঠে যেতে দেবে এটা ভাবাই কষ্টকর। তারপরও মেয়েরা এখন খেলছে। তারা আমাদের অহংকার। এই মেয়েরা শুধু নিজেরাই সাফল্য অর্জন করেনি গোটা গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। ওরা আমাদের সোনার মেয়ে। সহযোগিতা পেলে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।’স্কুলের শিক্ষক আখতারুজ্জামান সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যি বলতে শুরুতে আমাদের গ্রামের মানুষ চায়নি মেয়েরা এভাবে মাঠে খেলুক। যখন একটা সফলতা আসল তখন আমরা বললাম, না আর মেয়েদের নিষেধ করব না। তখন থেকেই তারা মাঠে খেলে, আমরা ক্লাসে উদাহরণ দেই। ক্লাসের সব মেয়ে এখন খেলতে চায়।’

‘মুই এলা এইলে কতা শোনোং না’মেয়েদের ধারাবাহিক সাফল্যে গ্রামের বাসিন্দাদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে ফুটবল। মেয়েদের ফুটবলকে আর বাঁকা চোখে দেখেন না এখানকার মানুষ। বারণ নেই আগের মতো। বাবা-মা, অভিভাবকেরাই স্বত:স্ফূর্ত হয়ে মেয়েদের ফুটবল শিখতে অনুপ্রাণিত করছেন।শুধু রংপুরই নয়, নেত্রকোনা জেলার ২৭ কিশোরী ফুটবলার এখানে এসেছেন খেলা শিখতে। ক্লাবের ক্যাম্পে থেকে প্রতিদিন ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।তাদেরই একজন বিরিশিরি মিশন গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া রেমা। তিনি বলেন, ‘এখানে ২৭ জন আসছি। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলছি। এখন অনেকটা শিখে গেছি। আমি খেলা শিখে দেশের হয়ে সুনাম অর্জন করতে চাই।’শামীমা আক্তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ক্যাম্পে। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামাঞ্চলে বাড়ি। নানান জন নানান কথা বলতেছে। কেয়ার করি নাই। সব কথাত কান দিতে নাই। গত শনিবার আমার ভাতিজিকে নিয়ে মাঠে এসেছি। সে এখন বেশ ভালো খেলছে। আমি চাই, মেয়েরা বাইরে আসুক, খেলুক।’ক্যাম্পে অনুশীলন করা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ময়না খাতুনের বাবা মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মুই তো খেলবার দিবের চাং নাই। সবার বেটিরা খেলে মাডোত আসি। তারপর ময়নাও আইসে। এলা শুনবেনজি হামার ময়না নাকি ঢাকাত খেলবে। খেলুক দেহি কী হয়। মানুষ আগোত মেলা কতা কইছে মোক, মুই এলা এইলে কতা শোনোং না।’ কিশোরী ফুটবলারদের থাকা, খাওয়া ও নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছেন স্থানীয় প্রশাসন। এ বিষয়ে সদ্যপুস্কুরিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল রানা নিউজবাংলাকে বলেন, মেয়ে ফুটবলারদের দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ সহায়তা।‘খেলার মাঠের পাশে মেয়েদের থাকা ও খাওয়ার জন্য একটি ক্যাম্প রয়েছে। জেলা প্রশাসন সেটি করেছে। ওই ক্যাম্প ও গ্রামের খেলোয়াড় মেয়েদের নিরাপত্তা আমরা দিচ্ছি। পুলিশও সেখানে অবস্থান করে। এই মেয়েরা গ্রামকে নতুন করে চিনিয়েছে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই তাদের সহযোগিতা করি। এরা আমাদের গর্ব। আমি ও গ্রামবাসী তাদের পাশে আছি।’ইউনিয়নে ফুটবল খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে একটি মিনি-স্টেডিয়াম। বিষয়টি নিশ্চিত করেন রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান।‘তাদের এই অর্জন অন্যন্যদের মাঝেও উৎসাহ তৈরি করবে; অনুপ্রেরণা তৈরি করবে। শুধু খেলাধুলা নয়, সকল ক্ষেত্রে এই অনুপ্রেরণা নারী জাগরণে সহযোগিতা করবে,’ যোগ করেন তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর