এই ডিসেম্বর মাসে ৪৯ বছর আগে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি দেশ বাংলাদেশ। একদিকে যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন দামালরা, ঠিক একই সময়ে ফুটবল নিয়ে মুক্তির চেতনায় সবুজ ঘাসে লড়েছিলেন ফুটবলযোদ্ধারা।
পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশের মাটিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া এই বাহিনীর নাম ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। ইতিহাসের প্রথম কোনো ক্রীড়া দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এই ফুটবলযোদ্ধারা আজও স্বীকৃতির অপেক্ষায়।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বল নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়া ৩৫ ফুটবল সদস্যের অনেকেই এখন না ফেরার দেশে। মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ডে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা অবদান রাখার পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে জনমত তৈরিতে অবদান রাখা এই দলটি ৪৯ বছরেও পায়নি স্বীকৃতি।
স্বাধীন হওয়ার পর খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালকে। ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডির পর কবর হয়েছে স্বীকৃতিরও। সবশেষ ২০১৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে একবার নামও পাঠানো হয়েছিল। সেবারও স্বীকৃতি পাওয়া হয়নি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের।
আক্ষেপের পালা চলছেই। এই আক্ষেপসহ যুদ্ধের সময় ফুটবল ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনালেন দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সংগঠক সাইদুর রহমান প্যাটেল।
নিউজবাংলাকে দেয়া এই সংগঠকের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কোনো নির্দেশনা ছিল?
আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৯৬৬ থেকে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু কোন দিকে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক মহলে শুধু আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নয়; পুরো দেশই আঁচ করতে পারছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিটা স্টেপ এবং তিনি কোথায় যাচ্ছেন। তার মধ্যে আসল ৭ মার্চ। আমি নিজেও সেই ভাষণ অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি। ঘনঘন যাওয়া হতো বঙ্গবন্ধুর কাছে। ওখান থেকেই মূলত মানসিকভাবে ৮০ শতাংশ প্রস্তুতি পেয়ে গেলাম। এরপরে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় তিন বার গিয়েছি। শুধু যে আমরা, তা নয়; তখন ঢাকায় ৪৪টা ইউনিয়ন সবাই যোগাযোগ করত।
তারপর অনুমোদন পেলেন কীভাবে?
আমরা নদী পার হয়ে বিক্রমপুরে চলে যাই। সেখানে ট্রেনিং শেষে আমি, লুৎফর রহমান, মহসিন সাহেব ও মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া—এই চার জন আমরা বৈদ্যেরবাজার হয়ে রামচন্দ্রপুর দিয়ে আগরতলা, আগরতলা থেকে কলকাতা যাই। কলকাতায় গিয়ে সুবোধ সাহার বাসায় উঠি। উনি মহসিন সাহেবের বন্ধু ছিলেন। ঢাকাইয়া ছিলেন। ওই বাসাতেই আল্লাহর তরফ থেকে আমার মাথায় উদয় হলো ফুটবল দল গড়ার বিষয়টা। মে মাসে এই পরিকল্পনা করি। ১৩ জুন অনুমোদন পাই। প্রথম ম্যাচ খেলি ২৫ জুলাই। তাজউদ্দীন আহমেদ আমাদের অনুমোদন দেন।
অনুমোদন পাওয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমেদকে কী ব্যাখ্যা দিলেন?
তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে গেলাম। শামসুল হক চৌধুরী তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে বললেন, ‘প্যাটেল একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।’ পরে আমি ব্যাখ্যা দিলাম। ভালো দিক হলো যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে ফান্ড তৈরি করতে পারব; অর্থ জমা দিতে পারব। জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারব।
আমাদের প্ল্যান ছিল ফুটবল, হকি, ক্রিকেট সব হবে। ধারণা ছিল, ৪-৫ বছর যুদ্ধ হবে। এত শর্ট টাইমে যুদ্ধ শেষ হবে ধারণা ছিল না। তখন এসব শুনে তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের হাতে ১৪ হাজার রুপি দিলেন।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুটবলারদের সংগ্রহ করলেন কীভাবে?
অনুমোদন পেয়ে আমরা চার জন কলকাতার কোকা-কোলার বিল্ডিংয়ের কানারি মেনশনে থাকলাম। মাঠের বরাদ্দ পেলাম। ওইখানে প্রথম ফুটবল আলী আশরাফ ভাইকে পেলাম।
মুক্তিযোদ্ধা মঈন সিনহাকে পাঠিয়ে দিলাম ঢাকায় ফুটবলারদের নিয়ে আসতে। ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লালু ভাই, শাজাহান ও সাইদ ভাই এই তিনজনকে নিয়ে এলো।
আশরাফ ভাই বলল, ‘প্রতাপ শঙ্কর হাজরার সঙ্গে আমার ট্রামে দেখা। আমি শুনেছি মোহনবাগান ক্লাবে আলী ইমাম আছে।’
পরদিনই রওনা দিলাম। ইমাম ভাইকে পেলাম। দেখি উনার জ্বর। ট্যাবলেট এনে দিলাম। উনি সুস্থ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি তো অবশ্যই দেশের জন্য খেলব।’
তাকে সাড়ে ১২ রুপি দিয়ে বললাম কীভাবে কানারি মেনশনে আসতে হবে।
পরের দিন ইমাম ভাই আসলেন। ইমাম ভাইকে নিয়ে তিন দিন পর প্রতাপ হাজরার ঠিকানায় গেলাম। উনি বললেন, ‘আমরা ডাল ভাজি খেয়ে দেশের জন্য খেলব।’
উনাকে খুঁজতে গিয়ে জেনারেল নুরনবীকে (প্রয়াত) পেলাম। নুরনবী ভাই তখন মোহামেডানের নামকরা গোলকিপার। উনি প্রথম ম্যাচটি ২৫ জুলাই কৃষ্ণকুমার মাঠে খেলেছিলেন। তারপরে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব থেকে লুৎফরের নম্বর পাই।
তারপর হাকিম ভাইকে নিয়ে আসি। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাই। ওখানে বিখ্যাত আলী ইমাম ভাইকে পাই।
আমরা বলার পর ওই দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিউজটা চলতে থাকে বিকেল থেকেই। এই বেতারের খবরে অনেক প্লেয়ার চলে আসল আগরতলা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কী বার্তা দিয়েছিলেন?
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে খেলোয়াড়রা ছিলেন, জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে ও ফান্ড আদায়ের জন্য স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠিত হয়েছে। যারা যেখানে আছেন, এই ঠিকানায় এসে রিপোর্ট করেন।
কেমন সাড়া পেলেন?
আনঅফিসিয়ালি ৬০-৭০ জন ফুটবলার আসছে। আমি বিদায় করেছি তাদের। ভালো প্লেয়ারদের নাম লিস্ট করে রেখেছিলাম। ঢাকার ফার্স্ট ডিভিশন ছাড়া কাউকে নেব না এমন প্ল্যান ছিল। পার্ক সার্কাস মাঠে ৫০-৬০ জন ট্রায়ালে এসেছিল এর মধ্যেও। বাছাই করে নামকরা টিম হয়ে গেল সালাউদ্দিনসহ।
ক্যাম্পের চার্জে থেকে লুৎফর রহমান, প্রতাপ হাজরাসহ চার জনকে বিমানে করে পাঠালাম বাকিদের আনতে। তখন সালাউদ্দিন, আইনুল, এনায়েত এই বিগ স্টারদের নিয়ে আসলেন। বিখ্যাত টিম হয়ে গেল।
কৃষ্ণনগর ম্যাচে পতাকা উত্তোলনে বাধা পেয়েছিলেন। কীভাবে ম্যানেজ করলেন?
কৃষ্ণনগর মাঠে প্রথম ম্যাচ। ওই দিন তো পতাকা ওঠাতে দেবে না। পতাকা নিয়ে মাঠে চক্কর দিব তা করতে দেবে না। তখন আমরা বেঁকে বসলাম, খেলব না। কারণ আমাদের উদ্দেশ্যটাই হলো বিদেশের মাটিতে প্রথম পতাকা উত্তোলন করব। এটা একটা বিশাল ব্যাপার।
তিল ধরার ঠাঁই নাই স্টেডিয়ামে। গাছে ঝুলে সবাই খেলা দেখছে। তখন সারা মাঠ ধরে স্লোগান চলছিল, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।
তারা বলল, আন্তর্জাতিক আইনে পতাকা তোলা নিষেধ। ভারত তখনও আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ওদের জেলা প্রশাসক তখন ডি কে বোস বললেন, ‘সারা ভারত আপনাদের পক্ষে। আমি দায়িত্বে আছি আর কয়দিন? দায়িত্ব না হয় গেলই।’ তখন উনি আমাদের অনুমোদন দিলেন।
স্পোর্টসের যে অ্যাসোসিয়েশন ছিল, তখন তারা বলল আমরা কিছুদিন সাসপেন্ড হব। এই তাদের অবদান। সেই গেমটা আমরা ২-২ ড্র করেছিলাম। প্রথম গোল শাহজাহান ও দ্বিতীয় গোল এনায়েত করেছেন।
দ্বিতীয় ম্যাচে মোহনবাগানের সঙ্গে খেললেন...
তখন মোহনবাগান মানে ভারতের জাতীয় দল। গেস্টপাল একাদশ নাম নিয়ে মোহনবাগান আমাদের সঙ্গে খেলবে। মোহনবাগান স্টেডিয়ামে।
ওখানে বৃষ্টির দিন মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই। আমাদের বুট ছিল ইংলিশ ধরনের। বৃষ্টিতে সুবিধা করতে পারি নাই। আমরা ৪-২ গোলে হারলাম।
দল নিয়ে কোনও কঠিন মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি না?
ভারতে ছিল সবাই। অনেকে বিবাহিত। সন্তান ছিল। তারা সব ছেড়ে দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে গেছে দেশের জন্য।
আমি এদিকে ছিলাম। তখন ওদিকে ম্যানেজার ছিল তান্না। তার দেয়া তথ্য মতে, যখন বিহারে খেলতে গিয়েছিল, ওখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা বাধার সৃষ্টি করে।
ওরা বলেছে নাকি, ‘তোমরা পাকিস্তান ভাঙতেছো হিন্দুদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।’
ওদের ধারণা ছিল, সব প্লেয়ারই হিন্দু। পরে যখন ব্যাখ্যা দেয়া হলো তখন তারা বুঝতে পারল। ওই ম্যাচটা ওখানে হয়েছিল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বিহারে একটা ম্যাচ হয়েছিল। সেই ম্যাচের টাকা বিহারের বন্যার্ত মানুষদের সাহায্যে দান করা হয়েছিল।
কীভাবে ফান্ড সংগ্রহ করলেন?
সেখানে নবাব পতৌদি, দিলীপ কুমারসহ অনেকে ডোনেশন দিয়েছেন। উনারা সবাই মুম্বাই ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন। জাদুকর পিসি সরকারের ছেলে জুনিয়র পিসি সরকার অনুষ্ঠান করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন আমাদের কাছে।
এত বছরেও স্বীকৃতি পেল না স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এ নিয়ে আক্ষেপ হয় না?
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই স্বীকৃতি পেয়েছেন। এত বছরেও স্বাধীন বাংলা দল স্বীকৃতি পায়নি, সেটা বড় আক্ষেপের বিষয়। যদিও পুরস্কারের জন্য ফুটবল নিয়ে মাঠে নামিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার আছে বলেই আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি স্বীকৃতি পাব।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), নওশেরুজ্জামান, আইনুল হক, খোন্দকার নুরুন্নবী, তসলিমউদ্দিন শেখ, আলী ইমাম, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, এনায়েতুর রহমান খান, কাজী সালাউদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মনসুর আলী লালু, ফজলে খোকন, আবদুল হাকিম, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আবদুল মোমিন জোয়ার্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আবদুস সাত্তার, প্রাণগোবিন্দ কুণ্ডু, মুজিবর রহমান, লুৎফর রহমান, অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়, সনজিৎ কুমার দে, মামুনুর রশীদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল, দেওয়ান সিরাজউদ্দিন সিরু, নিহারকান্তি দাস, বীরেন দাস বীরু, আবদুল খালেক ও মোজ্জামেল হক। কোচ: ননী বসাক।