বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এবার ইতালিকে কাঁদালেন পাওলো রসি

  •    
  • ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৭:০৮

১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপের গল্পটা যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে প্রশ্নটা একেবারেই অবান্তর বলে মনে হতেই পারে। বরং তাঁদের সবাইকে একমত হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখি যে, পাওলো রসির আত্মজীবনীর এর চেয়ে ভালো কোনো নাম হতে পারত না।

বিশ্ব জয়ের ২০ বছর পর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী। নাম 'আমি ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছি।'

ইতালি ১৯৮২ বিশ্বকাপ জিতেছে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে। এর আগে সেমিফাইনালে হারিয়েছে পোল্যান্ডকে। তারপরও সেই বিশ্বকাপ জয়ের নায়কের আত্মজীবনীর এই নাম কেন? ব্রাজিলকে হারিয়েই ইতালি বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছিল না কি?

১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপের গল্পটা যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে প্রশ্নটা একেবারেই অবান্তর বলে মনে হতেই পারে। বরং তাঁদের সবাইকে একমত হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখি যে, পাওলো রসির আত্মজীবনীর এর চেয়ে ভালো কোনো নাম হতে পারত না।

সেমিফাইনাল-ফাইনাল জিতেই বিশ্বকাপ জিততে হয়। এই ধ্রুবসত্য নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। কিন্তু ১৯৮২ এমন অবাক করা এক বিশ্বকাপ, যেটির কথা উঠলে সেমিফাইনাল-ফাইনাল ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে অন্য এক একটি ম্যাচ। অফিসিয়ালি দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ। যদিও তা রূপ পেয়েছিল অলিখিত কোয়ার্টার ফাইনালের। ১৯৮২ সালের ৫ জুলাই মহাকাব্যিক সেই ম্যাচের সাক্ষী বার্সেলোনোর এস্তাদিও সারিয়া (এসপানিয়লের মাঠ)। ওই বিশ্বকাপের মীমাংসাও সম্ভবত হয়ে গিয়েছিল সেখানেই। তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত হ্যাটট্রিকে বলতে গেলে একাই যা করে দিয়েছিলেন পাওলো রসি।

ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছেন বলে যে দাবি করেছেন, তা খুবই সত্যি। মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে ফিরেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়েরা। হোটেলে ফেরার পর শেষ টিম মিটিংয়ে আরেক দফা কান্নাকাটি হয়েছে। দেশে ব্রাজিলিয়ানরাও নিশ্চয়ই কেঁদেছে। সেই কান্নার নাম পাওলো রসি। সেই ম্যাচের ফল তো আক্ষরিক অর্থেই: রসি ৩-ব্রাজিল ২।

সেমিফাইনালে ইতালির দুটি গোলই রসির। ফাইনালে ৩-১ গোলে জয়ের প্রথমটিও। তারপরও পাওলো রসি মানেই সিয়ারা স্টেডিয়ামের ওই ম্যাচ। মনে হয় না বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর কোনো একটা ম্যাচ একজন খেলোয়াড়ের এমন সমার্থক হয়ে আছে। তুলনায় আসতে পারে শুধু ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড। যেটি কাগজে-কলমেই কোয়ার্টার ফাইনাল এবং যে ম্যাচ মানেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা।

পাওলো রসির কীর্তধন্য ১৯৮২ বিশ্বকাপেই ম্যারাডোনার আবির্ভাব। মাঠেও দুজনের দেখা হয়েছিল। ব্রাজিলের বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগেই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়েছে রসির ইতালি এবং জিতেছে ২-১ গোলে। কী অদ্ভুত দেখুন, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পনের দিনের মধ্যেই রসিরও এই পৃথিবীর পাট চুকিয়ে অনন্তলোকে যাত্রা।

ব্রাজিলের বিপক্ষে ইতালির জয়ের মাহাত্ম্য বোঝানোর কাজটা একটু পরে করছি। আগে ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্যতিক্রমী ফরম্যাটের কথাটা বলে নেওয়া ভালো। ইতালি-ব্রাজিল ম্যাচটা বোঝাতেও তা জরুরি। গ্রুপ পর্বের পরই নকআউট শুরু হয়ে যাওয়ার বদলে সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনটি করে দল নিয়ে চারটি গ্রুপ। কোয়ার্টার ফাইনাল বলে কিছু নেই। গ্রুপ চ্যাম্পিয়নরা উঠে যাবে সেমিফাইনালে। গ্রুপের তিন ম্যাচেই দর্শকের মন রাঙিয়ে হেসেখেলে জিতেছে ব্রাজিল। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে গ্রুপে পেয়ে গেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও আগের বারের চতুর্থ ইতালিকে। কারণ এই দুই দল হয়েছে রানার্স আপ। আর্জেন্টিনা উদ্বোধনী ম্যাচেই বেলজিয়ামের কাছে হেরে বসার পর পরের দুই ম্যাচ জিতলেও ইতালি দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে রীতিমতো কেঁদে কঁকিয়ে। গ্রুপের বাকি তিন দল পোল্যান্ড, পেরু ও ক্যামেরুনের সঙ্গেই ড্র। ওই বিশ্বকাপেই অভিষিক্ত ক্যামেরুনও তিন ম্যাচই ড্র করায় দুই দলের পয়েন্ট সমান, গোল পার্থক্যও। ইতালির পরের রাউন্ডে উত্তরণ ক্যামেরুনের চেয়ে শুধুই একটি গোল বেশি করার কল্যাণে।

গ্রুপ পর্বে যে পারফরম্যান্স, তাতে ইতালির বিশ্বকাপ দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে টপকে ওই ছন্নছাড়া ওই দলের সেমিফাইনালে ওঠার পক্ষে ইতালিয়ানরাও বাজি ধরেছিলেন বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় রাউন্ডে সেই ছন্নছাড়া দলই বদলে গেল ভোজবাজির মতো। প্রথম ম্যাচে হারিয়ে দিল আর্জেন্টিনাকে এবং জেতার মতো খেলেই। তাতে কি! ব্রাজিলের কাছে এই ইতালি পাত্তা পাবে না কি! ইতালির মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্রাজিল খেলেছে স্বপ্নের ফুটবল এবং এই ম্যাচে তাদের ড্র হলেই চলে। কারণ আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে হারানোয় গোল ব্যবধানে তারাই এগিয়ে। এই সুক্ষ্ম হিসাবের কোনো প্রয়োজন পড়বে বলেও কেউ ভাবেননি। ব্রাজিলের সেই দলে তারকার মেলা। সক্রেটিস, জিকো, ফ্যালকাও, সেরেজো, জুনিয়র, এডার, অস্কার...বল পায়ে যাঁরা ফুল ফোটাচ্ছেন মাঠে। বাঁধনহারা, মুক্ত আক্রমণাত্মক ফুটবলের এক প্রদর্শনী দর্শকের চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে মায়াঞ্জন। ১৯৭০ বিশ্বকাপের যে ব্রাজিল দলকে ফুটবলীয় উৎকর্ষের চূড়া বলে ধরা হয়, সেটিকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে কোচ টেলে সান্টানার "আক্রমণই শেষ কথা" মন্ত্রে দীক্ষিত এই দল। কাল হলো হয়তো এই দর্শনই। ৫ মিনিটে রসির প্রথম গোল, ২৫ মিনিটে দ্বিতীয়। দুইবারই পিছিয়ে পড়ার পর সমতা এনেছে ব্রাজিল। ৬৮ মিনিটে ২-২ হওয়ার পর অন্য যেকোনো দল বাকি সময়টা একটু রক্ষণাত্মক খেলে কাজের কাজটা করে নিত। কিন্তু ওই ব্রাজিল দল আক্রমণাত্মক ফুটবল ছাড়া আর কিছু খেলতে জানলে তো!

আর পাওলো রসিও যেন সেদিন সব অপমানের জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে নেমেছিলেন। ৭৪ মিনিটে তৃতীয়বারের মতো এগিয়ে দিলেন ইতালিকে, শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত ইতালি এগিয়েই থাকল। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালির বদলে যাওয়ার কথা বলছিলাম। সেই বদলের প্রতীকি রূপও পাওলো রসিই। আগের চার ম্যাচে কোনো গোল তো নেই-ই, গোল করার কোনো সম্ভাবনাও জাগাতে ব্যর্থ। যাঁকে নিয়ে পত্রিকায় লেখা হচ্ছে,"লক্ষ্যহীনভাবে এক ভুত যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে।" তাঁকে দলে নেওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে ইতালিয়ান সংবাদ মাধ্যমে। সমালোচনার সব তিরই কোচ এনজো বিয়ারজোটের দিকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই তিক্ত হয়ে গেছে যে, দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেই সংবাদ মাধ্যমকে অচ্ছুত বলে ঘোষণা করেছেন ইতালির বিয়ারজোট। ইতালিয়ান ফুটবলে যা বিখ্যাত হয়ে আছে "সাইলেনজিও স্টাম্পা" নামে।

ব্রাজিলের বিপক্ষে যে ম্যাচ নিশ্চিত করে দিয়েছে রসির অমরত্ব, তাতে ম্যাচের পঞ্চম মিনিটেই রসির প্রথম গোল। ইউটিউবে সেই ম্যাচটি যদি দেখেন, গোলের আগে ওটুকু সময়ের মধ্যেই দলে রসির অন্তভূর্ক্তি নিয়ে বিতর্কের কথা একাধিকবার বলতে শুনবেন ধারাভাষ্যকারকে। বিতর্ক তো আর এমনি এমনি হয়নি। রসির তো ওই বিশ্বকাপে খেলারই কথা না। ১৯৮০ সালে ইতালিয়ান ফুটবলকে টালমাটাল করে দেওয়া "টটেনেরো" (ব্ল্যাক লটারি) নামে কুখ্যাত ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গেছে তাঁর নামও। ২-২ গোলে ড্র হওয়া পেরুজিয়া-অ্যাভেলিনো ম্যাচটি ফিক্সড ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তা নিশ্চিত করতে আরও অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে পেরুজিয়ার রসিকেও ২ মিলিয়ন লিরা দেওয়া হয়েছে বলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুজন। রসি নিষিদ্ধ হয়েছেন তিন বছরের জন্য। যার মানে ১৯৮২ বিশ্বকাপের সময় তাঁর নিষিদ্ধই থাকার কথা। সেই নিষেধাজ্ঞা এক বছর কমে যাওয়ায় ভূমিকা আছে কোচ এনজো বিয়ারজোটের। বিশ্বকাপে যে তাঁর রসিকে লাগবেই।

এর আগেই একটি বিশ্বকাপ খেলেছেন রসি। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে গোলও করেছেন ৩টি। জিতেছেন দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সিলভার বল। বিয়ারজোট কেন তাঁকে দলে চেয়েছেন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু গায়ে ওই কলঙ্কের ছাপ আর দুই বছর ফুটবলের বাইরে থাকা মিলিয়ে রসির দলভূক্তি মোটেই জনসমর্থন পায়নি। সেই রসিই বিশ্বকাপের পর ইতালিয়ানদের নয়নমণি।

রসির জন্য এটিকে তাই পাপমোচনের বিশ্বকাপ বলতেই পারেন। প্রায়শ্চিত্তের বিশ্বকাপও। নিজেকে অবশ্য বরাবরই নির্দোষ দাবি করে গেছেন রসি, তবে ১৯৮২ বিশ্বকাপের পরই শুধু তা বিশ্বাস করার লোক পাওয়া গেছে ইতালিতে। ছয় গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার গোল্ডেন বুট, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলও তাঁর, পরে যার সঙ্গে যোগ হয়েছে তখন শুধুই ইউরোপিয়ান ফুটবলারদের জন্য বরাদ্দ ব্যালন ডি'অরও। বিশ্বকাপের সঙ্গে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বলও জিতেছেন আরও দুজন--১৯৬২ সালে ব্রাজিলের গারিঞ্চা ও ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেস। তবে একই বছরে বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল আর ব্যালন ডি'অর---এই চতুষ্টয় জয়ের কীর্তি পাওলো রসি ছাড়া আর কারও নেই।

আরেক দিক থেকেও অনন্য বলতে হয় তাঁকে। বিশ্বকাপ রাঙানো অন্য সব ফুটবলারেরই ক্লাব পর্যায়ে বেশি অর্জন। ইতালির প্রথম স্ট্রাইকার হিসাবে পরপর দুই মৌসুমে সিরি 'বি' ও সিরি 'আ'র সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েছেন, ১৯৮৪ সালে জুভেন্টাসের হয়ে জিতেছেন ইউরোপিয়ান কাপ (এখন যা চ্যাম্পিয়নস লিগ), তারপরও রসির ক্লাব ক্যারিয়ারকে মোটেই আহামরি কিছু বলা যাবে না। পাওলো রসিকে চিনতে তাই বিশ্বকাপেই ফিরে যেতে হয়।

সেই বিশ্বকাপেও বলতে গেলে শুধু গোলই করেছেন। গোল করার সহজাত দক্ষতা নিয়েই জন্মেছিলেন। এর বাইরে এমন বিশেষ কিছু ছিল না, যা দেখে দর্শক আহা-উহু করবেন! বিশ্বকাপের রসিকে মনে করতে গেলেও চোখে তাই শুধু গোলগুলিই ভাসে। সেগুলোও বিশ্বকাপের সবচেয়ে দর্শনীয় গোলের তালিকায় স্থান পাওয়ার মতো নয়। তাতে কি, ওই গোলগুলো করেই তো দেশকে এনে দিয়েছেন একটা বিশ্বকাপ। সেই ১৯৩৪ আর ১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপের আদিকালে পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইতালি। এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা...। আবার বিশ্বকাপ হাতে নিতে ইতালির ৪৪ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান পাওলো রসির কল্যাণে। ফুটবল পাগল ইতালিয়ানদের হৃদয়ে রসির জন্য আলাদা একটা জায়গা তো তাই বরাদ্দ থাকবেই। তাঁর মৃত্যুতে কাঁদবেই ইতালি।

১৯৮২ সালে ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিলেন, ৩৮ বছর পর ইতালিকেও কাঁদালেন পাওলো রসি।

এ বিভাগের আরো খবর