সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তবে মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ব্যারিস্টার সুমন হিসেবে।
সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন এই আইনজীবী। কিছুদিন আগে নিজ এলাকা হবিগঞ্জে চালু করেছেন ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমি।
নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় সুমন কথা বললেন ফুটবল নিয়ে তার ভালোবাসা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও ফেডারেশন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে।
আপনার ফুটবল প্রেমের শুরু কীভাবে?
১৯৯৫ সালে। আমি কিন্তু ঢাকায় পড়াশোনার জন্য না, ফুটবল খেলতে এসেছিলাম। এখানে পাইওনিয়ার লিগ খেলতে আসছিলাম; মিরপুরে সূর্যশিখা সংসদ নামে একটা ক্লাবে। এখানে আসার পর আমি কিছুদিন ফুটবল খেলি। তারপর দেখলাম যে ফুটবলের চেয়ে আমার ভবিষ্যৎ পড়াশোনাই বেশি। তাই আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে যাই। ফুটবল যদিও আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, প্রেমটা থেকে গিয়েছিল।
ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এত লম্বা সময় ধরে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখলেন কীভাবে?
ফুটবলটা আমার প্রেম, ফুটবলটা আমার নেশা। এই প্রেম এবং নেশা দুইটি কখনই আমাকে ছেড়ে যায়নি বা আমিও এদের ছেড়ে যাইনি। আমি সময় পেলেই ফুটবল খেলেছি। এটা আবার যোগ হয়েছে করোনার সময়ে। আমি দেখলাম যে, ফিট থাকার জন্য আমার কাছে সেরা উপায় হচ্ছে ফুটবল। তাই আমার প্রেমের কাছে আমি ফিরে গেলাম।
আপনি ইংল্যান্ডে যখন ছিলেন, ওদের ফুটবল কি আপনার একাডেমি বানানোর চিন্তায় প্রভাব রেখেছে?
অবশ্যই। ইংল্যান্ডের যে স্টাইল, এটা খুবই ভালো এবং বৃহৎ। আমাদেরটা এত বড় না। কিন্তু প্রেমটা খুব আদিম এবং শক্তিশালী।
একাডেমি তৈরির চিন্তাটা আপনার মাথায় কীভাবে আসল?
করোনার সময়ে আমার কিছু করার ছিল না। দেখলাম আইসিইউও পাওয়া যাচ্ছে না বাংলাদেশে। এর মানে, বাঁচতে হবে নিজের যোগ্যতাতেই। এত টাকাও নেই যে করোনা হলে একটা আইসিইউতে গিয়ে আমি বিল দিতে পারব। তখন চিন্তা করলাম নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েই বাঁচতে চাই। এটার জন্য ফিটনেস দরকার। যেহেতু আমি ফুটবল খেলি, মনে করলাম যে শুধু আমি খেলব না। যেহেতু সুযোগ পেয়েছি আমার এলাকার কিছু লোককে ফুটবলের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে চাই। আমার এই কনসেপ্টটা দিয়ে আমি শুরু করে দিলাম একাডেমির কাজ।
ব্যারিস্টার সুমনের একাডেমির খেলোয়াড়রা। ছবি: সংগৃহীতএকাডেমি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এই একাডেমির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলতে চাই। মানুষকে আমি সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলতে চাই। আস্তে আস্তে ফুটবলের একটা নতুন জেনারেশন চাই যারা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবে।
আপনার একাডেমির খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেন?
অবশ্যই। প্রতিটা একাডেমি, প্রতিটা ক্লাব - তাদের তো একটা মিশন থাকেই উন্নতি করার। আমরা একই সময়ে উপরে যেতে চাই এবং উপরে যাওয়ার জন্য সারা বাংলাদেশে যেন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। শুধু আমরা উপরে যেতে চাই না। সারা বাংলাদেশের তৃণমূল যেন উপরে আসে সেই কাজটাও করতে চাই।
আপনি একজন ব্যারিস্টার। ব্যস্ত জীবন কাটান। পাশাপাশি ফুটবল একাডেমি চালু করেছেন। আপনার জন্য ব্যাপারটি কতখানি কঠিন?
প্রকৃত প্রেম সবসময় এমন না যে কাছেই টানে। কিছু কিছু সময় দূরেও ঠেলে দেয়। ব্যাপারটা এমন না যে শারীরিকভাবে আপনাকে সব জায়গায় থাকতে হবে। আপনি যদি হৃদয় দিয়ে কোনো কিছু চেষ্টা করেন, দেখবেন যে অনেক বেশি কাজ করতে পারছেন। শুক্র, শনিবার আমি এদের সাথে থাকি। ওদেরকে আমি খরচ দিতে পারলাম কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। রোববার থেকে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে যে কাজ করি, সেটার একটা উৎসাহ পাই যে ওখানে বেশি টাকা আয় করতে পারলে আমার ফুটবলারদের দিতে পারব। এটাও আমি মনে করি তাদের সাথে থাকার মতোই।
বাংলাদেশ ফুটবলের উন্নয়নের জন্য কী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
এই ফুটবল ফেডারশনকে বদলাতে হবে। বর্তমান ফুটবল ফেডারেশন আমি মনে করি একদম ব্যর্থ। আরেকটা হচ্ছে, সরকারিভাবে ফুটবলকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। ১২ বছর হয়ে গিয়েছে। একই ফেডারেশন, একই সভাপতি। অথচ ধাপের পর ধাপ নিচে নামছে ফুটবল। উনার (সালাউদ্দিন) তো নৈতিক কারণেই রিজাইন করা উচিত ছিল। কিন্তু একই ব্যক্তি আবার নেতা হচ্ছেন। তো ফলাফল যা হওয়ার হবে। ভয়ানক পরিণতি হবে ফুটবলের।
ফুটবল পায়ে ব্যারিস্টার সুমন। ছবি: সংগৃহীতবাফুফের হয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে?
আমার এই বাফুফের প্রতিই তো আস্থা নেই। আমি মনে করি যে ফুটবল দিন দিন নিচের দিকে নামছে। ১২ বছরে প্রায় ৭৭ ধাপ নিচে নেমে গেছে। বাফুফে নিয়ে কথা বলাটা তো বোকার স্বর্গে বসবাস করা। উনারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বারবার নেতা হচ্ছেন। আমি মনে করি বাফুফে বাংলাদেশের ফুটবলকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না।
ক্ষমতা পেলে আপনি কী ধরনের কাজ করতেন?
ক্ষমতা পাওয়ার আগে আমি যা করছি, সাথে ক্ষমতা যদি যোগ হয়, তাহলে তো কাজ আরও দ্রুত হবে। অনেক দূর যাওয়া যাবে। আমি ক্ষমতা পাব এই চিন্তা করে বসে থাকতে চাই না। এমনও তো হতে পারে আমি কোনোদিনই ক্ষমতা পাব না। এর মানে কি দায়িত্ব শেষ? আমি চাই, ক্ষমতা আসুক বা না আসুক, এই সময়টুকু আমি কাজে লাগাতে চাই। তরুণদের বা যারা ধনী আছেন তাদের বলতে চাই, আপনারাও এই জায়গাটিতে একটু বিনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের ফুটবল বেঁচে গেলে মাদক থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারব অনেকটুকু।
তার মানে কী বাফুফের সাথে কখনোই কাজ করবেন না?
আমি শুধু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাথে সম্পৃক্ত হতে চাই না। বাংলাদেশের ফুটবলের সাথে সম্পৃক্ত হতে চাই। ব্যাপারটি এমন না যে সবসময় এমপি-মন্ত্রী হয়েই আপনাকে সেবা করতে হবে বা ফুটবলের নেতা না হলে আপনি করতে পারবেন না। এখন যা আছে আমার, তা নিয়েই আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। ভবিষ্যৎ তো ভবিষ্যতের জায়গায়। আমি এখনই সেটা নিয়ে চিন্তা করতে চাচ্ছি না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নেতা হবে তো একজন। ওই একজনই যদি কাজ করতে চায়, তাহলে তো হবে না। আপনাকে অনেক মানুষের সম্মেলন ঘটাতে হবে এখানে।
আপনার কাজের ক্ষেত্রে বাফুফে একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম হতো না?
সবসময় তো সব জিনিস হয়ে ওঠে না। কিছু সময় বিকল্প রাস্তাতেও বিপ্লব হয়। আর আমার ক্ষমতার ইচ্ছাটা নেই। আমি ফুটবলকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছি। সেই পথে যদি ক্ষমতা আসে তাহলে তাকে আমি অস্বীকার করব না। যদি বলে যে বাফুফেতে থাকলে আপনার কাজগুলো আরও ভালো হবে, এতে আমার আপত্তি নেই। বাফুফের ক্লার্ক বা বলবয় হলেও যদি ফুটবল আগায়, আমি যেতে রাজি।
তাহলে কি আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন?
পরিস্থিতিতে যদি মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষের যদি মনে হয়, ওই সময়ে বাফুফেতে গেলে আমি বাইরে থেকে যে কাজটা করছি সেটা আরও এগোবে, তাহলে আমি যেতে রাজি আছি। তবে ব্যাপারটা এমন না যে, বাইরে থেকে কাজ করা কমিয়ে নেতৃত্ব নিতে চাই। তাহলে কাজ হবে না।
ব্যারিস্টার সুমন একাডেমির খেলোয়াড়দের সাথে সুমন। ছবি: সংগৃহীতবর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সালাউদ্দিন সাহেবের ব্যাপারে বক্তব্য একটাই, শেষ বয়সেও তো মানুষ মুমিন মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ জীবনে মানুষ কিছুটা পুণ্যের চিন্তা করে। উনার উদ্দেশে বলব, অনেক তো নিচে নামিয়েছেন ফুটবলকে। উনি না নামালেও উনার আমলে যেহেতু নেমেছে, দায় তো উনাকে নিতে হবে। তার প্রতি অনুরোধ থাকবে যেহেতু আপনি আবার আসছেন ক্ষমতায় চার বছরের জন্য, কীভাবে আসছেন সে প্রশ্ন আর তুললাম না। বলছেন এইবারের পর আপনি আর আসবেন না। এমন কিছু অন্তত করে যান, যেটায় পাপমুক্তি হয়।
আপনার একাডেমি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসা যেমন হয়েছে, তেমন হয়েছে হাসি-ঠাট্টাও। এই বিষয়ে আপনার মত কী?
কোনো বিষয় নিয়ে লোকে যদি হাসাহাসি না করে, তাহলে নিশ্চিত থাকেন এটা ইতিহাসের অংশ হবে না। আপনি যদি ইতিহাস তৈরি করতে চান, তাহলে প্রথমে মানুষ হাসাহাসি করবে। আর বাংলাদেশের মানুষই এ রকম। আপনি যখন কোনো কিছু শুরু করবেন, মানুষ হাসাহাসি করবে। এরপর যখন কিছুটা আগাবেন, তখন বলবে, আর কোনো কাজ নেই মনে হয়। আর আপনি যখন সফল হবেন, তখন এই মানুষগুলোই বলবে, আমরা জানতাম ও পারবে।