বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দল চট্টগ্রাম আবাহনীতে খেলছেন মান্নাফ রাব্বি। জাতীয় দলেও খেলেছেন। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লাল-সবুজ জার্সিতে খেলছেন রহমত মিয়া।চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ মাতিয়ে বসুন্ধরা কিংসের জার্সিতে খেলছেন স্ট্রাইকার রিমন হোসেন ও গোলকিপার মেহেদী হাসান। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলো ছড়ানো এরা সবাই অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা ফুটবলার।
রহমত-রাব্বি-মেহেদী-রিমনসহ অগণিত ফুটবলার থিতু হয়েছেন ঢাকার ফুটবলে। তারা সবাই ‘দেশসেরা’ তিন ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে উঠে এসেছেন।
তবে দেশের ফুটবলের জন্য এমন অনেক খেলোয়াড় তৈরি করা তিন ফুটবল অ্যাকাডেমির জায়গা হয়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ‘জাতীয় অ্যাকাডেমি স্বীকৃতি প্রকল্পে’।
সম্প্রতি এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) চালু করা ‘অ্যাকাডেমি অ্যাক্রিডিটেশন স্কিম’ এর আওতায় দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলোকে নিবন্ধন করানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাফুফে।
এই প্রকল্পের আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ৭৮টি অ্যাকাডেমিকে নিবন্ধন এবং স্টার রেটিং দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে ফেডারেশন।
এখান থেকেই জন্ম বিতর্কের।
বাফুফের নিবন্ধনের আওতাভুক্ত হয়নি দেশের অন্যতম সেরা ও সুপরিচিত ফুটবলার তৈরির কারখানা যশোরের শামসুল হুদা অ্যাকাডেমি, মাগুরার আসাদুজ্জামান স্পোর্টস অ্যাকাডেমি ও বেনাপোলের আলহাজ নুরুল ইসলাম অ্যাকাডেমি।
ফেডারেশনের প্রাথমিক তালিকাভুক্ত ১২১ অ্যাকাডেমির মধ্যে তাদের নাম থাকলেও চূড়ান্ত নিবন্ধনে কোনো এক ‘অদৃশ্য কারণে’ বাদ পড়েছে ফুটবলার তৈরির তিন আঁতুরঘর।
বাফুফে থেকে চাওয়া কাগজপত্র জমা দিয়েছে যশোরের শামসুল হুদা অ্যাকাডেমি ও আলহাজ নুরুল ইসলাম অ্যাকাডেমি। কাগজপত্র জমা দেয়নি মাগুরার আসাদুজ্জামান স্পোর্টস অ্যাকাডেমি।
স্বীকৃতি না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের মানদণ্ডের অধীনে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহকারী অ্যাকাডেমিকেই মূল্যায়ন করা হয়েছে।’
নিবন্ধনের পাশাপাশি ৭৮ অ্যাকাডেমিকে ‘স্টার পদ্ধতির’ আওতায় নিয়েছে ফেডারেশন। এক স্টারের জন্য শর্ত দেয়া হয়েছে ১৮টি, দুই স্টারের জন্য ২৮ ও তিন স্টারের জন্য ৩২টি শর্ত দেয়া হয়েছে। প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক ভবন, অনুশীলনের মাঠসহ ফিজিও নিয়োগের শর্ত দেয়া হয়েছে।
দেশের সিংহভাগ ক্লাবই এ শর্ত পূরণ করে না। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্লাবগুলোও এসব শর্ত পূরণ করতে পারে না। সেই অর্থে ক্লাবের অ্যাকাডেমিও নেই।
ক্লাবমহল যখন বেহাল তখন দেশের গুটিকয়েক অ্যাকাডেমি এই শর্তগুলো কিছুটা হলেও পূরণ করে। তাদের মধ্যে বাফুফের স্বীকৃতি না পাওয়া যশোরের শামসুল হুদা অ্যাকাডেমি অন্যতম।
২০১১ সালে জেলার সদর উপজেলার হামিদপুরে ৪৫ বিঘা জমির উপরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই ফুটবল অ্যাকাডেমি। ছয় জন কোচকে নিয়ে তিনটি বয়সভিত্তিক দলের ৯০ জন ফুটবলারকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রশিক্ষণ দেয় প্রতিষ্ঠানটি।ফুটবলারদের জন্য রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে তিনটি পূর্ণাঙ্গ মাঠ ও আধুনিক জিমনেসিয়াম।
বয়সভিত্তিক জাতীয় দল, সিনিয়র জাতীয় দলসহ ঢাকার ফুটবলে অগণিত ফুটবলার সাপ্লাউ দেয়া এই স্বয়ংসম্পূর্ণ অ্যাকাডেমি কাগজপত্র জমা দিয়েও নিবন্ধন পায়নি বাফুফের।
অ্যাকাডেমির প্রধান কোচ কাজী মারুফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেডারেশন, যা কাগজপত্র চেয়েছে তাই দিয়েছি। পাইওনিয়ার থেকে প্রিমিয়ার লিগ, দেশের ফুটবলে অনেক ফুটবলার দিয়েছি। আর আমরাই কিনা নিবন্ধন পেলাম না! কেন পাইনি তাও জানি না।’
পরে অবশ্য তাদের সঙ্গে ফেডারেশন ইমেইলে যোগাযোগ করেছে বলে জানান কাজী মারুফ।
কাগজপত্র জমা না দিলেও নিবন্ধনের আগে বাফুফেকে অ্যাকাডেমি পরিদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিলেন মাগুরার আসাদুজ্জামান স্পোর্টস অ্যাকাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান লাজুক। ২০১২ সালে এই অ্যাকাডেমির উদ্বোধন করেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। অ্যাকাডেমির একটি দল এখন পাইওনিয়ার লিগ থেকে তৃতীয় ডিভিশনে উন্নীত হয়েছে।
তিনটি বয়সভিত্তিক দলে প্রায় ১২০ জন ফুটবলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এই অ্যাকাডেমিতে। সনদপ্রাপ্ত কোচেরা তিন জায়গায় তিনটি মাঠে ফুটবলার গড়ার কাজে নিমগ্ন।
পরিদর্শনের আহ্বান জানালেও বেশিরভাগ অ্যাকাডেমিতে পরিদর্শন না করেই নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান লাজুক।
তার দাবি, ‘আমার অ্যাকাডেমি পরিদর্শন করতে বলেছি। পরিদর্শন করে তারা নিবন্ধন দিক কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু তারা পরিদর্শন করেনি। আমার অ্যাকাডেমি সম্পর্কে বাফুফের সবাই ওয়াকিবহাল। থার্ড ডিভিশনে আছে অ্যাকাডেমি। খোদ সভাপতি (কাজী সালাউদ্দিন) উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু নিবন্ধন দিল না।’
একই অবস্থা বেনাপোলের আলহাজ নুরুল ইসলাম অ্যাকাডেমিরও। কাগজপত্র জমা দিয়েও মেলেনি স্বীকৃতি। জাতীয় দলের সাবেক মিডফিল্ডার সাব্বির আহমেদ নিজ উদ্যোগে ২০১৬ সালে এই অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। নিজেই তিন বয়স গ্রুপে প্রায় দেড় শতাধিক খুদে ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দেন।
তার অ্যাকাডেমি থেকে বের হওয়া ফুটবলাররা এখন ঢাকার ফুটবলে খেলছে। তাদের মধ্যে একজন মেহেদী হাসান এখন খেলছেন বসুন্ধরা কিংসের হয়ে। ২০১৮ সালে নেপালের অনূর্ধ্ব ১৮ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশকে শিরোপা এনে দেয়া গোলকিপার মেহেদী এই অ্যাকাডেমিরই ছাত্র।
নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন এই অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও কোচ সাব্বির আহমেদ। বলেন, ‘আমি তো কোনো সুযোগ-সুবিধা চাই না বাফুফের কাছ থেকে। শুধু চেয়েছিলাম একটা স্বীকৃতি। তারা কাগজপত্র চেয়েছে। আমি দিয়েছি। জাতীয় দলে খেলেছি, এখন দেশের জন্য ফুটবলার তৈরি করছি। একটা স্বীকৃতি চেয়েছি।’
কাগজপত্র জমা দিয়েও নিবন্ধন না পাওয়ার কোনো কারণ দেখছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না ঠিক কী কারণে স্বীকৃতি পেলাম না। কেউ পরিদর্শন করেনি আমার অ্যাকাডেমি। শুধু কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন করা যায় না।’
অ্যাকাডেমি পরিদর্শন না করার বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেছে বাফুফে। আগামী বছর এই তিন অ্যাকাডেমির নিবন্ধনের আওতাভুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন বাফুফের টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান পারভেজ বাবু।
তিনি বলেন, ‘কাগজপত্রের অভাবে ভালো কিছু অ্যাকাডেমি নিবন্ধনের সুযোগ পায়নি। ভবিষ্যতে তাদের জন্য সুযোগ আছে।’