ডিয়েগো ম্যারাডোনা বিদায় নিয়েছেন। নেপলসের অবিসংবাদিত সম্রাট বিদায় বলেছেন সবাইকে। নক্ষত্রেরও পতন হয়। ঈশ্বরেরও মৃত্যু হয়।
নেপলসে আজ শোকের রাত। নেপলস ছেড়েছিলেন ১৯৯২ সালে। ডোপ টেস্টে নিষিদ্ধ হয়ে ১৫ মাস মাঠের বাইরে কাটানোর পর। অথচ ঠিক তার বিদায়ের পরের দিন ফর্সেলা কোয়ার্টারের এক দেয়ালে লেখা দেখা গেল, ‘ডিয়েগো, আমাদের আবার স্বপ্ন দেখাও!’
অথচ, ম্যারাডোনা নাপোলিতে আসবেন, সে কথা কে ভেবেছিল? ১৯৮২ সালে বিশ্বরেকর্ড ট্রান্সফার ফি দিয়েই বার্সেলোনায় পাড়ি দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।১৯৮৪ সালে ম্যারাডোনা যখন নাপোলিতে আসলেন, নাপোলি তখন ইতালির সেরা দল হওয়া দূরে থাক, বরং কোনমতে সেরি আতে টিকে থাকাই তাদের দায়।ইতালিয়ান ঘরোয়া ফুটবলের শিরোপা তখন তাদের জন্য ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতই ব্যাপার। বিশ্বের সেরা ফুটবলার কেন সেই ক্লাবে যাবেন!
পাঁচ মিলিয়ন ইউরো, তাকে আনতে নাপোলিকে ভাঙতে হয় ট্রান্সফার ফির বিশ্বরেকর্ড। নাপোলির যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, তারা বলবে সস্তায় পেয়েছিলেন। ঈশ্বরের কী মূল্য হয়!
১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জিতে ফিরে প্রথম মৌসুমে নাপোলির ঘরে নিয়ে আসেন প্রথম সেরি আ শিরোপা। মর্ত্যের মানুষ থেকে হয়ে গেলেন স্বর্গের আরাধ্য।
এতদিন সেরি আ বরাদ্দ থাকতো উত্তর ইতালির উচ্চবিত্তের ক্লাব ইউভেন্তাস, এসি মিলানের কাছে। নেপলস তাদের কাছে ছিলো কলেরা-আক্রান্ত, মাউন্ট ভিসুভিয়াসের নগ্ন আক্রোশের চারণভূমি। ভূমিকম্পের আঘাত ও আর্জেন্টাইন অভিবাসীতে পর্যদুস্ত। ইতালির নাপোলি ছিল দক্ষিণ অংশের সাধারণ মানুষদের ক্লাব, অপরাধ-জগতের স্বর্গ। সেই শহরে ম্যারাডোনা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
নেপলস আর ম্যারাডোনাকে নিয়ে সাবেক স্টোক সিটি খেলোয়াড় অ্যালান হাডসন বলেছিলেন, ‘যে শহরে শয়তানেরও দেহরক্ষীর প্রয়োজন পড়তো, ম্যারাডোনা সেখানে ঈশ্বরের চেয়েও বড় ছিলেন।’
ম্যারাডোনা নাপোলির। নাপোলি ম্যারাডোনার। পরের মৌসুমে নাপোলিকে এবার বানালেন ইউরোপ-সেরা। তার পরের বছর আরেকটা লিগ জিতিয়ে বললেন, ক্লাব ছাড়তে চান। নাপোলি প্রেসিডেন্ট রাজি হলেন না। জমা হলো ক্ষোভ, এবং সেখান থেকেই নক্ষত্র পতনের শুরু।
সেই সময়েও ম্যারাডোনা জড়িয়ে পড়েন কামারো মাফিয়া পরিবার সাথে। আগে থেকেই ছিলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা। এবার প্রয়োজন পড়ে কোকেনের। সেই প্রয়োজন পরিণত হয় নেশায়, এবং সেখান থেকে অতল গহ্বর।
১৯৯১ এর জানুয়ারিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইতালিকে হারানোর প্রতিশোধ হিসেবে, ম্যারাডোনার ওপর থেকে নেপলসের মাফিয়া পরিবার ও জনগণের সমর্থনের হাত সরে যায়।এক বিচারে স্থগিত দণ্ড পান ১৪ মাসের। জরিমানা হয় পাঁচ মিলিয়ন ইউরো। এপ্রিলে পাস করতে পারলেন না ড্রাগ টেস্টে। ১৪ মাসের জন্য ফুটবল থেকে পান নিষেধাজ্ঞা।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর নাপোলিতে থাকেননি। সেখান থেকে যান সেভিয়ায়। তারপর নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ঘুরে ক্যারিয়ারের শেষ টেনেছিলেন বোকা জুনিয়র্সে। কিন্তু নাপোলির মত কেউ তাকে ভালোবাসেনি।
ইতালির সঙ্গে আর্জেন্টিনা ম্যাচে নাপোলি আল্ট্রারা স্রেফ ম্যারাডোনার জন্য আর্জেন্টিনাকে সমর্থন কেনো দিবেন! নইলে এক ভিনদেশীর জন্য তার মৃত্যুর পর নাপোলি প্রেসিডেন্ট কেন বলবেন, তার নামে স্টেডিয়ামের নাম রাখার চিন্তা করছেন। কেন শহরের সন্ত গেরানোর মত করে তাকে ডাকা হবে সন্ত গেরামান্দো!
ম্যারাডোনার আগমনের পর নাপোলির দিকে তীর্যক ও বর্ণবাদী মন্তব্য ছুড়ে দিতো উত্তরের অভিজাত ক্লাবগুলো। তখন নাপোলি দর্শকরা স্লোগান ধরতেন, ‘মা, আমার হৃদয় এমন করছে কেন? কারণ আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি। আমি প্রেমে পড়েছি।’
ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার। কিন্তু নেপলসকে বানিয়েছিলেন নিজের। মিশে গিয়েছিলেন শহরের সবটুকুর সাথে। শহরের দেয়ালে দেয়ালে তার গ্রাফিতিগুলো সাক্ষ্য দেয় সে কথার। দিতে থাকবে অনন্ত কাল।