১৯৫৩ সালের ২৫ নভেম্বর ইংল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ৬-৩ গোলে হারায় সফরকারী হাঙ্গেরি। বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে সেটাই ছিল ইংল্যান্ডের প্রথম হার। ম্যাচটি তখনকার ব্রিটিশ মিডিয়ায় পরিচিতি পায় ‘ম্যাচ অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নামে।
তিন বছর ধরে অপরাজিত হাঙ্গেরি ইংলিশ মিডিয়ার কাছে ছিল অপরিচিত। এই ম্যাচের পর পালটে যায় সবকিছু।
ইংল্যান্ডকে হটিয়ে হাঙ্গেরি হয়ে ওঠে ইউরোপিয়ান ফুটবলের নতুন সম্রাট। ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’ ইউরোপিয়ান ফুটবল শাসন করে পুরো পঞ্চাশের দশক।
ইউরোপে সময়টা তখন অনিশ্চয়তায় ঢাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিক জীবন থেকে।
ভারতকে ছেড়ে দিলেও ব্রিটিশ রাজ তখনও প্রতাপশালী আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ক্রীড়া জগতেও আধিপত্য তাদের।
ফুটবলে নিজেদের আধিপত্যের ওপর এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল ইংলিশদের যে, তারা বিদেশি কোচ বা খেলোয়াড়দের ট্যাকটিকস অবলম্বন করতে উৎসাহী হয়নি। ১৯৪৯ সালে তারা সবশেষে হারে আয়ারল্যান্ডের কাছে।
নিজেদের খেলায় অপরাজিত ধারণা থেকে ইংলিশরা সেকেলে ডাব্লিউ এম ফরম্যাটেই খেলত। তাদের দলে পেশাদার কোনো কোচ ছিল না। ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা ওয়াল্টার উইন্টারবটম ছিলেন ফুটবল ফেডারেশনের কোচদের প্রশিক্ষক। কোনো দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা তার ছিল না।
ইংলিশদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল তাদের খেলোয়াড়রা এমনিতেই দক্ষতা ও কৌশলগত দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে।
হাঙ্গেরির অবস্থা ছিল বিপরীত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানি দ্বারা শাসিত ও শোষিত হওয়ার পর তাদের ক্ষমতায় তখন স্টালিনপন্থি মাতিয়াস রাকোসি।
ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শীদের পাঠানো হতো গুলাগ কিংবা জেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভাগ হয়ে যাওয়া পশ্চিম থেকে আদর্শগতভাবে একেবারেই আলাদা থাকতে চাইত পূর্ব ইউরোপ।
ফুটবলকেও ‘কমিউনিস্ট এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখে রাকোসির সরকার। হাঙ্গেরির উপ-ক্রীড়ামন্ত্রী ও জাতীয় দলের কোচ গুস্তাভ সেবেস খোলাখুলিভাবে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তিক্ত লড়াই শুধু আমাদের সমাজেই নেই, এটি আছে আমাদের মাঠেও।’
জাতীয় দলের অধিকাংশ সদস্যই তখন খেলতেন বুদাপেস্ট হোনভেড এফসি ক্লাবে। হোনভেড ছিল হাঙ্গেরিয়ান আর্মি পরিচালিত ফুটবল ক্লাব যাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করত দেশটির সরকার।
১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নামার আগে হাঙ্গেরির জাতীয় দল অপরাজিত ছিল তিন বছর। এর মধ্যে তারা জেতে ১৯৫২ হেলসিংকি অলিম্পিকের ফুটবল স্বর্ণ। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ড-হাঙ্গেরি ম্যাচটি হয়ে দাঁড়ায় অলিখিত পুঁজিবাদ-সমাজতন্ত্র লড়াই।
ইংল্যান্ডের স্থানীয় মিডিয়া প্রতিপক্ষকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়নি। হাঙ্গেরির অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসের ইংলিশ ফুটবলারদের তুলনায় মোটাসোটা দেহ নিয়ে ট্যাবলয়েডে কৌতুক ছাপানো হতে থাকে নিয়মিত।
৩-০ কিংবা ৫-০ ব্যবধানে জিতবে ইংল্যান্ড, এমন পূর্বাভাস করতে থাকেন ইংলিশ ফুটবল পণ্ডিতেরা।
ইংল্যান্ড দলে তখন বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার হিসেবে স্বীকৃত অধিনায়ক বিলি রাইটের অধীনে আলফ রামজি ও স্ট্যানলি ম্যাথিউসের মতো তারকা। দুজনই পরে নাইটহুড পান রানির কাছ থেকে।
হাঙ্গেরি দলে ছিলেন পুসকাস, যিনি পরবর্তী সময়ে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় নাম লেখান। এ ছাড়াও ছিলেন সান্দোর ককসিস ও নানদোর হিদেইকুটি। কোন ফরমেশনে খেলবেন তারা, সেটাও অজানা ছিল ব্রিটিশ দর্শকদের।
অবশেষে ২৫ নভেম্বর ম্যাচের দিন ব্রিটিশরা টের পায় মাইটি ম্যাগিয়ার্সের মাহাত্ব্য। ইংল্যান্ডের মান্ধাতা আমলের ডাব্লিউ-এম পদ্ধতির বিপক্ষে হাঙ্গেরিয়ানরা খেলে আধুনিক টোটাল ফুটবল ধাঁচে।
হিদেইকুটিকে একেবারে নতুন ‘উইথড্রন সেন্টার ফরোয়ার্ড’ পজিশনে খেলান সেবেস। এই পদ্ধতিতে ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার খেলবেন একটু নিচে নেমে। যার ফলও পায় তারা হাতেনাতে।
ম্যাচ শুরুর ২৮ মিনিটে চার গোল হজম করেন ব্রিটিশ গোলকিপার জিল মেরিক। ৯০ মিনিট শেষে স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৬-৩।
ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের সিড ওয়েন মন্তব্য করেন, ‘মনে হচ্ছে ভিনগ্রহবাসীর বিপক্ষে খেলেছি।’
বিশেষজ্ঞরা মত দেন, চাইলে আরও ছয় গোল করে ব্যবধান বড় করতে পারত হাঙ্গেরি।
সেটা তারা করে রিটার্ন ম্যাচে। ছয় মাস পর বুদাপেস্টে ইংল্যান্ডকে ৭-১ গোলে গুঁড়িয়ে দেয় স্বাগতিক দল।
সেই ম্যাচের পর দেশের ফুটবলকে খোলনলচে পালটে ফেলার পরিকল্পনা করে ইংলিশ ফেডারেশন। বিদেশি কোচ, খেলোয়াড়দের জন্য উন্মুক্ত করা হয় সে দেশের ফুটবল লিগগুলো।
পেশাদার কোচ, আধুনিক সিস্টেম এমনকি খেলোয়াড়দের বুটেও আনা হয় আধুনিকতার ছোঁয়া। হাঙ্গেরির ফুটবল সিস্টেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের বাইরে সাফল্য পেতে থাকে ওয়েস্ট হ্যাম, টটেনহ্যামের মতো ইংলিশ ক্লাবগুলো।
১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের যে দলটি স্যার আলফ রামজির কোচিংয়ে বিশ্বকাপ জেতে, সেটাতেও ছিল ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্সের’ কৌশলের ছোঁয়া।
ট্র্যাজিকভাবে, পুসকাস-হিদেইকুটি ও ককসিসের হাঙ্গেরি বিশ্বকাপ জিততে পারেনি কখনও। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে শেষ হয় ম্যাগিয়ার্সের চার বছরের অপরাজিত যাত্রা।