ইফতারের আগে আগে রাজধানীর লালমাটিয়ার-ডি ব্লকে একে একে আসতে থাকেন রিকশাওয়ালা, পথশিশু, ছিন্নমূলসহ শ্রমজীবী মানুষরা।
সেখানে সারি বেঁধে অপেক্ষা করেন। এদিকে তাদের জন্য থালায় ইফতারসামগ্রী সাজাতে থাকেন ‘মেহমানখানার’ একদল স্বেচ্ছাসেবী।
প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার গরিব মানুষের হাতে তুলে দেয়া হয় ইফতারির থালা। এর মধ্যে থাকে খিচুরি, ছোলা, জিলাপি, চিড়া, খেজুর, শসা, মুড়িসহ আরও অনেক কিছু। এ ছাড়া রয়েছে লেবুর শরবত।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্থ ও খাবারের সংকটে দিশেহারা অসহায়, ছিন্নমূল, দরিদ্র, গৃহকর্মীসহ খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোকে মেহমান বলেই গণ্য করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আর এজন্য মেহমানখানা নামে তারা একত্র হয়েছেন।
যে কোনো মানুষই সেখানে বিনা মূল্যে ইফতার করতে পারেন। কেউ চাইলে নিয়েও যেতে পারেন। আবার যে কেউ চাইলে বিতরণের জন্য এই স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে ইফতারসাগ্রমী দিতে পারেন।
উদ্যোগক্তারা নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের ৩০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। তারা প্রতিদিন সকাল থেকে ইফতার তৈরির কাজ করেন।
অন্যতম উদ্যোক্তা আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘আমরা আসলে গত বছর যখন করোনার জন্য লকডাউন হলো তখন শুরু করেছিলাম এটা। একেবারে পারিবারিক উদ্যোগে শুরু করি। লকডাউন মানে তো ঘরে থাকা, কিন্তু যাদের ঘর নাই, সেই শিশুগুলো পথে থাকে, যে মানুষরা পথে থাকে তারা কোথায় যাবে! তারা কোথায় খাবে, এটা চিন্তা করেই আসলে এই কাজটা করা।
‘তার পরে দেখি যে শ্রমজীবী মানুষরাও আস্তে আস্তে যুক্ত হচ্ছে, যারা রিকশা চালায় কিংবা দিনমজুরি করে, আর যারা বাসাবাড়িতে কাজ করত, তাদের কাজ চলে গেছে।
‘এবার আবার যখন লকডাউন হলো শুরু থেকে আমরা প্রতিদিন খাবার দিচ্ছি। মাঝখানে রোজা চলে আসল, রোজা লকডাউন দুইটা মিলিয়ে এখন ইফতারের সময় আমরা খাবার দিচ্ছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খাবারের জোগান হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় করপোরেট হাউজ ফান্ড দিচ্ছে চাচ্ছে। কিন্তু আমরা নিচ্ছি না। কারণ এখন যতটুকু দরকার, তা সবার ছোট ছোট সহযোগিতায় হয়ে যাচ্ছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় যে একটা যুদ্ধ জয় করা যায়, এটা এখানেই প্রমাণ।’
অসহায় মানুষদের হাতে একবেলা অন্তত ইফতার তুলে দিতে পারার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের সেবা করে আসলে আমরা খুব আনন্দ পাচ্ছি। বিষয়টা আসলে ক্ষুধার্ত মানুষের। যার ক্ষুধা লাগবে, সে এসে এখানে খাবে। আত্মীয়স্বজন পরিচিত মানুষ সবার সহযোগিতায় আমাদের চলছিল। কিন্তু এখন বাইরের কিছু মানুষও আমাদের সহযোগিতা করছেন।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যেন আমাদের কাজটা ভালো করে করে যেতে পারি। পৃথিবী ভালো হয়ে উঠুক, সবাই সবার কর্মে ফিরে যাক। আমি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি যে কালকেই যেন মেহমানখানা বন্ধ হয়ে যায়। এটা আমার ইচ্ছা। কারণ আমি চাই প্রতিটি মানুষ তাদের নিজ নিজ কাজে ফিরে যাক। তারা স্বাবলম্বী হোক।’
স্বেচ্ছাসেবী আয়শা ফেরদৌসি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি স্কুলে চাকরি করি। কিন্তু এখন অনেক দিন যাবৎ স্কুল বন্ধ, আমার সময় কাটছিল না। সেই সময় আমি ফেসবুকের মাধ্যমে মেহমানখানা সম্পর্কে জানতে পারি। প্রতিদিন মেহমানখানায় সময় দিই। মানুষের হাতে ইফতারি তুলে দিতে আমার খুব ভালো লাগে।’
খাবার পেয়ে ধানমন্ডি এলাকার রিকশাচালক লোকমান হোসেন বলেন, ‘করোনার মধ্যে হ্যারা খাবার দিতাছে। যা খাওয়ায় আল্লাহ দিলে ভালাই। আজকে খিচুড়ি, জিলাপি, বুট, মুড়ি দিছে। শরবতও দিছে।’
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ছয়টার দিকে লালমাটিয়ার ডি ব্লকের এই সড়কে আসেন। এর পর সারিতে দাঁড়িয়ে খাবার নেন।
রিকশাচালক মোহাম্মদ সুমন বলেন, ‘প্রায়ই এদিকে আসি (লালমাটিয়ার-ডি ব্লক)। দেখি অনেক লোক ইফতার খায়। যার যার খাবার তারা আইন্যা দেয়, খাবার আনা লাগে না। আর প্রত্যেক শুক্রবার হ্যারা খিচুড়ি খাওয়ায়। হ্যাগো যেন আল্লায় তৌফিক দেয়, যে আমরা খাইতে পারি।