বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে সিংকহোল। যাকে অনেকেই প্রকৃতির দানবগর্ত বলেন।
কিন্তু এই সিংকহোল আসলেই কী? কীভাবে সৃষ্টি হয় এই দানবাকৃতির গর্ত?
সম্প্রতি সিংকহোল নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ তুরস্ক। বিশ্বে যে কয়েকটি দেশে সিংকহোল রয়েছে তার অন্যতম তুরস্ক। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সিংকহোল দেখা গেছে।
যেভাবে সৃষ্টি হয় গর্ত
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, সিংকহোল প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বিশালাকার গর্ত। সাধারণত, বৃষ্টি হলে মাটির উপরিতলের পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরপর সেখানে একটি স্তরে পানি জমা থাকে। সেই পানি যখন সেচ কাজ বা অন্যকোনো কারণে উত্তোলন করা হয় তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়।
সিংকহোল প্রকৃতিতে খুব সাধারণ ঘটনা। একে ভূতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘কারস্ট ট্রেইন’।
ইউএসজিএস বলছে, শুধু পানি উত্তোলনের জন্য নয়, যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে সেখানে মাটির উপরিভাগের পানি নিচে প্রবেশ করে। সেখানে থাকে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজের স্তর।
এসব স্তরের খনিজ তোলা হলেও মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হতে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সেই এলাকায় মাটি নিচে ধসে গিয়ে তৈরি হয় সিংকহোল।
সিংকহোল একেবারে নাটকীয়ভাবে তৈরি হয়। অনেকেই ভূমিধসকেই সিংকহোল মনে করেন। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।
সিংকহোলে ঝুঁকিতে তুরস্ক
সিংকহোল নিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তুরস্কের কনিয়া রাজ্য। গত এক যুগে নতুন করে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল তৈরি হয়েছে এই রাজ্যে।
কনিয়া টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সিংকহোল রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক ফেতুল্লাহ আরিক বলেন, তিনি রাজ্যটিতে গণনা করে ৬০০টি সিংকহোলের অস্তিত্ব পেয়েছেন। যা ২০২০ সালে ছিল ৩৬০টি।
দেশটিতে সিংকহোল বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালাকে দায়ী করেছেন।
কৃষকরা অনেক জোর করেই অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নেয়ায় এই বিশাল বিশাল গর্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
মালভূমির অঞ্চল কনিয়া রাজ্যকে বলা হয় পাউরুটির দেশ। সেখানে যতদূর চোখ যাবে দেখা মিলতে গমের আবাদ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অঞ্চটিতে বেড়েছে খরা। সেই সঙ্গে ফসলের পানির জন্য অঞ্চলটিকে নির্ভর করতে হয় ভূগর্ভস্থ সেচের ওপর। জমিতে সেচ দিতে তাই কোটি কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। সেই পানি উঠানোর ফলে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে। আবার ওই অঞ্চলের কৃষকরা সেচের সুবিধায় পানি তুলে মাটির উপরেও বিশাল জলাধার বা ডোবা তৈরি করে জমা রাখেন।
চীনে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে গভীর দানব গর্ত বা সিংকহোল
অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় মাটির শক্তি কমে গিয়েও ডোবার স্থানে হয় ভূমিধস। এতেও তৈরি হয় দানবগর্ত।
দীর্ঘদিন থেকে চাষাবাদ করেন তাহসিন গুনদোগদু। তিনি জানান, ১০ থেকে ১৫ বছরে এই অঞ্চলে খরা বেড়েছে। কৃষকরা যে পরিমাণ সেচ দিচ্ছেন তা আগে কখনও দিতে হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পেপসিকোর কাছে নিজের উৎপাদিত ফসল আলু বিক্রি করেন গুনদোগদু। আলুর মান ভালো রাখতেও সেচ বেশি দিতে হয় বলে জানান তিনি।
ওই অঞ্চলের ৫৭ বছর বয়সী কৃষক হাজাম সেজার বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির সেচ কমাতে তারা বিকল্প পথ বেছে নেন। তবে বিদ্যুৎ বিল এতো পরিমাণ আসে যে সেটি আর কূলিয়ে উঠতে পারেননি।
হাজাম বলেন, ‘আমরা সাধারণত বছরে দুইবার জমিতে সেচ দিতাম। এখন সেচ দিতে হয় পাঁচ থেকে ছয়বার। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে।’
তুরস্কের চেম্বার অফ এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ার্সের (জেডএমও) প্রধান বাকী রিমজি সুয়েমেজ বলেন, ‘কারা সেচের জন্য অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে তা তদন্ত করা হবে। এই অবস্থা বিরাজ থাকলে, অসংখ্য সিংকহোলে তুরস্ক আরেক মহামারির দিকে এগোবে। তখন খাবারের ওপর করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা লাগতে বাধ্য।’
ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, অনেকেই এই দানব গর্ত সৃষ্টির জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করেন। তবে এটা প্রাকৃতিক নয়, বরং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।
তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল বা দানবগর্ত তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বের বড় কিছু সিংকহোল
সিংকহোল গড়ে ১০ মিটার চওড়া ও ১৫০ মিটার গভীয় হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে দানবগর্ত বা সিংকহোল।
চুকুইচামাতা সিংকহোলটি চিলিতে অবস্থিত। এটি এখন কপার খনি হিসেবে ব্যবহার হয়। ২৭৯০ ফুট গভীর সিংকহোলটি সৃষ্টি হয়েছে ১৯১০ সালে।
বাহামাসের লং আইল্যান্ডে ডিনস ব্লু হোল অন্যতম বড় একটি সিংকহোল। এর গভীরতা ৬৫০ ফুট।
চীনের চংকিং পৌরসভার অধীনে বিশ্বের বৃহত্তম সিংকহোলটির নাম জিয়াওজাই তিয়ানকেনগ। এটি ৬৬২ মিটার গভীর।