‘ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে’ চাষের জমি বিক্রি করে স্ত্রী তুলসী রানীকে হাতি কিনে দিয়েছিলেন কৃষক দুলাল চন্দ্র। তিন মাস আগে এলাকায় শোরগোল ফেলা সেই হাতির দিন এখন কাটছে আয়েশে। আর হাতি দেখিয়ে জমে উঠেছে তুলসী রানীর কবিরাজি কারবার।
লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের দেউতিরহাট রতিধর এলাকায় দুলাল চন্দ্রের বাড়ি। স্ত্রী তুলসী প্রায় ১০ বছর ধরে দেব-দেবীর একনিষ্ঠ পূজারি। স্বপ্নে পাওয়া তরিকায় স্থানীয়দের দিচ্ছিলেন পানি পড়াসহ টোটকা চিকিৎসা।
পরিবারের দাবি, মাস কয়েক আগে ঘুমের মধ্যে হাতি কেনার ‘দৈব আদেশ’ পান তুলসী। এরপর অর্থ জোগাড়ে পৈত্রিক ৭২ শতক জমি বিক্রি করেন স্বামী। বন্ধক রাখেন আরও দুই বিঘা। বসতভিটার গাছ বিক্রি করে জোগাড় হয় আরও কিছু টাকা। সব মিলিয়ে ১৭ লাখ টাকায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে কেনা হয় একটি মাদী হাতি।
এ ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর তৈরি হয় ব্যাপক আলোচনা। বন বিভাগের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়েছিল, আইন অনুযায়ী ব্যক্তিপর্যায়ে বন্যপ্রাণীর অনুমোদনহীন লালনপালনের সুযোগ নেই। দুলাল চন্দ্রের বাড়ি থেকে হাতিটি জব্দ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে উল্টো বনবিভাগের কাছে হাতি পোষার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন দুলাল। বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আর এই ফাঁকে হাওয়া লেগেছে তুলসী রানীর কবিরাজি বিদ্যার পালে।
হাতির দেখভালে ১৫ হাজার টাকা বেতনে রাখা হয়েছে মাহুত শরীফুলকে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, প্রতিদিন হাতির খাবার হিসেবে বরাদ্দ ১০টি কলা গাছ, তিন কেজি ভূষি, দুই কেজি গুড় ও দুই কাদি কলা। এজন্য মাসে খরচ হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
দুলাল চন্দ্র ও তুলসী রানীএলাকাবাসী জানায়, ‘স্বপ্নে আদেশ’ পেয়ে কেনা হাতি দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে দুলালের বাড়িতে ভিড় করছে প্রচুর মানুষ। এর মধ্যে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ নারী-পুরুষ আসেন কবিরাজি দাওয়াই নিতে। তাদের ‘চিকিৎসার’ জন্য পানি পড়া, ডাব পড়া দিতে দিনভর ব্যস্ত থাকেন তুলসী।
কবিরাজি দাওয়াইয়ের বিনিময়ে জনপ্রতি এক শ থেকে পাঁচ শ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন তুলসী। দুলালের দাবি, বন্ধ্যাত্ব সমস্যা নিয়েই বেশি আসছে মানুষ। তাছাড়া, বিয়ে না হওয়ার জটিলতাসহ সব সমস্যারই সমাধান আছে তাদের বাড়িতে। যে কোনো রোগীর প্রাথমিক ফি ২১ টাকা। এরপর সমস্যার দাওয়াই অনুযায়ী বাড়ে টাকার পরিমাণ।
তুলসী রানীর কাছে কবিরাজি দাওয়াই নিতে আসা মানুষনিজের কবিরাজি বিদ্যা নিয়ে বেশ ‘আত্মবিশ্বাসী’ তুলসী। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটি পরমেশ্বরের আদেশ। স্বামী ও আমার নিষ্ঠা ভক্তির কারণে আজ এটি করতে পারছি।’
লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলার নারী-পুরুষের ভিড় দেখা গেছে তুলসী রানীর বাড়িতে। তাদের বিশ্বাস, ঝাড়ফুঁক ও পানি পড়াতেই তাদের শারীরিক জটিলতা কেটে যাবে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য গোপনীয়তা বজায় রাখার নীতি থেকে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করছে না নিউজবাংলা।
এলাকাবাসী জানান, এর আগে স্বপ্নে হাঁস জবাইয়ের দৈব আদেশ পেয়েছিলেন তুলসী। সেটি পূরণ করতে না করতেই আরেক আদেশ, কিনতে হবে ঘোড়া। এক বিঘা জমি বিক্রি করে দুই বছর আগে দুটি ঘোড়া সংগ্রহ করেন দুলাল, এর একটি মারা গেছে।
হাতি পোষার অনুমতি চেয়ে দুলালের আবেদন কোন পর্যায়ে আছে, জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, ঢাকার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো-এর সঙ্গে। তার কার্যালয়েই নিজের নামে লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন করেছিলেন দুলাল।
মিহির কুমার দো নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুলাল চন্দ্রের আবেদনটির বিষয়ে তদন্তের জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, রাজশাহীর কাছে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। তদন্তের প্রতিবেদন এলে স্থায়ীভাবে হাতি সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হবে।’
দুলাল লাইসেন্স পেলে হাতি পোষায় আইনি কোনো বাধা থাকবে না বলেও জানান মিহির কুমার দো।
তবে হাতি দেখিয়ে জমজমাট কবিরাজি কারবার নিয়ে চিন্তিত লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০২০ সালে এসেও মানুষ কবিরাজি বিশ্বাস করে চিকিৎসা নিচ্ছে- এটি ভাবার বিষয়। এ ধরনের চিকিৎসার কোনো ভিত্তি নেই। মানুষ যাচ্ছে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। যিনি এই কারবার চালাচ্ছেন তিনি কোনোভাবেই চিকিৎসা করতে পারেন না।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা উত্তম কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাতিকে আশ্রয় করে কবিরাজির বিষয়টি তিনি শুনেছেন। মানুষ নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে সেখানে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’