পেরুর রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের মরুভূমিতে ছড়িয়ে আছে রহস্যময় ন্যাসকা লাইন। ধূসর বালু অথবা পাহাড়ের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব দীর্ঘ রেখা দেখে সাধারণভাবে বিশেষ কিছু বোঝার উপায় নেই।
তবে আকাশ থেকে চোখ রাখলে রেখাগুলো মিলেমিশে তৈরি করে বিভিন্ন প্রাণীর বিশাল অবয়ব। কোনোটি বানর, কোনোটি হামিং বার্ড, কোনোটি তিমি, আবার কোনোটি অন্য কোনো প্রাণী।
এই ন্যাসাকা লাইনের একটি পাহাড়ের বুকে এবার আবিষ্কৃত হয়েছে বিশাল এক বেড়ালের অবয়ব।
এখন থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছর আগে এ অঞ্চলে আবাস গড়ে তুলেছিল ন্যাসকা জনগোষ্ঠীর মানুষ। আদিবাসী এই জনগোষ্ঠী মূলত ছিল কৃষিজীবী, তবে কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা বসবাসের সাড়ে ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে পরিণত করেছিল ছবির ক্যানভাসে।
ন্যাসাকা লাইনে শত শত জ্যামিতিক রেখায় ফুটে উঠেছে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। রেখাগুলো যাতে টেকসই হয়, সেজন্য ভূমি কিংবা পাথরের বুকে ৪ থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর করা হয়েছিল। আর প্রতিটি রেখা ছিল এক থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত মোটা। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া ন্যাসাকা লাইনের সব মিলিয়ে দৈর্ঘ্য এক হাজার ৩০০ কিলোমিটার।
যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে গোটা পৃথিবীর চোখের আড়ালে থাকা ন্যাসাকা জনগোষ্ঠী কী করে এমন দীর্ঘ রেখায় নিখুঁত ভূমিচিত্র এঁকেছিল- সেটি পুরাতাত্ত্বিকদের কাছে বিস্ময়। অঞ্চলটিকে ১৯৯৪ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো।
সপ্তাহখানেক আগে ন্যাসাকা লাইনের একটি পাহাড়ের ঢালে বেড়ালের অবয়ব আবিষ্কারের ঘোষণা দেয় পেরুর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। পাহাড়ে ভূমিক্ষয়ের কারণে বেড়ালটি এতদিন সবার চোখের আড়ালে ছিল। তবে পুরাতাত্ত্বিকদের চেষ্টা এবং আকাশ থেকে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা উন্নয়নের কারণেই উন্মোচিত হয়েছে আরেক ন্যাসাকা শিল্পকর্ম।
বেড়ালের অবয়বটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২২ ফুট। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া প্রায় ৮০টি প্রাণি চিত্রের বিবেচনায় এটি মাঝারি আকৃতির। এর চেয়ে অনেক বড় ভূমিচিত্রও এঁকেছে ন্যাসকা জনগোষ্ঠী। যেমন একটি বানর রয়েছে যেটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০৫ ফুট, প্রস্থে ১৯০ ফুট।
পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা, সেই দূর অতীতে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসরণ করে দীর্ঘ রেখায় এসব প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে তুলত ন্যাসকা জনগোষ্ঠী। নিখুঁত এসব ভূমিচিত্রের হয়ত বিশেষ কোনো সাংকেতিক অর্থ ছিল অথবা ছিল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য। তবে তার সবই হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৫০০ বছর পর্যন্ত সম্মৃদ্ধ এক জাতি হিসেবে টিকে ছিল ন্যাসকারা। তারপর হঠাৎ করেই তারা যেন উধাও হয়ে যায়!
কেন এমনটি ঘটল- তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা।
একদল পুরাতাত্ত্বিক মনে করছেন, ন্যাসকারা নিজেদের ধ্বংসের বীজ নিজেরাই বুনেছিল। কৃষিজমি বাড়াতে নির্বিচারে তারা ধ্বংস করেছে বনভূমি। যার ফলে এক হাজার বছরের মধ্যে গোটা অঞ্চলের চরিত্রই বদলে যায়। উর্বর ভূমি পরিণত হয় ঊষর মরুভূমিতে।
কৃষিনির্ভর ন্যাসকা জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করে নেয় উত্তপ্ত মরুভূমি।