১৮০৫ সাল। ভারতে তখনও কোম্পানি শাসন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গুটিবসন্তের বিস্তার।
এর মাত্র পাঁচ বছর আগে এ রোগে আক্রান্ত হয় এক কোটি ৮৫ লাখ মানুষ। এমন বাস্তবতায় দেশটিতে টিকা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেটারই সুযোগ নেয় উপনিবেশ স্থাপনকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের মাধ্যমে ভারতে আসে বসন্তের টিকা।
অবশ্য ছয় বছর আগেই টিকাটি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার।
টিকা আসার সময়ে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূরের রাজত্ব ছিল ওয়েদিয়ার রাজবংশের হাতে। নতুন রাজা তৃতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়েদিয়ার। তার রাজপ্রাসাদে রানি হয়ে আসেন দেবযামিনী। নতুন রাজা-রানি দুজনের বয়সই ছিল ১২ বছর।
রাজপ্রাসাদে আসার পরপরই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে যুক্ত হন দেবযামিনী। গুটিবসন্তের টিকা আসার বিষয়টি সাধারণ জনগণের কাছে প্রচার ও টিকা নিতে তাদের উৎসাহ জোগাতে এক তৈলচিত্রের মডেল হন তিনি।
ভারতে গুটি বসন্তের টিকার এ প্রচার ছিল দেশটিতে ব্রিটিশ শাসন পোক্ত করার একটি চেষ্টা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সুযোগটিকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগায়।
প্রচারকাজে কোম্পানি কাজে লাগায় ব্রিটিশ সার্জন, ভারতীয় টিকাদানকারী, কিছু কর্মকর্তা ও রাজপরিবারের বন্ধুত্বকে।
রাজপরিবার হিসেবে তখন ব্রিটিশদের অনুগত ছিল ওয়েদিয়ার বংশ। ব্রিটিশরা তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু টিপু সুলতানকে সরিয়ে ৩০ বছর পর ওয়েদিয়ার রাজপরিবারকে ক্ষমতায় আনে।
রাজবংশের রাজা-রানিদের চিত্রকর্ম কোনো নতুন বিষয় ছিল না। তবে ১৮০৫ সালে ভারতের ১২ বছর বয়সী কোনো রানিকে জনসাধারণের প্রচারকাজে বিলাতি শিল্পীর চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে দেখতে পাওয়াটা ছিল নতুন বিষয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ডা. নাইজেল চ্যান্সেলর ভারতের মহীশূরের রাজবংশ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, তার ধারণা, রানিকে চিত্রকর্মের মডেল বানানো সম্ভব হয়েছিল রাজা তৃতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের দাদি লক্ষ্মী আম্মানির কারণে।
লক্ষ্মী আম্মানির স্বামী গুটিবসন্তে মারা গিয়েছিলেন। তিনি চাইছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মিলে এই রোগ রোধে জনগণের পাশে দাঁড়াতে।
রাজা ও রানি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় টিকার বিষয়ে সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছিল আম্মানিকে।
ইতিহাসবিদ চ্যান্সেলরের ধারণা, তেলচিত্রে তিনজনের মধ্যে মাঝখানের নারীটিই লক্ষ্মী আম্মানি।
চ্যান্সেলর প্রথমবার যখন ছবিটি দেখেন, তখন সেটি শিরোনামহীন অবস্থায় ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, ছবিটির বিষয়বস্তু নৃত্যরত তিন নারী। কিন্তু চ্যান্সেলর ছবিটি দেখার সাথে সাথেই বুঝতে পারেন, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
ছবিতে ডানদিকে থাকা নারীকে দেবযামিনী হিসেবে চিহ্নিত করেন চ্যান্সেলর।
তিনি জানান, ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী, দেবযামিনীর বাম হাতটি স্বভাবতই শাড়িতে ঢেকে রাখার কথা। কিন্তু টিকা দেওয়ার জায়গাটি চিহ্নিত করতে হাত থেকে আঁচল সরিয়ে রাখেন এ নারী।
চ্যান্সেলর মনে করেন, ছবিতে বাম দিকে থাকা নারীটি রাজার প্রথম স্ত্রী। তার নামও দেবযামিনী।
ছবিতে প্রথম স্ত্রীর নাকের নিচে ও মুখের চারপাশের ফ্যাকাশে রং গুটিবসন্তের প্রতীক বলে মনে করেন চ্যান্সেলর।
সে সময়ে রোগের সংক্রমণ কমাতে আক্রান্ত কেউ সুস্থ হলে তার শরীর থেকে ফুসকুড়ির গুঁড়ো নেওয়া হতো। পরে সেই গুঁড়ো সুস্থ মানুষের নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হতো।
চ্যান্সেলর তার বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে ২০০১ সালে একটি নিবন্ধ লেখেন। এতে বলেন, চিত্রকর্মটির সময়ের সাথে মহীশূরের রাজার বিয়ের তারিখের মিল আছে।
এ ছাড়াও ১৮০৬ সালের আদালত রেকর্ডে টিকা প্রচার কাজে দেবযামিনীর সমর্থনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়।
মহীশূরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে চ্যান্সেলর বলেন, স্বর্ণের ভারী বালা ও মাথার বিভিন্ন অলংকার মহীশূর রানিদের বৈশিষ্ট্য ছিল। তা ছাড়া ছবিটির শিল্পী টমাস হিকি ওয়েদিয়ার বংশের আরও কিছু সদস্যের ছবি এঁকেছিলেন। ভারতে গুটিবসন্ত সাধারণ মানুষের কাছে ছিল আতঙ্কের বিষয়। প্রচণ্ড জ্বর, শরীর ব্যাথাসহ মুখে ও শরীরে গুটি বের হওয়া এই রোগের লক্ষণ।
টিকা প্রচারের আগে রোগমুক্তির জন্য মারিয়াম্মা (শীতলা) নামের দেবীর পূজা করত সাধারণ মানুষ। এমন বাস্তবতায় রোগের সংক্রমণ থেকে তাদের বাঁচাতে টিকার প্রচার জরুরি হয়ে পড়ে।
ভারতে আনা টিকার উপাদানটি নেওয়া হয়েছিল অ্যানা ডাস্টহল নামের তিন বছর বয়সী এক ব্রিটিশ শিশুর শরীর থেকে। সেই সময়ে রোগে আক্রান্তের পর সুস্থ হওয়া মানুষের শরীর থেকে প্রতিষেধক উপাদান সংগ্রহ করা হতো।
অ্যানা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মীর মেয়ে। সে ভারতের প্রথম শিশু, যে গুটিবসন্ত থেকে আরোগ্য লাভ করে।
প্রচারের মাধ্যমে দশ লাখেরও বেশি টিকা সাধারণ মানুষকে দেয়া হয়। টিকাদান শেষে রানির তেলচিত্রটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এভাবেই বিশ্বের প্রথম টিকাদান কর্মসূচির অংশ হিসেবে আঁকা চিত্রকর্মটি ব্যাপক মানুষের কাছে পরিচিতি পায়।
ছবিটি বর্তমানে ব্রিটিশ নিলাম কোম্পানি সথবি’স-এর সংগ্রহে আছে। এর বর্তমান মূল্য চার থেকে ছয় লাখ পাউন্ড।