বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পতিতাবৃত্তি ও বৈশ্বিক অপরাধ: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

  • সম্পাদকীয়   
  • ২১ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:১০

পতিতাবৃত্তি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ে গভীর প্রভাব ফেলে। দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং পাচার এর মূল চালিকা শক্তি।

পতিতাবৃত্তি বা যৌন ব্যবসা মানব সভ্যতার প্রাচীনতম পেশাগুলোর মধ্যে একটি। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিসর, গ্রিস ও রোমান সভ্যতায় যৌনকর্মীরা সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মেসোপটেমিয়ার ‘মন্দিরী’রা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষা এবং স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকত। রোমান সাম্রাজ্যে যৌনকর্মীরা করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন, এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা সীমিত হলেও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে বর্ডেল সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং সামাজিক শোষণ পতিতাবৃত্তিকে প্রবলভাবে চালিত করত। ফ্রান্স, ইতালি এবং ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে নির্দিষ্ট এলাকায় বর্ডেল পরিচালিত হতো এবং তা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটি কখনও ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সংযুক্ত, কখনও দরিদ্রতা এবং শিক্ষার অভাবে প্রসার লাভ করত।

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে পতিতাবৃত্তি স্থানীয় সীমা অতিক্রম করে, আন্তর্জাতিক মানবপাচার, শিশু শোষণ, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এতে বিশেষভাবে প্রভাবিত। ঢাকার কাপ্তান বাজার, মুম্বাইয়ের মাদারসির বাজার, কাঠমান্ডুর স্থানীয় বর্ডেলগুলো আন্তর্জাতিক পাচারের কেন্দ্র। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন ও বৈধ যৌনবাণিজ্যের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্ত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনকর্ম থেকে বছরে প্রায় ২৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়, যার ৭৩% আসে যৌনকর্ম থেকে। অর্থনৈতিক প্রভাব দুটি ভাগে দেখা যায় যা বৈধ ও অবৈধ যৌনপেশা।

নেদারল্যান্ডস (১৯৯৯), জার্মানি (২০০২), নিউজিল্যান্ড (২০০৩) যৌনকর্মকে নিয়ন্ত্রিত ও বৈধ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা, কর এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন এবং ‘ফাস্ট এন্টারটেইনমেন্ট’ শিল্পের মাধ্যমে বৈধকৃত যৌনবাণিজ্য পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় সীমিত বৈধ যৌনকর্ম রয়েছে।

বৈধ যৌনপেশা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডসে বৈধ যৌনবাণিজ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ইউরো রাজস্ব আসে। জার্মানিতে এই খাত সরকারকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ইউরো কর আয় দেয়। তবে মানবিক মর্যাদা বজায় রাখা, মানসিক চাপ হ্রাস এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।

দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ: বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্প চালু হয়েছে। ভারতের মুম্বাই এবং দিল্লিতে যৌনকর্মীদের জন্য পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এমন কেন্দ্রগুলো মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে।

অবৈধ যৌনকর্ম মানবপাচার, মাদক, অস্ত্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র নারী ও শিশু উন্নত দেশে পাচার হয়। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শিশু ও কিশোরদের যৌনশ্রমে ব্যবহার হয়। পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ নারী পাচারের শিকার হয়। এটি দরিদ্র দেশগুলোর মানবসম্পদকে ধনী দেশের যৌনবাণিজ্যের জন্য ‘পণ্য’ বানায়।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক NGO যেমন Hope for Justice এবং ECPAT এ ধরনের চক্র ভাঙতে সক্রিয়। তবে সীমিত বাজেট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক সঙ্গতি নেই এমন এলাকায় প্রতিরোধ কার্যকর হয় না।

জাতিসংঘের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০,০০০ এরও বেশি মানুষ মানব পাচারের শিকার, যার ৩৮% শিশু এবং ৩৯% নারী। মূল কারণ: দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং অভিবাসনের অপব্যবহার।

বাংলাদেশ: প্রায় ১ লাখ নারী যৌনপেশায় নিযুক্ত, বিশেষ করে ঢাকার কাপ্তান বাজার ও চট্টগ্রামের বর্ডেল।

ভারত: ৫ লাখের বেশি যৌনকর্মী, বিশেষত মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লি ও হায়দ্রাবাদে।

নেপাল ও পাকিস্তান: নারী বিদেশে বিক্রি হয়, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে।

ভুটান: সীমিত, ভারতীয় বাজারে বিক্রি।

আফ্রিকা: নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু ও কিশোরদের জোরপূর্বক যৌনপেশায় নামানো হয়।

মধ্যপ্রাচ্য: সৌদি আরব, UAE, কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকদের যৌনশোষণ হয়।

ইউরোপ ও আমেরিকা: পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়।

কেস স্টাডি: ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার ১৪ বছর বয়সি একটি মেয়ে ইউরোপে পাচারের পরে উদ্ধার হয়। সে জানিয়েছে, ‘আমাকে দিনের পর দিন কাজ করানো হতো, না খেয়ে থাকতে হতো, মারধর হতো।’

যৌনপেশা প্রায়ই আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের অর্থ ধোয়ার মাধ্যম। যৌনকর্মীরা প্রায়ই মাদকাসক্ত করা হয় নিয়ন্ত্রণের জন্য।

দক্ষিণ এশিয়া: আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হেরোইন চোরাচালান যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশ: ফেনসিডিল ও ইয়াবা বাণিজ্য সক্রিয়।

আফ্রিকা ও ইউরোপ: যৌনপেশার অর্থ দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।

এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। এমন চক্রের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে যৌনশ্রমী এবং শিশু ‘বিক্রয়ের পণ্য’ হয়ে যায়।

২০২৩ সালে Amnesty International এর জরিপে দেখা গেছে, ৬০% যৌনকর্মী একাধিকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার।

মানসিক প্রভাব: বিষণ্নতা, PTSD, উদ্বেগ, আত্মহত্যার ঝুঁকি। শিশুদের শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এসব নির্যাতন ও মানসিক চাপ সমাজে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে।

কেস স্টাডি: বাংলাদেশের কাপ্তান বাজারের একজন যৌনকর্মী জানিয়েছেন, ‘প্রতিদিন নির্যাতন, অপমান ও মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। কোনো নিরাপত্তা নেই। স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে সাহায্য নেই।’

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত হয়, শরীরকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণ সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি করে। এটি লিঙ্গ বৈষম্যকে শক্তিশালী করে এবং সমাজে নারীকে সমান মর্যাদা দেয়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত করে।

নেতিবাচক: মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশু ও নারী নির্যাতন, অপরাধ বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহ।

ইতিবাচক (সীমিত): স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত তদারকি, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ সুবিধা। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির বৈধ যৌনবাণিজ্য কিছু অংশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তবে এটি মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়।

আইনগত সংস্কার: কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন। যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।

সামাজিক সচেতনতা: শিক্ষার প্রসার, গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ সমতার প্রতি মনোযোগ।

অর্থনৈতিক বিকল্প: দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, স্বনির্ভর উদ্যোগ এবং যুবসমাজের কর্মসংস্থান।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: UNODC, IOM, ECPAT, CATW, UNICEF, ILO, Hope for Justice এর মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচি।

উদাহরণস্বরূপ, IOM এবং UNICEF যৌথভাবে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন প্রকল্প চালায়।

পতিতাবৃত্তি বৈশ্বিক নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, বৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক শোষণ এটিকে টিকিয়ে রাখে। মানবপাচার, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান নিশ্চিত করলে পতিতাবৃত্তি ও যৌনশোষণের অবসান সম্ভব। যে সমাজ নারীকে মর্যাদা দেয়, সেই সমাজেই এই অশুভ চক্র থেকে মুক্তি আসবে।

লেখক : আইনজীবী ও গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর