বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মূল্যস্ফীতিতে এগিয়ে ও প্রবৃদ্ধিতে পিছিয়ে

  • সম্পাদকীয়   
  • ২০ অক্টোবর, ২০২৫ ২১:৫২

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি- ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৪ শতাংশ, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শ্রীলংকায় গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ, চলতি বছরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি নাও হতে পারে। মালদ্বীপ ও নেপাল মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় এগিয়ে রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৯ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির আঘাত ও বৈশ্বিক মন্দার ছোবল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। দেশকে এখনো নিম্ন জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভুটানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, নেপালের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জন্য। দেশটির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অতছ বাংলাদেশ এখনো ৪ শতাংশের রয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও প্রাইমারি ব্যালেন্সের স্থিতি চলতি অর্থবছরেও নেতিবাচক থাকবে। বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিতেও চাপে থাকতে হবে।অপরদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে। যা আগামী ২০২৬ সালে অর্থবছর শেষে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। যদিও পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে, তবুও ধীর প্রবৃদ্ধির অনুমান চলমান মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে বারবার বন্যা, শিল্প শ্রমিক বিরোধ এবং ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দেশীয় চাহিদা হ্রাস পেয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এডিবি জানায়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার ওপর এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো দেখা যায়নি এবং ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উচ্চতর অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অপরিহার্য। ২০২৬ অর্থবছরের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক ঝুঁকি রয়ে গেছে। বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করা জরুরি। মূলত টেকসই উন্নয়নে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এডিবি আরও জানায়, পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, অপর্যাপ্ত বাজার তথ্য, সরবরাহ শৃঙ্খলের সীমাবদ্ধতা এবং টাকার দুর্বলতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ ৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি হিসাবে ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপির ০ দশমিক ০৩ শতাংশের সামান্য উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে বেশি, যা বাণিজ্য ব্যবধান সংকুচিত এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বারা সমর্থিত।সরকারি হিসাবে প্রায় এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। এর সুবাদে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়েনি। শিল্পের প্রসারও সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার বিশ্বব্যাংক ও এডিবিরি মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই গড়ে সাড়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখছে, তখন বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বৃদ্ধির পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা যৌক্তিক তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, এমন উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে, ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার এবং নীতি সুদহার প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হলেও, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেভাবে কার্যকর হয়নি। বরং মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। তদুপরি, আইএমএফের শর্ত পূরণে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৩.৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে এটি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১১.৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এ বছরের নভেম্বরে সেটি কিনতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা প্রয়োজন। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশে পৌঁছালেও এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক বছর আগে ২৭ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন কমে ৯.৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় (০.৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মালদ্বীপে (১.৪ শতাংশ)। এরপর ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান রয়েছে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে স্থিতিশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্কভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, যাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাম কমাতে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একসঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমও ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কম দামে বেশ কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে এবং খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা বিক্রি শুরু করেছে। আবার সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল এবং কাঁচামরিচের আমদানিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসছে না পেঁয়াজ ও আলুর দাম। এরই মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজে কাস্টমস শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতি এবং আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপরও খুচরা বাজারে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্য।এখানে উল্লেখ্য যে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েন ভারত থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিঢয়ছে যা বাজার পরিস্থিতিকে আরও সমস্যায় ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । বাজারে আমনের নতুন ধান উঠেছে। উৎপাদনও আশানুরূপ। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এরপরও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। শুল্ক কমানো হলো; কিন্তু আমদানি বাড়ল না- তাতে সুফল পাওয়া যাবে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি না আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে (ক্যাব) সাবেক সভাপতি বলেন, কর কমানো একটি উপায় হলেও বেশির ভাগ সময় তা সুফল দেয় না। আমি মনে করি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ ব্যাপারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। একদল চাঁদাবাজি করে চলে গেছে, আরেক দল চাঁদাবাজি করার দায়িত্বে এসেছে- এটাকে যদি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকারের পরিবর্তন হলেও খেলোয়ারের কোনো পরিবর্তন হয়নি।লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

এ বিভাগের আরো খবর