আমাদের গ্রিনরোডের বাসার ছাদ বাগানে প্রায় দশ বছর আগে একটি কলমের আমড়া গাছ লাগিয়েছিলাম। এই গাছ দিনে দিনে বড় হয়ে উঠে এবং বলতে গেলে বারো মাস ধরে এই ফল হতো। গত ১১/১০/২০২৫ইং তারিখ শনিবার সকালে দেখলাম গাছটির পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে অনেকে বলতে লাগলো যে, গাছে পানি বেশি দেয়া হয়েছে বলে শেকড় পচে গিয়েছে বিধায় গাছ মরে যাচ্ছে। এতে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। কেননা এতটি বছর ধরে গাছটি পরিচর্যাসহ আগলিয়ে রেখেছিলাম। তাই এর উপর বেশ মায়া হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এই আমড়া তুলনামূলক মিষ্টি ছিল এবং ফলের দিক দিয়ে অনেকাংশে বাসার সবার চাহিদা মেটাতো। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, ছাদে নানা গাছ থাকলেও এই গাছটির প্রতি কেমন যেন বিশেষ টান ও মায়া ছিল। যাহোক, কয়েকদিনের মধ্যে গাছটি পুরোপুরি মারা গেলো। এতে মনটা এত খারাপ হলো যে কেমন যেন উদাসী হয়ে পড়লাম। বাসার সবাই বলতে লাগলো যে, মন খারাপ করে লাভ নেই; বরং এর স্থলে অন্য একটি গাছ এনে লাগাও। আমি বললাম হয়তো তাই হবে। কিন্তু এই গাছটির প্রতি, যে এতো ভালোবাসা ও মায়া; তাই এর কথা কভু ভুলতে পারবো না। এর মধ্যে ভাবলাম, এই গাছটির কথা স্মরণীয় করে রাখতে সামগ্রিকভাবে আমড়া নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখব। আর সেই মতে হাতে কাগজ-কলম তুলে নিলাম। বস্তুত আমড়া মৌসুমি ফল। এখানে একটি কথা বলে রাখা শ্রেয় যে, মৌসুমি গাছ পালা ও ফলের সাথে পৃথিবীর জীব হিসেবে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার আবর্তে একটি মিল আছে। তাই মৌসুমি ফল খেলে স্বভাবতই মানুষ অনেকাংশে সুস্থ থাকে। আরেকটি কথা, আমড়া এমন একটি ফল দেখলেই তেুঁতলের মতো জিব্বায় পানি আসে। আর এই টক মিষ্টি ফল স্থানীয় ফল হিসেবে দামি ও বিদেশি আপেলের চেয়ে গুণাগুণের দিক দিয়ে তুলনামূলক বেশি এবং সস্তা। আর এতে আপেলের চেয়ে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের পরিমাণ অধিক। আমড়া একপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম স্পনডিয়াস মমবিন। এই গাছগুলো ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়। আর প্রতিটি যৌগিক পাতায় ৮-৯ জোড়া পত্র থাকে পত্রদণ্ডে যা ৮-১২ ইঞ্চি লম্বা। কাঁচা ফল টক বা টক-মিষ্টি হয়, তবে পাকলে টকভাব কমে আসে এবং বেশ মিষ্টি এবং সুস্বাদু হয়ে উঠে। ফলের বীজ কাঁটাযুক্ত। অবশ্য ৫-৭ বছরেই মধ্যেই গাছ ফল দেয়। এই ফল কাঁচা ও পাকা রান্না করে বা আচার বানিয়ে খাওয়া যায়। এই ফল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জন্মে। আর বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ায় এই গাছটি পরিলক্ষিত হয়।আমড়া কষ ও অম্ল স্বাদযুক্ত ফল। এতে প্রায় ৯০% পানি, ৪-৫% কার্বোহাইড্রেট ও সামান্য পরিমাণ প্রোটিন থাকে। আর ১০০ গ্রাম আমড়ায় ভিটামিন-সি পাওয়া যায় ২০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৭০ মাইক্রোগ্রাম, সামান্য ভিটামিন-বি, ক্যালসিয়াম ৩৬ মিলিগ্রাম এবং আয়রন ৪ মিলিগ্রাম। এদিকে আমড়ায় যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিনজাতীয় ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টজাতীয় উপাদান থাকে। আমড়ার পুষ্টিগুণ কোনো অংশে কম নয়। এক্ষেত্রে সম্যক ধারণার জন্য প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী আমড়ার পুষ্টিগুণ।বস্তুত আমড়া বেশ উপকারী ফল। কেননা এই ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ; কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন কমাতে সহায়তা করে; রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়; অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় উপাদান থাকায় আমড়া বার্ধক্যকে প্রতিহত করে; আমড়াতে প্রচুর আয়রন থাকায় রক্ত স্বল্পতা দূর করতে বেশ কার্যকর; বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে আমড়া উপকারী; দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ার মতো সমস্যা প্রতিরোধে আমড়ার ভূমিকা অনন্য; আমড়ায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে বিধায় এই ভিটামিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রকমের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, সর্দি, কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে দূরে রাখে উপকারী এই ফল; হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে আমড়ায় থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি। এছাড়া ভিটামিন সি ত্বক সুস্থ রেখে বয়সের ছাপও কমায়; আমড়া খেলে মুখে রুচি বাড়ে, দূর হয় বমি বমি ভাবও; আয়রন শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি অত্যাবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও রক্ত স্বল্পতা এবং অন্যান্য রক্তের সমস্যা প্রতিরোধ করে। এছাড়া হিমোগ্লোবিন এবং মায়োগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে আয়রন, যা শরীরের সমস্ত সিস্টেমে অক্সিজেন স্থানান্তর করে; আর আমড়ায় ফ্যাট ও সোডিয়াম নেই। এতে অনেক ভিটামিন ‘কে’ থাকে, যা হাড় মজবুত করতে সহায়তা করে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে আমড়ায় কপার থাকে বলে হাড় ও শরীরের জন্য উপকারী; আমড়া পিত্তনাশক ও কফনাশক এবং থিয়ামিন নামের একটি উপাদান থাকে, যা মাংসপেশী গঠনে ভূমিকা রাখে। এই উপাদানের ঘাটতি হলে পেশী দুর্বল হওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় বলতে গেলে আমড়া গাছ জন্মে। তবে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ; খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর ও বরগুনা; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি; ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনো, শেরপুর ও জামালপুর এবং ঢাকা ও আশে-পাশের অঞ্চল যেমন- নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অধিক জন্মে। মজার ব্যাপার হলো যে, ঢাকা রাজধানীসহ জেলা শহরের অনেক ছাদ-বাগানে অন্যান্য গাছের সাথে আমড়ার চাষ হয়ে থাকে। বস্তুত বাংলাদেশের গাছগাছালির আশে পাশে ও বাগানে মিশ্র চাষ হয়ে থাকে। মূলত উঁচু ও মাঝারি জমিতে ভালো জন্মে। এদেশে আমড়া গাছে বর্ষায় ফুল আসে। তারপর বড় হতে থাকে এবং অক্টোবর পর্যন্ত থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই ফল হেমন্ত ঋতুর প্রথম সময়কাল পর্যন্ত দেখা যায়। আর এই সময় ফল পাকে। মজার ব্যাপার হলো যে, কিছুটা বড় হলে বাজারে আসতে থাকে, যা অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে পরিলক্ষিত হয়। ফলের দোকানে অন্যান্য ফলের সংগে এটি শোভা পায়। এই ফল মুখরোচক এবং দামে সস্তা বলে বাঙালিরা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকে। আর পরিবারের ছোট বড় সবারই পছন্দ। আরেকটি কথা, শহর-বন্দর, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনে কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা আমড়াগুলো ফুলের মতো কেটে, তাতে লবন ও মসলা মিশিয়ে পিচ আকারে বিক্রি করে থাকে।পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, দেশি ফল হিসেবে আমড়াকে গুরুত্ব দেয়া সমীচীন। কেননা গুণাগুণের দিক দিয়ে আঙ্গুর ও আপেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই এই আমড়া গাছ চাষে আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া অপরিহার্য।
লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।