বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে এক গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তা আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে। এটি কেবল দুটি দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং আদর্শিক অবস্থান, জোটবদ্ধতা এবং জনগণের প্রত্যাশার একটি জটিল সমীকরণ।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি প্রশ্ন ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে—আগামী নির্বাচনে বিএনপি কোথায় দাঁড়াবে এবং জামায়াত কীভাবে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করবে। ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, বিএনপি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ পেলে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। কিন্তু কয়েক মাসের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধী শক্তির নতুন জোটের কারণে এখন আর বিষয়টি এতটা সরল নয়।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় সফরকালে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কাছে জানতে চেয়েছে, দলটি যদি ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায়, তাদের মূল এজেন্ডা কী হবে। প্রশ্নটি নিছক সৌজন্যবশত করা হয়েছিল নাকি বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখা হয়েছিল—সেটি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত তাদের অগ্রাধিকারে তিনটি বিষয় তুলে ধরেছে: শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈতিকতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ। এসব প্রতিশ্রুতি শুনতে নতুন নয়, তবে একটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলকে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা রাষ্ট্রক্ষমতার সম্ভাব্য অংশীদার ধরে প্রশ্ন করছে—এটিই রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত।
অন্যদিকে বিএনপি এখনো প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলেও তাদের জন্য নির্বাচনি পরিস্থিতি সহজ নয়। অভ্যুত্থানের পরপরই যেটি অনুমান করা হয়েছিল—আওয়ামী লীগের পতনের ক্ষণিক সুবিধা নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। তা এখন আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটছে না। কারণ, বিএনপি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির সুবিধা পাবে এমনটা না বরং জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রভৃতি শক্তির সঙ্গেও ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।
বিএনপি অতীতে জামায়াতকে জোটসঙ্গী করেই ক্ষমতায় গিয়েছিল। আজকের প্রেক্ষাপটে সেই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য একদিকে রাজনৈতিক আশীর্বাদ, অন্যদিকে বোঝা। আশীর্বাদ এই অর্থে যে, জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনে সাথে ছিল, যা কোয়ালিশন রাজনীতিতে বিএনপিকে সহায়তা করতে পারে। আবার বোঝা, মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বিএনপির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বক্তব্যের সুযোগ করে দেয়। এবার যদি জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, তাহলে বিএনপির পক্ষে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেটিও এখনো অনিশ্চিত। যদি তারা বাইরে থাকে, তবে তাদের ভোট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিএনপির ঘরে যাবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপির ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুইং ভোটার বা আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সমর্থকরা বিএনপিকে ভোট দিতে অনাগ্রহী হলে তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে যাবে। এ অবস্থায় বিরোধী পক্ষের মধ্যে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যেখানে জামায়াত প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়ে উঠতে পারে।
জামায়াতকে নিয়ে আরেকটি বাস্তবতা হলো, দলটি নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে নানা কৌশলে টিকে আছে। আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে তাদের আইনি ও প্রশাসনিকভাবে সংকুচিত করার চেষ্টা করলেও আদর্শিক লড়াইয়ে প্রবেশ করেনি। বরং রাজনীতি ও শাসনে ব্যর্থতা জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়েছে, যা জামায়াতকে নতুন জায়গা করে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা তিনটি বড় দলের শাসনকাল দেখেছে এবং প্রত্যেকটির সঙ্গেই দুর্নীতি ও অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ জড়িত, তারা হয়তো এবার বিকল্প খুঁজতে চাইবে। এই বিকল্পের তালিকায় জামায়াত কিংবা এনসিপি উভয়ই থাকতে পারে।
তবে জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এখনো অনেক দূরের সমীকরণ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরে যদি একটি মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ের প্রশ্নবিদ্ধ দল বা জোট সত্যিই সরকার গঠন করে, তার দায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ওপরই বর্তাবে। বিএনপি একসময় জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে, আবার আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে তাদের নির্মূল করার চেষ্টা করেছে। ফলে জামায়াত নানা কৌশলে শক্তিশালী হয়েছে।
বিএনপির বর্তমান অবস্থান হলো, তারা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলেও এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সমীকরণে অনিশ্চয়তা কোথাও থেকেই যাচ্ছে। জামায়াতের অবস্থান হলো, তারা একদিকে বিএনপির সম্ভাব্য মিত্র, আবার অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনে এই দ্বৈত সম্পর্কই সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অতীতের কোনো নির্বাচনের মতো হবে না। অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আস্থা হারানো রাজনৈতিক দলের পরিণতি সব দলের জন্য শিক্ষা। শুধু জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে আক্রমণ করলেই তাদের ভোট কমবে, এ নিশ্চয়তা নেই। আবার বিএনপির জন্যও কেবল আওয়ামী লীগের পতনের ফায়দা তুললেই চলবে না। গণতন্ত্র, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে দাবি জনগণ করছে, সেটি পূরণের বিশ্বাসযোগ্য রূপরেখা না দিলে কোনো দলই স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় যেতে পারবে না।
সুতরাং জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এখন এক অদ্ভুত টানাপড়েনে। বিএনপি একদিকে জামায়াতের ঐতিহাসিক মিত্র, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। জামায়াত একদিকে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ খুঁজছে, অন্যদিকে এককভাবে টিকে থাকার কৌশল নিচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব ও সম্ভাবনার মধ্যেই আগামী নির্বাচনের বাস্তব অঙ্ক নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশি ভোটাররা বহু বছরের ব্যর্থতা ও হতাশার পর নতুন কিছু চান। কিন্তু সেই নতুন কী রূপ নেবে—বিএনপির পুনরুত্থান, জামায়াতের চমক, নাকি অন্য কোনো বিকল্প শক্তির উত্থান—সেটিই এখনো সময়ের কাছে অমীমাংসিত প্রশ্ন।
বিএনপির জন্য নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
বিএনপির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। গত দেড় দশকের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও দলটি টিকে ছিল মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু এখন শুধু এই পরিচয়েই তাদের জয় নিশ্চিত হবে না। তাদেরকে জনগণের সামনে একটি সুসংহত ও বিশ্বাসযোগ্য উন্নয়ন রূপরেখা তুলে ধরতে হবে। অতীতে বিএনপি সরকার পরিচালনার সময় নানান অভিযোগ নিয়ে জনগণের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। এ অবস্থায় বিএনপি যদি শুধু আওয়ামী লীগের ভুলত্রুটি তুলে ধরে রাজনীতি করে, তবে তাদের ওপর থেকে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের আস্থা উঠে যেতে পারে, যারা পরিবর্তন চাইলেও অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না। এই শ্রেণির ভোটাররা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন চান না, বরং তারা চান এমন একটি দল, যারা সত্যিকার অর্থেই জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
জামায়াতের কৌশল ও ভবিষ্যৎ
অন্যদিকে, জামায়াত কৌশলগতভাবে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সরাসরি রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা হলেও দলটি তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কাজে লাগাচ্ছে। বিশেষ করে, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তাদের যে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম রয়েছে, তা এখনো অটুট। জামায়াতের এই সাংগঠনিক শক্তি ভোটের সময় নীরব সমর্থন বা ভোটব্যাংক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। উপরন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গেসাক্ষাৎ ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক মহলেও তারা নিজেদের একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই কৌশল জামায়াতকে কেবল বিএনপি বা অন্য দলের ছায়ায় নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করছে।
জামায়াত অতীতে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এলেও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজস্ব আদর্শিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন। এবার যদি তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পায়, তাহলে তারা কেবল বিএনপির মিত্রই নয়, বরং সরকার গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির শক্তি হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত হয়তো বিএনপিকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের শর্তে সমর্থন দিতে চাইবে, যা বিএনপির জন্য এক নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।
জনগণের প্রত্যাশা ও বিকল্প শক্তির উত্থান
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, বরং জনগণের মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছে। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের পতন গণতন্ত্রের জন্য একটি শুভ লক্ষণ। কিন্তু একই সময়ে তারা চিন্তিত এই ভেবে যে, এর ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে। জনগণের একটি অংশ জামায়াতকে তাদের আদর্শিক অবস্থানের জন্য সমর্থন করে, আবার আরেক অংশ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি মনে করে। অন্যদিকে, বিএনপির প্রতি জনগণের সহানুভূতি থাকলেও তাদের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকে গেছে। আগামী নির্বাচন তাই কেবল একটি দলীয় বিজয় বা পরাজয় নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আদর্শ ও ভবিষ্যতের একটি বড় পরীক্ষা। এটি কেবল ভোটের অঙ্ক নয়, বরং জনগণের দীর্ঘদিনের হতাশা ও নতুন করে কিছু পাওয়ার আকুলতার প্রতিফলন।
এই পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও একটি সম্ভাবনা। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলো যদি জনগণের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে, তবে তারা আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। এই দলগুলো তরুণ ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারে, যারা চিরাচরিত বড় দলগুলোর উপর আস্থা হারিয়েছেন। এদের উত্থান বিএনপির জন্য যেমন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ, তেমনি জামায়াতের জন্যও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কারণ, এই দলগুলো মূলত একই ধরনের ভোটব্যাংকের ওপর নির্ভর করে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী নির্বাচন একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেকার সম্পর্ক, তাদের নিজস্ব কৌশল এবং জনগণের প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হবে। এই টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই আগামী দিনের রাজনৈতিক বাস্তবতা নির্ধারিত হবে।
রাজু আলীম: কবি, লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।