বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন, নেই শঙ্কা

  • সম্পাদকীয়   
  • ১ অক্টোবর, ২০২৫ ২০:৪৫

সারাদেশে উৎসাহ আড়ম্বরে পূজার আয়োজন দেখে আমার শৈশবে পূজামণ্ডপ দর্শনের নিস্পাপ জিবনের মনের অকৃত্রিম আনন্দ উকি-ঝুকি মারছে আমার শহরের যান্ত্রিক জীবনে। মণ্ডপে ঠাকুরের পূজার প্রসাদ, কাকিমাদের নাড়ু, বাতশা, লুচির স্বাদ উষ্ণ ভালোবাসা এখনো আমায় গ্রামের পূজাবাড়িতে মণ্ডপে আকর্ষণ করে।

চোখে ভাসে দলে দলে নতুন কাপড়-চোপড়, ধুতি, শাল, ফতোয়া, পাঞ্জাবি দিয়ে সেজে-গুজে মণ্ডপ থেকে আরেক মন্দির নির্ভয়ে আনন্দের মহিমা ছড়িয়ে মা কাকিমারা, আপারা নির্দিধায় ঘুরেছেন। কেউ বক্র কথা বলার সাহস করত না। সমাজ ব্যবস্থায় তখন এমন বিনাশী ঘুনে ধরেনি। অন্যায় দেখলে যুবকরা জাতি, ধর্ম, বর্ন, নির্বিশেষে প্রতিবাদে ফেটে পড়ত।

পাড়াগুলো উৎসবের সম্মিলিত পাড়া হয়ে উঠত। এখনকার মতো জমকালো বাহারি বিদ্যুতের আলোক সজ্জা ছিল না। প্রাণে ছিল পবিত্রতা প্রাণের টানের সম্প্রীতি যা গোটা জাতিকে আলোকিত করত।

স্থানীয় প্রবীণ-নবীন সকলে নাটক, যাত্রা পালায় অংশ নিত। পূজায় মেলা বসত গ্রামীণ বাহারি সব খাদ্য নিয়ে । সম্মিলিতভাবে উৎসবের আনন্দ সকল ধর্মের মানুষ উপভোগ করত। মুরব্বীরা উৎসাহ দিত বাচ্চাদের বিনোদনের খোরাক জোগাতে। কট্টর মৌলোভীরা ধারের কাছে আসত না। তখন ছিল অটুট ধর্মিয় সম্প্রীতি, ভালোবাসা সহানুভূতি। সবার চোখে-মুখে আনন্দ ভাগাভাগির জ্যোতি ঝলকানি দেখা যেত। বাজারে দোকানে কেনাকাটার ধুম, খলিফার দোকানে-বাড়িতে বারবার আসা-যাওয়ার স্যান্ডেল খোয়ে যেতে দেখেছি। খলিফাদের স্বভাবই খদ্দের ঘুরান।

ঢাকের বাড়ি, শঙ্খের বাজান, মণ্ডপে ধুপের আরতি খেলা বাড়তি আকর্ষণ জোগাত। লুছি, নাড়ু, বাতশা, মটকা, কাকিমারা খেতে দিত। কখনো বিত্তশালী বব্ধুর বাড়ি রাজকীয় খাবারের নিমন্ত্রণে খাবারের লোভে ছুটে যেতাম। বাল্যকালের রত্ন সে সব বন্ধুরা আজ চিবিয়ে মেপে কথা বলে ইংরেজি বেশি বাংলার স্থান বাক্যে কম, ডেকোরেটর খাদ্য রান্না করে রেডি করে দেয়। কাকিমা-পিসিমা আপাদের হাতের ভালোবাসার মমতার সেই গন্ধ খাদ্যে নেই। সবই যন্ত্রের মতো ছলছে, আজ সহপাঠীদের চেনে না ডিজিটালে যোগাযোগ হয়। হায়রে পোড়া কপাল আব্বার মার খেয়েছি যে বয়সে বন্ধুর কাছে লুকিয়ে ছুটে যাওয়ার অপরাধে আজ সেই বয়সের ছেলে-মেয়ে অকৃত্রিম বন্ধুহারা জিবনে মোহের পিছনে ছুটে নিজেদের বিকশিত করতে পারছে না। এবার খুলনায় গেলে মা তখন বেঁচে ছিল বলল বিকাশ , মহারাজ, তোর বিমলদা এদের ইফতারের দাওয়াত দে। দাওয়াত দিলাম বিকাশ ও ভাবিকে ইফতারের আস্তে অনেক দেরি করল। আমরা বসে আছি বিকাশ আসে বলল বন্ধু ট্রাফিক জামে আটকা পড়েছিলাম তার শরীর ঘর্মাক্ত দৌড়ে এসেছে ইফতার সময় ধরতে প্রফেসর মানুষ তীক্ষ্ম জ্ঞানেরভাণ্ডার, মাকে বলল কাকিমা সরি দেরি করার জন্য চেয়ে দেখি খাদ্য খাবারের ব্যাগ ভরা এসব কিনতে বেশি সময় লেগেছে। একসাথে ইফতার করে ডিনার করলাম। বিকাশের আব্বা কালি-কাকা আমাদের এলাকায় বড় কৃপণ ধনী ছিলেন অপচয় সহ্য করতেন না।

রেখা আপা বড় ছিলেন আদর করতেন। আপার বিয়ে হয়েছিল আক বিজ্ঞান প্রফেসারের সাথে এখন বিদেশ থাকেন। আমাদের স্কুলের সকল শিক্ষক স্টাফ বন্ধুদের দাওয়াত করেছিল। খাওয়ার পর নবদম্পতির সামনে সুরেন্দ্রনাথ স্যার বঙ্কিম ভাষায় বক্তৃতা শোনালেন, হেড স্যার আজমল স্যার ইংরেজিতে কথা বললেন সবাই সারের দাতভাঙা ইংরেজি সাবলীলভাবে বলা লম্বা দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। আমাদের নতুন প্রজন্ম সেই শিক্ষক সেই বন্ধু সেই বড় রেখা আপার মমতা থেকে বঞ্চিত। কী করে এরা ভালোবাসা বিলাতে শেখবে। পরিচিতদের ডাক দেয় ফাস্ট ফুড দোকানে।

মণ্ডপে রাতে হ্যাজাক লাইট লাগান হতো। আলো বাড়ানোর জন্য অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানদের বাড়ি হ্যাজাক থাকত বিয়েসাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার হত। যে বাড়ি হ্যাজাক লাইট থাকত সেখান থেকে আনা হতো। লাইটের মান্টেল লাগাতে দু-চারজন লেগে যেত রিজার্ভ মান্টেল দশ-বারটা রেডি রাখা হতো বাতাশে হরহামাশা ভেঙে পড়ত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাম্প করতে হতো সাদা কেরেসিনের তেল দিয়ে চালাতে হতো।

সারাদেশে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ সাজানো হচ্ছে, ধোঁয়া-মোছা ছাফছাফাই চলছে। বাহারি সাজসজ্জা আলোক সজ্জা হচ্ছে। ৩৩ হাজার মণ্ডপে এবার পূজা হবে গত বার ৩২ হাজার ছিল। পূজার অনুদান বেড়ে ৫ কোটি হয়েছে গতবার ছিল ৩ কোটি। আসল অনুদান তাদের উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পাহারাদার হওয়া জরুরি। মুসলমানদের মনে ধর্ম বিদ্বেষ দূর করা। বিজিপি অত্যাচারিত এলাকায় ভারতে গতবার মুসলমানদের ঈদের জামাতের নামাজে হিন্দু যুবকরা চারপাশে দাড়িয়ে অতন্দ্র প্রহরির মতো পাহারা দিয়েছে। করোনায় মৃত হিন্দুর লাশ কাধে নিয়ে ভারতের ইমাম মুয়াজ্জিন মুসলমান ভাইরা মিলে চিতায় নিয়ে সতকার করেছে। এই সাম্য এটাই সবার ওপর মানুষ। ‘হে মানুষ তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’

কোনো মণ্ডপে আমি শঙ্কা করি কোনো নাশকতা যেন এই আনন্দে ছেদ টানতে না পারে। প্রতিবার প্রতিমা আক্রমণের প্রতিবাদ করেছি এখনো করব প্রয়োজনে ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করব।

নাশকতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী বিজিবি র‌্যাব কোস্ট গার্ড আনসার, পূজা কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক টিম থাকবে। দুর্গোৎসব উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র, ধর্ম মন্ত্রণালয়, পূজা উদযাপন পরিষদ, সকল ধর্মের গণ্যমান্য লোক নিয়ে বৈঠক হয়েছে। অতিতে দেখেছি হরিষে বিষাদ কুচক্রিরা দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করে দেশের ভাবমূর্তি ভুলিণ্ঠিত করেছে। অতীতে কুমিল্লা জেলা ও অনান্য জেলায় অপ্রিতিকর ঘটনা হয়েছে। সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ সকল ধর্মের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দেয়।

কেন শঙ্কা থাকবে এই শঙ্কাই সংখ্যা গুরুদের জন্য লজ্জার।

কী করে মুখ দেখাই আমার জিবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মাস্টার মশাই সবাই ছিল হিন্দু। সহপাঠী বন্ধু আপা কাকিমাদের সামনে মুখ দেখাতে লজ্জা পাই। তাদের সুরক্ষা দিতে পারিনি।

তারাও এ দেশের মালিক কেন তাদের পূজা উদযাপনে সরকার, সেনা, পুলিশ বিজিবি পাহারা লাগবে। বাংলাদেশে কি মানবিক মানুষ ন্যায়পরায়ন সাহসী মানুষ নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদী সন্তান আমার বাংলার মায়েরা প্রসব করতে কি ভুলে গেছে?

কোথায় ক্ষুদীরাম, শরত বসু, আবুল কালাম আজাদ, প্রীতি লতা, কোথায় হাজি মহসিন। কোথায় অগ্নিপুরুষ নজরুলের সম্প্রীতির বাণী। কোথায় সে বিদ্রোহী যিনি কুচক্রীর যম। আর কোনো প্রতিবাদী এ অভাগা জাতীর ভাগ্যে কি জুটবে না। নজরুল- ভণ্ডের, মূর্খের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে সাম্য মানবতাকে সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন।

প্রতিমা ভাঙা হামলা চিত্র মনে এলে পচা রাজনিতি প্রানে পীড়া দেয়। কোনো ধর্মীয় কারণে প্রতিমা ভাঙা আজ পর্যন্ত হয়নি সব রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।

মানবতার কবি সত্যের কবির অমর কথা মনে পড়ে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কি ধোলাই দিয়ে গেছেন তিনি। তার প্রয়োজন এখনো দেখা যাচ্ছে। পূজার আগে তার অমর কথা শোনাই অসম্প্রদায়িক জাতী গড়ার প্রয়োজনে। দেখুন নজরুল কী সাহসী প্রতিবাদ করে গেছেন বিভাজন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে।

‘কাটিয়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা, ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা, ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ, ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত, এক মানবের একই রক্ত মেশা কে শুনবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’ ‘পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি কোনো মানুষ। গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সবকালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্যাতি।’

‘মানবতার এই মহান যুগে একবার গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও, তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’ উপরের উদ্ধৃতিগুলো স্মরণে রেখে কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ৪৭তম প্রয়াণ দিবসে তার প্রবন্ধে প্রকাশিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা সম্পর্কে আলোকপাত করা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যবহ।

‘একই দেশের ফুলে-ফসলে পুষ্ট দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে ‘ধর্মের নামে উগ্র মদ পান’ করিয়ে অযথা মাতাল করে তুলে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। আর শিক্ষা-বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে করে তুলেছেন নিজেদের হাতের পুতুল। রাজনৈতিক নেতারা চারপাশে ‘ভাড়াটিয়া মোল্লা মৌলভী পণ্ডিত পুরুত’ জুটিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে আপন আপন সম্প্রদায়ের পক্ষে ওকালতির ব্যবস্থা করেন। নজরুলের কথা, তরুণরা যেন ‘কদর্য’ হানাহানির ঊর্ধ্বে থাকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম কোনো অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করিতে আদেশ দেন নাই। ইসলামের মূলনীতি সহনশীলতা। পরমত সহনশীলতার অভাবে অশিক্ষিত প্রচারকদের প্রভাবে আমাদের ধর্ম বিকৃতির চরম সীমায় গিয়া পৌঁছেছে।’ যুব সমাজের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে যদি না পারেন, তবে বৃথাই আপনি মুসলিম।’ মুসলমানদের ভুল আর পশ্চাদশতা বিষয়ে লেখকের ওই দুর্ভাবনা এ যুগের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের ‘শেষকথা’, ‘আমরা যৌবনের পূজারী, নব-নব সম্ভাবনার অগ্রদূত...।’ পৃথিবীর অগ্রগামী পথিকদের সঙ্গে সমতালে পথ চলব। পরস্পর যাবতীয় বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম লক্ষ্য করেছেন ভারতবর্ষের অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আভিজাত্যবোধের কারণে। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধনের মাধ্যমে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করায় নজরুল ছিলেন আন্তরিক। হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূলে উভয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক জ্ঞানবিমুখতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। (নবযুগ)। এ সম্পর্কে কবি লিখেছেন-‘আমি হিন্দু-মুসলমানের পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নেই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনেশোনেই তা করেছি।’ বস্তুত বিশ শতকজুড়ে হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে লোভী মানুষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের মতো জমা হয়ে থাকা- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য, কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার সেই প্রচেষ্টাকে স্মরণে রেখে, অনুশীলন করে একুশ শতকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সাম্যবাদী সমাজ।

লেখক: কলাম লেখকও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর