সূরা সাজদাহ, পর্ব ৬
অনুবাদ
(২৬) এসব (ঐতিহাসিক ঘটনাবলি) দ্বারাও কি তাদের হিদায়াত হলো না যে, তাদের পূর্বে আমি অনেক প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের বাসভূমিতে (আজ)-এরা চলাফেরা করছে। এতে নিশ্চয়ই অনেক নিদর্শন রয়েছে। এরা কি শুনতে পায় না? (২৭) তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি শুষ্ক ভূমিতে পানি প্রবাহিত করি, অতঃপর তা দ্বারা ফসল ফলাই, যা থেকে তাদের পশুরা ও তারা নিজেরা খাদ্য গ্রহণ করে? তারা কি দেখে না? (২৮) তারা বলে: সে ফায়সালা কখন হবে, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো? (২৯) বলে দাও: যারা কুফরিকরেছে, ফায়সালার দিন ঈমান আনলে তাদের কোন লাভ হবে না। আর তাদেরকে কোন অবকাশও দেওয়া হবে না। (৩০) সুতরাং তাদেরকে (তাদের অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে) এড়িয়ে যাও। আর তুমি অপেক্ষা করো, তারাও অপেক্ষমানই আছে।
মর্ম ও শিক্ষা
গোটা সূরাতে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, আল্লাহর কিতাব, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। তারপর এখানে এ সূরাটির উপসংহার টানা হয়েছে। এ উপসংহারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপরের সবকয়টি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বশেষে বলা হয়েছে, এরপরে যদি বাতিলপন্থিরা পথে না আসে, তাহলে তাদের পিছনে সময় নষ্ট করা অথবা এর জন্য মর্মাহত হওয়ার কারণ নেই। রাসূল ও সত্যপন্থিদের উচিত হবে, তাদের এড়িয়ে যাওয়া এবং নিজ কাজে মনোনিবেশ করা। তারা অপেক্ষা করতে থাকুক, দেখুক তাদের কি পরিণতি হয়।
ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ
এখানে আল্লাহ বিস্ময় প্রকাশ করছেন, পূর্বে যেসব জাতি সত্য-প্রত্যাখ্যান ও সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো দেখেও তারা কিভাবে উদাসীন আছে এবং শিক্ষা গ্রহণ করে না। এ তাগিদের সারমর্ম হলো এই যে, অতীত জাতিসমূহের পতনের ইতিহাস চর্চা করা, কি কারণে তাদের পতন হয়েছে তা খতিয়ে দেখা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কোরআনে বার বার বলা হয়েছে, কোন জাতি যখন সত্য-প্রত্যাখ্যান পূর্বক সীমালঙ্ঘন করে গেছে, তখন তাদেরকে প্রথম দিকে অবকাশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরেও যখন তারা পথে আসেনি বরং সীমালঙ্ঘনে অটল ও অবিচল রয়েছে, তাদের অনেক জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সে ইতিহাসগুলো তাদের পাঠ করা উচিত, এবং সেখান থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
পূর্ব জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া: দেশ ভ্রমণের একটা নতুন উদ্দেশ্য
পূর্ব জাতিসমূহের ধ্বংস ও পতনের পুঁথিগত ইতিহাসই শুধু নয়, বরং অনেক স্থানে তাদের পতনের চিহ্ন রয়েছে। তা দেখার জন্য দেশ ভ্রমণ করা উচিত। আয়াতে বলা হয়েছে, মক্কার লোকেরা তৎকালীন শাম দেশ ও আশে পাশের এলাকায় বিভিন্ন জাতির পতনের চিহ্ন দেখতে পায়। এসব এলাকায় তারা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য চলাফেরা করে। এসব দেখেও তারা কিভাবে চুপ থাকে? কুরআনের অন্যত্র মানুষকে অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশে দেখতে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভ্রমণ নয়, বরং অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভ্রমণ করা উচিত। এখানে দেশ ভ্রমণের একটা আদর্শিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ইতিহাস পাঠ করা উচিত। চিন্তা করে দেখা উচিত, কি কি কারণে তারা ধ্বংস হয়েছে।
শ্রবণশক্তিকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো
বলা হয়েছে, এরা কি শুনতে পায় না? অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস ও ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সত্য-প্রত্যাখ্যানের পরিণতির সাক্ষ্য রয়েছে, তদুপরি সত্যপন্থীরা সত্যের দাওয়াত দেয়, কিন্তু তবু বাতিলপন্থীরা কর্ণপাত করে না। তাদের কান আছে, কিন্তু শুনে না। অথচ কান দেয়া হয়েছে শুনার জন্য। এজন্যই আল্লাহ বিস্ময়ের সুরে বলেছেন, এরা কি শুনতে পায় না? সুতরাং শ্রবণ শক্তিকে কাজে লাগানো উচিত।
পুনরুত্থান, কিয়ামত ও আখিরাতের প্রাকৃতিক প্রমাণ
আয়াতে বলা হয়েছে, তারা কি এ বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখে না যে, আল্লাহ শুষ্ক মৃত ভুমিকে আকাশের পানি দ্বারা পুনর্জীবন দান করেন। এতে করে মৃত ভুমি আবার জীবন্ত হয়ে উঠে। সেখানে ফল ও ফসল উৎপন্ন হয়। যা তারা নিজেরাও খায়, পশু পাখীরাও খায়। যখন শুষ্ক মৃত ভূমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণের পর সিক্ত হয়ে উঠে, জীবন্ত হয়ে উঠে, তখন তারাই তো সেখানে চাষ করে। এ ঘটনাটি তাদের চোখের সামনে ঘটে। এখান থেকে কি তারা বুঝতে পারে না, যে আল্লাহ শুষ্ক মৃত জমিকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন, তিনি একজন মৃত মানুষকেও পুনর্জীবিত করতে পারবেন। অর্থাৎ কিয়ামত ও পুনর্জীবন সম্ভব, এবং তা অকাট্য সত্য, যার দলীল-প্রমাণ প্রকৃতির মধ্যেও রয়ে গেছে। মানুষ যদি একটু বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তা বুঝতে পারবে।
দাওয়াত ও চ্যালেঞ্জ: বিজয় অনিবার্য
কোন কোন তাফসীরকার মৃত শুষ্ক ভূমিকে বৃষ্টির পানি দ্বারা জীবন্ত করে তোলা এবং তাতে ফসল ফলানোর আরেক রূপক ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। তা হলো এই যে, রাসূল ও সত্যপন্থিরা যখন মানুষের নিকট সত্যের দাওয়াত নিয়ে যায়, তখন অনেকেই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কোন কোন সময় মনে হয় তাদের দাওয়াত নিষ্ফল হয়ে গেছে, তাদের হৃদয় যেনো মৃত, যাতে সত্যের বীজ অংকুরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখানে আল্লাহ ঘোষণা করছেন, নিরাশ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। দাওয়াতী কর্মকাণ্ড দ্বারা আল্লাহ মৃত হৃদয়েও জীবন সঞ্চালন করবেন। সেখানে দীনের চারা অঙ্কুরিত হবে। ফুলে ফলে ভরে উঠবে সে মৃত ভুমি। কাজেই সত্যপন্থীদের উচিত নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।
আখিরাতের ব্যাপারে বাতিলপন্থীদের বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন
অনেক বাতিলপন্থি কিয়ামত ও আখিরাত অস্বীকার করে। তাদের নিকট যখন ঈমান ও আখিরাতের কথা বলা হয়, তখন তারা বিদ্রুপের সুরে বলে, কিয়ামত যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা কখন আসবে। তার দিনক্ষণ আমাদেরকে বলো। এখানে আল্লাহ তাদের এমন কথার এ জবাব দিতে পরামর্শ দিয়েছেন যে, সে ফায়সালার দিন অবশ্যই আসবে। তখন তারা সত্যিই চাক্ষুস দেখতে পারবে যে আখিরাতের ওয়াদা সত্য ছিল। তখন তারা ঈমান আনতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে না।
সময় শেষ হয়ে গেলে শুভ বুদ্ধিতে কোন লাভ নাই
এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো এই যে, যার যে দায়িত্ব তা সময় থাকতেই পালন করতে হবে। কেউ যদি সে কর্ম ও দায়িত্বকে অস্বীকার করে অথবা অস্বীকার না করা সত্ত্বেও উদাসীন ভাবে সময় কাটিয়ে দেয়, তাহলে সময় শেষ হয়ে গেলে শুভ বুদ্ধির উদয় হলেও কোনো লাভ নেই। কোরআনে বার বার বলা হয়েছে, সময় শেষ হয়ে গেলে যখন মৃত্যু সমাগত তখন ঈমান আনলেও লাভ নেই। কিয়ামতের দিন অনেক বাতিলপন্থি মানুষ আল্লাহর সামনে ভুল স্বীকার করে মিনতি করবে যেনো তাদেরকে একটু অবকাশ দেয়া হয়। যেনো আবার দুনিয়াতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তাহলে তারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করবে এবং বেশি বেশি ইবাদত করে ক্ষতিপূরণ করবে। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হবে না বরং বলা হবে তোমরা এখন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করো।
দুনিয়ার জয়-পরাজয়ের ফায়সালা আল্লাহর হাতে
কেউ কেউ আয়াতটির অন্যরূপ ব্যাখ্যাও করেছেন। তা হলো এই যে, বাতিলপন্থিরা সত্যপন্থি মুমিন মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস দেখে প্রশ্ন করত, যদি তোমরা সত্যিই ঠিক হয়ে থাকো, আর যদি মনে করো শেষ পর্যন্ত তোমারাই বিজয়ী হবে, তাহলে সে বিজয় কবে আসবে? তোমরা তো মার খেয়েই চলেছো? সে প্রসঙ্গে এখানে বলা হয়েছে, ফায়সালা আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যখন এবং যে সময়কে উপযুক্ত মনে করবেন, তখনই জয় দিবেন। তবে জয়ের পূর্বে জয়ের শর্ত পূরণ করতে হবে। তা হলো ধৈর্য, সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো সত্যের পথে সংগ্রাম, বলিষ্ঠ ঈমান ও ঐক্য। যখন এসব শর্ত পূরণ হবে তখনই বিজয় আসবে। অসত্যের পরাজয় হবে।
দুনিয়ার জীবনে বাতিলপন্থিদের সম্ভাব্য পরাজয় ও শাস্তি
আয়াতে সত্যপন্থিদের বলা হয়েছে, তারা যেন অপেক্ষা করে, আর বাতিলপন্থিরাও যেন অপেক্ষায় থাকে। এর একটি অর্থ এই যে, বাতিলপন্থিরা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক। তারা দুনিয়াতেই তাদের পরিণতি দেখতে পারে। তারা আল্লাহর নিকট থেকে শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে, সমূলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, অথবা পরাজিত হতে পারে। সুতরাং মক্কার বাতিলপন্থীরা করুণ পরাজয় স্বীকার করেছিল।
কিয়ামতের বাতিলপন্থিদের করুণ পরিণতি
বাতিলপন্থিরা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক, এর আরেকটি অর্থ হলো এই যে তারা দুনিয়ায় আনন্দ করে কাটাক এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক। কিয়ামতের দিন তারা অত্যন্ত কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে।