সামাজিক মাধ্যমসহ পত্র-পত্রিকা খুললেই আত্মহত্যার সংবাদ। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সুযোগ সুবিধাসহ মানুষের জীবনের মান বাড়ালেও এখন কেন এত দুঃখজনক ঘটনা? তাই সংগত কারণেই হাতে কাগজ-কলম তুলে নিয়েছি।
মূলত মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রকৃতিগত শাশ্বত ধারায় কেউ মৃত্যুকে রোধ করতে পারবে না। মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে যেভাবেই হোক। তবে এই মৃত্যুর ফয়সালা আমাদের হাতে নয়। আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন মানুষ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিহিত করে থাকে। তথ্যমতে জানা যায় যে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে আত্মহত্যা চলে আসছে। তবে কোন সময় এটি ভালো চোখে দেখা হয়নি। এই ধরনের মৃত্যু নিজেই নিজেকে হত্যা করা। আসলে নির্মমভাবে নিজেকে হত্যার নামই আত্মহত্যা। সুখ-দুঃখ মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষ অতি আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে যেমন বেড়ে উঠে; তেমনি অতি দুঃখে হতাশাগ্রস্ত জীবনের মুখোমুখি হয়ে থাকে। আর এটি প্রায় মানুষের বেলায় এটি চরম সত্য। মানুষ যখন চরম থেকে চরম দুঃসহনীয় সময়ে অতিবাহিত করে। তখন অবস্থাভেদে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেকে নিজেই হত্যা করার মতো বিষয় বেছে নেয়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিস্থিতি তার আয়ত্তে থাকে না। শুধুই মাথায় ঘুরপাক খায় কিভাবে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। কেবল একই চিন্তা নিজেকে শেষ করতে পারলেই বুঝি বাঁচা গেল। এমন কষ্টের আর দুর্দিনের পরিস্থিতিতেই মানুষ আত্মহত্যার মতো নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা যদি একজন আত্মহত্যাকারী তার মৃত্যুর আগে সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝতে পারত! তাহলে হয়তো এ পথে কখনও আসত না। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গের অন্যতম কারণ। যেটি পরে রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির। কেন এই আত্মহত্যার প্রতি মানুষের এত ঝুঁকে পড়েছে? কেন এই সিদ্ধান্ত নিতে মানুষ একটা মুহূর্তের জন্যও এতটুকু ভেবে দেখে না। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম অবস্থানে। উল্লেখ্য যে, কিশোর-কিশোরী, আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। তথ্য মতে জানা যায় যে, প্রায় ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। এশিয়াতে মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত আত্মহত্যার মাধ্যমে যারা মারা যায়, তাদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যে জটিল ডিপ্রেশন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫% মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে ইসলাম ধর্মে উল্লেখ আছে যে, আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ। যা তাওবা ছাড়া মাপ হওয়া সম্ভব না। একমাত্র তাওবার মাধ্যমেই এ গুনাহ থেকে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির তাওবার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের বিষন্ন লাগতেই পারে। মন খারাপ হতে পারে, হতাশা থাকতে পারে। এগুলো কোনো বড় বিষয় নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, এ জায়গায় নিজেকে কঠোর থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনাও কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।
বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন; আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা; দাম্পত্য কলহ; উত্ত্যক্তকরণ; প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা; দারিদ্র্য ও বেকারত্ব; আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা; মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যা ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রচার মাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এভাবে আত্মহত্যার প্ররোচনার অর্থ এমন পরিস্থিতি সচেতনভাবে সৃষ্টি করা, যা পীড়িত মানুষটির সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না। এদিকে নিদারুণ অপমানের শিকার হয়ে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে বহু মানুষকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখা যায়। এ প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের প্রথম দিকে একটি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আত্মহননকারী ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের পরিবারের সদস্য, সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে। ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই চরম হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছে। ফেসবুকে লাখো-কোটি মানুষ তার আত্মহত্যার ভিডিওটি দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের মানবিক বোধগুলো কি এতখানি নিচে নেমে গেছে যে, কোনো কিছুই এখন আর আমাদের স্পর্শ করে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। জরিপমতে বিশ্বে পুরুষ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে। এক্ষেত্রে নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ। সাধারণত ঝিনাইদহে অধিক আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। আর কোনো ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যা করেন না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।
উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি নানা উদ্যোগের কারণে এ প্রবণতা নিম্নমুখী। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুটা কমলেও আত্মহত্যার হার এখনও তুলনামূলক অনেক বেশি। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। এখানে বয়সভিত্তিক আত্মহত্যার প্রবণতায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সি নারীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ আত্মহত্যার হার বাংলাদেশে। এদিকে ভৌগোলিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয়। প্রতি লাখ মানুষে ১৯ দশমিক ২ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ১১ দশমিক ৪ জন, যা বৈশ্বিক গড়ের (৯ দশমিক ০) চেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীর আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতাও কম নয়। ইদানীং তথ্য প্রযুক্তি উন্নতির পথ ধরে মোবাইলে অপসংস্কৃতির কারণে মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার কথা শোনা যায়।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজারের উপরে আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী। আর ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এদিকে আর শহরের চেয়ে এ হার গ্রামে বেশি। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, কিশোর বয়সে নানা কারণে হতাশা তৈরি হয়, যা থেকে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা বা কাউসেলিং করা না হলে এই বিষন্নতা আত্মহত্যার দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিশোরীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। তারা এ বয়সে ব্যর্থতা মোকাবিলা করার শিক্ষা অনেক সময় পরিবার ও সমাজ থেকে পায় না। একটুতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। সময়মতো সঠিক সেবা দেওয়া গেলে আত্মহত্যার অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, এটি এমন একটি প্রপঞ্চ, চেষ্টা করে নির্মূল করা যাবে না। তবে বিভিন্ন ভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম। বেশির ভাগ সময় তাদের ছোটখাটো মানসিক উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে বড় ধরনের মানসিক সংকটে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বলতে গেলে দেশে এর মহামারি চলছে। তাই স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সমীচীন বলে মনে করি।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।