বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে, যেখানে রপ্তানি এ প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি। ঐতিহ্যগতভাবে দেশটি প্রস্তুত তৈরি পোশাক (RMG)-এর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছে, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি যোগান দেয়। তবে বর্তমানে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং নতুন উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশের চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে, বাংলাদেশকে শুধু পণ্যের মান উন্নয়নই নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে চলার ক্ষেত্রেও মনোযোগী হতে হবে। এই মানদণ্ড পূরণে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিগুলির একটি হলো গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ।
গামা রেডিয়েশন এক ধরনের আয়নীভূত বিকিরণ, যা নিরাপদ ও কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি হিসেবে ৬০টিরও বেশি দেশে স্বীকৃত। এটি ক্ষতিকর অণুজীব ধ্বংস করে, পণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়ায় এবং খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের ভৌত বা পুষ্টিগুণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না এনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) খাদ্য নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের জন্য এই প্রযুক্তিকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে সমর্থন করেছে। গার্মেন্টস ও চিকিৎসা টেক্সটাইলের ক্ষেত্রেও গামা রেডিয়েশন ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ নিশ্চিত করে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কঠোর মানদণ্ড পূরণে সহায়তা করে।
মূল প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশ কি গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারবে কি?
বর্তমান প্রেক্ষাপট: রপ্তানি ও মানের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যদিও পোশাক খাত এখনো প্রাধান্য বিস্তার করছে, ফল, শাকসবজি, মসলা, কোমল পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের মসলা ও ফলের চাহিদা বাড়ছে। তবে প্রায়ই রপ্তানি চালান বাতিল হয় মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ এবং সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রচলিত জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি যেমন রাসায়নিক ফিউমিগেশন, তাপ চিকিৎসা ও হিমায়ন কিছুটা কার্যকর হলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাপে পণ্যের স্বাদ ও গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে এবং হিমায়ন পরিবহন ব্যয় বাড়ায়। উপরন্তু, অনেক আমদানিকারক দেশ এখন রাসায়নিক ফিউমিগেশন পরিহার করছে এবং নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিকিরণকে বাধ্যতামূলক করছে।
গার্মেন্টস খাতে, বিশেষ করে চিকিৎসা টেক্সটাইল ও সুরক্ষা সামগ্রীর ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্তকরণ অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণের অবকাঠামো প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে রপ্তানিকারকদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, এবং প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।
কেন গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ গুরুত্বপূর্ণ
প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় গামা রেডিয়েশন বেশ কয়েকটি সুবিধা প্রদান করে:
- সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি – গামা রেডিয়েশন প্রয়োগে ফল, শাকসবজি ও মসলার সংরক্ষণকাল বাড়ে, পুষ্টিগুণ ও স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকে, যা দূরবর্তী বাজারে রপ্তানির জন্য উপযোগী করে তোলে।
- মানদণ্ড পূরণ – ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মতো বাজারে কঠোর মাইক্রোবিয়াল নিরাপত্তা মানদণ্ড রয়েছে। গামা রেডিয়েশন এসব মান পূরণের নিশ্চয়তা দেয়।
- অবশিষ্ট-মুক্ত প্রক্রিয়া – রাসায়নিক ফিউমিগেশনের মতো কোনো অবশিষ্টাংশ থাকে না, ফলে এটি পরিবেশবান্ধব ও ভোক্তাবান্ধব।
- বহুমুখী ব্যবহার – খাদ্য, কোমল পানীয়, ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও গার্মেন্টস—সবখানেই এর ব্যবহার সম্ভব।
- প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা – ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ ইতোমধ্যেই উন্নত বিকিরণ সুবিধা স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলে বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।
বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা যতই বড় হোক, বাংলাদেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:
- বৃহৎ প্রাথমিক বিনিয়োগ – একটি বাণিজ্যিক বিকিরণ প্ল্যান্ট স্থাপনে কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে কোবাল্ট-৬০ উৎস, সুরক্ষা অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দক্ষ জনবল।
- সীমিত সচেতনতা – অনেক রপ্তানিকারক এখনো এর সুফল সম্পর্কে সচেতন নন। জনগণের মধ্যেও বিকিরণ নিরাপত্তা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে।
- নীতিগত কাঠামো – যদিও বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আছে, বাণিজ্যিক বিকিরণ সুবিধার জন্য বিস্তারিত নীতি ও নির্দেশিকা এখনো সীমিত।
- দক্ষ জনবল – একটি বিকিরণ প্লান্ট পরিচালনায় রেডিয়েশন পদার্থবিদ, প্রকৌশলী ও সেফটি অফিসারের প্রয়োজন হয়। BAEC ও MIST-এর মতো প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা থাকলেও বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দরকার।
- বেসরকারি খাতের অনীহা – বিনিয়োগ ফেরত পেতে দীর্ঘ সময় লাগে, ব্যবসায়িক মডেল এখনো সুস্পষ্ট নয়, এবং সরকারি প্রণোদনা অনিশ্চিত হওয়ায় উদ্যোক্তারা দ্বিধাগ্রস্ত।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সম্ভাবনা ব্যাপক:
- ফল ও সবজি রপ্তানি – বাংলাদেশ আম, আনারস, লিচু ও শাকসবজির বড় উৎপাদক। বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো ইউরোপ ও জাপানের মতো বাজারে প্রবেশ করতে পারবে, যেখানে বর্তমানে কঠোর মানদণ্ড বাধা সৃষ্টি করছে।
- মসলা ও ভেষজ পণ্য – হলুদ, আদা, মরিচের মতো মসলার মান বাড়াতে বিকিরণ কার্যকর। এতে জীবাণু নষ্ট হয় কিন্তু রঙ, গন্ধ ও তেল অক্ষুণ্ণ থাকে।
- প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও কোমল পানীয় – প্যাকেটজাত খাবার, জুস ও রেডি-টু-ইট পণ্য বিকিরণে দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ হয়।
- গার্মেন্টস ও চিকিৎসা টেক্সটাইল – কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী জীবাণুমুক্ত গার্মেন্টস, মাস্ক ও হাসপাতালের চাদরের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে পারে।
- সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি মডেল – বিকিরণ সুবিধাগুলো সেবা খাতে পরিণত হতে পারে, যেখানে একাধিক রপ্তানিকারক নির্দিষ্ট ফি দিয়ে এই সুবিধা নেবে।
সরকারের ভূমিকা
এই সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের করণীয়:
- নীতি সহায়তা – বাণিজ্যিক বিকিরণ কার্যক্রমের জন্য জাতীয় নীতি কাঠামো প্রণয়ন।
- আর্থিক প্রণোদনা – ভর্তুকি, কর ছাড় ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান।
- অবকাঠামো বিনিয়োগ – ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে পাইলট বিকিরণ কেন্দ্র স্থাপন।
- সচেতনতা কর্মসূচি – ভোক্তা ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে বিকিরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি।
- ক্ষমতা বৃদ্ধি – IAEA-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা
- সুবিধা স্থাপন – উদ্যোক্তা ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার বা স্বতন্ত্রভাবে বিকিরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারে।
- কনসোর্টিয়াম মডেল – মসলা রপ্তানিকারক, ফল উৎপাদক ও গার্মেন্টস প্রস্তুতকারীরা যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে পারে।
- গবেষণা অংশীদারিত্ব – বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
- বাজার উন্নয়ন – ‘নিরাপদ, রাসায়নিক-মুক্ত ও বৈশ্বিক মানসম্মত’ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি।
কৌশলগত রোডম্যাপ
- স্বল্পমেয়াদি (১–৩ বছর) – পাইলট প্ল্যান্ট স্থাপন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
- মধ্যমেয়াদি (৩–৭ বছর) – প্রধান রপ্তানি অঞ্চলে সুবিধা সম্প্রসারণ, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
- দীর্ঘমেয়াদি (৭–১৫ বছর) – বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বিকিরণ সেবার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং প্রতিবেশী দেশে প্রযুক্তি রপ্তানি।
উপসংহার
বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি ও মান অগ্রাধিকার পাচ্ছে। গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণ এখন আর বিকল্প নয়, বরং অপরিহার্য প্রযুক্তি। বাংলাদেশের জন্য এটি যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি বিরাট সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ বিনিয়োগ খরচ, নীতি সীমাবদ্ধতা ও জনসাধারণের ভুল ধারণা। তবে সুযোগ আরও বড়—নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান।
সরকারি নেতৃত্ব এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সমন্বয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। আজকের সাহসী পদক্ষেপই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি সফলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
প্রফেসর ড. মোখলেসুর রহমান
পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি