বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কৃষিঋণ নীতিমালা ও কৃষকের খাদ্যনিরাপত্তা

  • সম্পাদকীয়   
  • ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:১৭

দেশে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ যাগত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছর ২.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করতে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষিখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।নীতিমালায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ২০ শতাংশ করা, সেচ ও কৃষিযন্ত্রপাতি খাতে ২ শতাংশ বরাদ্দ, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের সিআইবি সার্ভিস চার্জ মওকুফ, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতা বৃদ্ধি, খিরা, কচুর লতি, বিটরুট, কালোজিরা, আদা, রসুন, হলুদ, খেজুর গুড় ইত্যাদি নতুন ফসল ঋণ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত এবং অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন সম্ভাবনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণের নির্দেশনা। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কৃষি ও পল্লী খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অর্থনীতি গঠনে এ নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্যনিরাপত্তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনীহার ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের ৩৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগের বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। তবে গত অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে এক বছরে কৃষিঋণ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন বেশি। পুরো অর্থবছরে কৃষিঋণ আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সবমিলে গত জুন শেষে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ২৩২ কোটি টাক, যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত অর্থবছরে যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জরিমানা হিসেবে অনর্জিত অংশ কেটে নিবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে তহবিলে জমা করা হবে এবং জমাকৃত অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা হবে। । যেসব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা পল্লি অঞ্চলে নেই, তাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) নিবন্ধিত এনজিও সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে এবং তারা যেন অতিরিক্ত সুদ নিতে না পারে, সে জন্য সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষিঋণ বিতরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য প্রতিবছর কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণাকরা হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা (২০২৫-২৬) বছরেধরা হতে পারে সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, প্রতিবছর কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও ব্যাংকগুলোর ছলচাতুরির কারণে তার উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো অন্য খাতে ঋণ দিয়ে তা কৃষিঋণ বলে চালিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন ফরমালিটিসের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের অধিকাংশই এনজিও নির্ভরতায় বিতরণ করে।

কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার পেছনে চারটি কারণকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এগুলো হলো- গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুদের হার বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট। সাম্প্রতিক গত বছর দুটি বন্যায় কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় কৃষি ঋণ বিতরণ কমে আসায় আসন্ন খরিপ, রবি ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও এর আগের খরার প্রভাবে এবার আরো বেশি করে কৃষি ঋণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে জোর না দেয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি সামনের দিনগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে উঠতে পারে।যদিও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনিশ্চয়তার প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষিতে ঋণপ্রবাহ কমলেও সামনের দিনগুলোয় তা আবারো বাড়বে।এ ব্যাপারে কৃষিঅর্থনীতিবিগন মনে করেন ‘সাম্প্রতিক দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে এবার কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বন্যা-উত্তর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবার আরো বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না থাকায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। ফলে খরিপ /রবি মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আমদানি নিশ্চিতের পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে ডলার সংকট। তাই সার্বিক কৃষিপণ্য সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দিতে পারে।’এ ব্যাপারে ব্যাংকারদে র মন্তব্য হলো গত বছর জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রভাব কমে এসেছিল। তখন মানুষ বের হতে পারেনি। আবার ১০-১২ ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষি ঋণ বিতরণে এটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কৃষি ঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় এটা আমাদের দিতেই হবে। আগামীতে আশা করছি ঋণ বিতরণ বাড়বে।’ কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহকে একটি বড় প্রভাবক বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের,তদের মতেঋণ না পেলে প্রান্তিক কৃষক কীভাবে উৎপাদন করবে? গতবার আলু উৎপাদন কম হওয়ায় চালের ওপর চাপ পড়েছে। তাই আগামীতে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ঋণের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে ।

গত বছরের শেষ দিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণ বিতরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; বিশেষত জুলাই-আগস্টে ঋণ বিতরণ ও লেনদেন কমে যায়। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ঋণ বিতরণে গতি ফিরেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে হবে এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা এবং কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। এখানে উল্লেখ্য যে গত বছরের মত এ বছরও আগের আশঙ্কাটি রয়েই যাবে সম্প্রতি ষোষিত জতিীয় সংসদ ইলেকশনের কারনে যা আগামী রমজানের আগে সংগঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ।এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কৃষকের মনে স্বস্থি নেই বিধায় কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। তাই কেবল কৃষি ঋন নয়,তার জন্য নীতি সহায়তা জরুরী যাতে কৃষক বেচে থাকতে পারে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা সময়ের দাবি ।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

এ বিভাগের আরো খবর