বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে তার জন্ম। বেঁচে থাকলে এবারের ১৮ অক্টোবর তাঁর বয়স হতো ৫৯ বছর।
১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যার পর সবশেষে দশ বছরের শিশু শেখ রাসেলকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। কালরাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রথম শহীদ হন শেখ কামাল। পরপর দুটি গুলি করে নির্মমভাবে শেখ কামালকে হত্যা করে খুনি বজলুল হুদা।
পরপরই দোতলা থেকে নিচতলায় নামার পথে সিঁড়িতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে মেজর নূর চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। গুলিতে বঙ্গবন্ধুর বুক ঝাঝরা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করেন ইতিহাসের মহানায়ক। খুনি চক্র এরপর বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করে।
মেজর মহিউদ্দিন তার ল্যান্সারের লোকজন নিয়ে উপরতলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিচে আসছিল। আর সিঁড়ির নিচে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে ছিল নূর ও হুদা। বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর শিশু রাসেল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কর্তব্যরত রমাকে নিয়ে নিচে যায় একজন খুনি সেনা সদস্য। এ সময় প্রথমে রমা ও পরে ধানমন্ডির বাড়ির রিসিপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ. ফ. ম. মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে শিশু রাসেল বলে, ‘ভাই আমাকে মারবে না তো?’
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মহিতুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল ওরা রাসেলকে মারবে না।’
সেই ধারণাতেই তিনি বলেন, ‘না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’
এরপর খুনি চক্রের একজন সদস্য মহিতুল ইসলামের কাছ থেকে রাসেলকে একরকম জোর করে নিয়ে যায়। রাসেল তখনও মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিল। খুনি সেনা সদস্য বলছিল, ‘তোমাকে তোমার মায়ের কাছেই নিয়ে যাচ্ছি।’
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মহিতুল ইসলাম গুলির শব্দ শুনতে পান। ঠাণ্ডা মাথায় কাছ থেকে একটি মাত্র গুলিতে ১১ বছরের কম বয়সের রাসেলকে হত্যা করা হয়।
রাসেলকে হত্যার পর ঘাতক সর্দার ফারুক ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে আসে। মহিতুল লিখেছেন ‘ফারুক কী যেন জিজ্ঞেস করে বজলুল হুদাকে। হুদা জবাবে বলে- ‘অল আর ফিনিশড।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।
ধানমন্ডির বাসভবনে রাসেল যেদিন জন্মগ্রহণ করে, সেদিন রাসেলের পিতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পূর্ববাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা, চারবারের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একটি লেখায় সেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, রেহানা ও খোকা চাচা তখন বাসায়। বড় ফুপু ও মেঝ ফুপু মা’র কাছে। একজন ডাক্তার এবং একজন নার্সও উপস্থিত ছিলেন।
“উৎকণ্ঠার সময় যেন আর কাটে না। জামাল এবং রেহানা কিছু সময় ঘুমিয়ে আবার জেগে ওঠে। নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায় আমরা ঢুলু ঢুলু চোখে প্রতীক্ষা করছি। এক সময় মেঝ ফুপু মা’র ঘর থেকে বের হয়ে এসে জানালেন যে আমাদের ভাই হয়েছে।
“খুশিতে আমরা তখন আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো নতুন মেহমানকে। ফুপু বললেন, অপেক্ষা করো কিছু সময়। তোমাদের ডাকা হবে। কিছুক্ষণ পর এলো সেই আনন্দের ডাক। বড় ফুপু সদ্য ভূমিষ্ঠ রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন। ঘন কালো চুলে মাথা ভরা। নরম তুলতুলে গাল। রাসেলকে গড়নে বেশ বড়সড় মনে হচ্ছিল।”
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একজন প্রিয় লেখক পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন ‘রাসেল’। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন বড় মাপের দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অতিশয় বড় মাপের একজন বিশ্বনেতা। ইতিহাস বিখ্যাত এই নামটিকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর হয়তো কোনো স্বপ্নও ছিল।
ষাটের দশক ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৬২ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের একটি হোটেলে ইন্তেকাল করেন।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করলেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে বিরোধী দলগুলোর একটি জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি পেশ করেন শেখ মুজিব।
১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে তিনদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিনে ২০ মার্চ শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় বেশ কয়েকজন বড় নেতা দল ছেড়ে চলে যান।
৮ মে মধ্যরাতে শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনসহ বড় বড় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। জেলে থেকেই শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার মানুষের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিত শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করাই ছিল আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের মূল লক্ষ্য।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ ষড়যন্ত্র মামলার সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। আইয়ুবের পতন হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি লাখো মানুষের ছাত্র-জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। মূলত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান।
১১ বছরের কম বয়সের জীবনে শেখ রাসেল পিতা শেখ মুজিবকে খুব একটা কাছে পায়নি। রাসেলের দেড় বছর বয়সের সময় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জেলে গিয়ে প্রায় ৩ বছর ছিলেন। ৩/৪ বছর হয়ে যাওয়ার পর অন্যদের সঙ্গে জেলে দেখতে গিয়ে বাবাকে ছেড়ে আসতে চাই তো না সে। সাক্ষাৎ শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাসেলের মন খুবই খারাপ হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের ছেলেটা (রাসেল) এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিবো। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ও তো বুঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তুমি তোমার মা’র বাড়ী যাও। আমার বাড়িতে আমি থাকি। আবার দেখতে এসো আমাকে। ও কি বুঝতে চায়...।” (কারাগারের রোজনামচা)।
এ প্রসঙ্গে রাসেলের বড় বোন শেখ হাসিনা তার গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রতি ১৫ দিন পর আমরা আব্বার সাথে দেখা করতে যেতাম। রাসেল আব্বাকে ছেড়ে আসতে চাইতো না। আসার সময় খুবই কান্নাকাটি করতো। বাসায় আব্বার জন্যে কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো। (আমাদের ছোট রাসেল সোনা, পৃ. ২১)।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে অনেক রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা, জননেতা, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা হয়েছে। কোথাও ১৫ আগস্টের মতো নিরপরাধ অবলা নারী, নববধূ, ১০ বছরের শিশুসহ একটি পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়নি।
আড়াই দশক পর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। ৩৫ বছর পর ৬ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ফাঁসিতে দণ্ডিত ৫ জন এখনও বিদেশে চোর-ছেচ্চরের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে এই হত্যার নেপথ্যের চক্রান্তকারীরা আজও চিহ্নিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের আংশিক বিচার হলেও শিশু রাসেলসহ অন্যদের হত্যার বিচার হয়নি।
১৯৮০ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের অলিখিত বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করছি।
তিনি বলেন, “... বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিক্রিয়া কেন হলো না ব্যক্তিগতভাবে কাউকে এর জবাব দিতে হবে না; ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য কারও বিচার হবে না। বিচারের কাঠামোয় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে সমগ্র জাতিকে, এদেশের মানুষকে।
“ইতিহাসকে জবাব দিতে হবে, সভ্যতাকে জবাব দিতে হবে, কৃষ্টিকে জবাব দিতে হবে, ধর্মকে জবাব দিতে হবে, ঈমানকে জবাব দিতে হবে এই বলে যে, ১০ বছরের শিশুকে হত্যা করা জায়েজ কিনা? নবপরিণীতাকে হত্যা করা জায়েজ কিনা? এ জবাব কারও কোনো ব্যক্তিগত জবাব নয়। সমগ্র জাতিকে নেমেসিস হিসেবে এর জবাব দিতে হবে।”
লেখক: কলামিস্ট
১৭ অক্টোবর ২০২৩