বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জিয়াউর রহমান

  • ফারাজী আজমল হোসেন   
  • ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ১২:২৫

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গোটা দুনিয়ায় প্রশংসিত। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদেরও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছে বাংলাদেশ। জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আজ চিহ্নিত ও প্রমাণিত।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে যখন দৃঢ়চিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বুকে প্রথম পেরেক ঠুকে দেয়া হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ হারায় তার জাতির পিতা, প্রথম বেসামরিক শাসককে। দেশ হাঁটতে শুরু করে সংবিধানে উল্লেখিত প্রগতিশীল রীতিনীতির উল্টো পথে।

সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা এবং সহিংস চরমপন্থি শক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যোগসাজশ ক্রমবর্ধমান নিয়মে পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল জুনিয়র সেনা অফিসার ট্যাংক নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ এর বাসভবনে হামলা চালিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার এবং ব্যক্তিগত কর্মীদের হত্যা করে। সাঁজোয়া কোরের দুটি ব্যাটালিয়ন এবং ১৫০০ সৈন্যের সহায়তায় মুষ্টিমেয় কিছু জুনিয়র অফিসার (২০ থেকে ২৫ জন মেজর এবং ক্যাপ্টেন) দ্বারা সংঘটিত প্রাক-ভোর অভ্যুত্থান জাতিকে বহু বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়। অভ্যুত্থান করা এই নেতাদের শিগগিরই উৎখাত করে পাল্টা অভ্যুত্থান এবং লাগাতার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দেশকে পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত করে।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে জড়িত নেতাদের ব্যক্তিগত অভিযোগ ছিল, সামরিক হস্তক্ষেপের প্ররোচনাই তাদের এই কাজে উৎসাহিত করে। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, শেখের পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে তারা মুজিববাদীদের ধ্বংস করে ক্ষমতা ভোগ করতে পারবে। শেষ মুহূর্তে তারা মুজিবের দুই মন্ত্রীর সমর্থনও আদায় করেছিল। এদেরই একজন মুজিবের সহকর্মী এবং সাবেক আস্থাভাজন, আমেরিকাপন্থী ও ধর্মান্ধ মুসলিম খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

মুজিব হত্যা শুধু ‘অভ্যুত্থান’ নয়, একটি গণহত্যাও। সেই গণহত্যায় শেখ সাহেব ছাড়াও তার স্ত্রী, ১০ বছরের এক শিশুসহ তাদের তিন ছেলে, দুই নববিবাহিত পুত্রবধূ, এক ভাই, শ্যালক এবং বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা মারা যান। শুধু তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানি সফরে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। তাদেরও বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির সূচনা মাত্র। জনসাধারণ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। মুজিবের সহযোগী এবং দ্বিতীয় সারির নেতারা অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আবার কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। সেনাবাহিনীর নাম করে মুজিবপন্থীদের ধ্বংস করার চেষ্টা চলে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ যারা মানবাধিকারের কান্ডারি সেজে রয়েছেন, তারা ১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশের এমন সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো দেখেও নিশ্চুপ থেকেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যার ঘটনাও তাদের নাড়া দেয়নি।

এই হত্যাযজ্ঞ যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী মাসগুলোর ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় ষড়যন্ত্রের জাল কতটা গভীরে ছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ক্ষমতার লড়াই এমন বিষয় দেখিয়েছে যে, একটি কার্যকর প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার চেয়ে সরকার পরিবর্তন করা বোধ হয় অনেক সহজ। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরপরই সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের কাছ থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সামরিক আইন ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রক্ষমতা ধারণ না করেই তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম কয়েক মাস জিয়াউর রহমান ডেপুটি চিফ মার্শাল আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেছেন।

৩০ নভেম্বর তিনি প্রধান মার্শাল আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অবশেষে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি কোনও বেসামরিক সরকারের ছায়া পর্যন্ত দেখতে রাজি ছিলেন না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও লোভের বশবর্তী হয়ে যেকোনো মূল্যে দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মূলত সবচাইতে লাভবান ছিলেন তিনি। অনেকেই বিষয়টিকে ‘ভাগ্য’ বলে অভিহিত করলেও আসলে এটি ছিল তুখড় গোয়েন্দা জিয়ার কূটকৌশল। তাই এটি স্পষ্ট করেই বলা উচিত, জিয়াই ছিলেন ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের মূল পৃষ্ঠপোষক।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই খুনি ফারুক ও রশিদ ১৯৭৬ সালে বিদেশি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে ফারুক রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। সব শুনে তিনি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন, তবে সিনিয়র অফিসার হিসেবে জিয়া নিজে সামনে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।’ ফারুক আরও বলেন, ‘খন্দকার মোশতাকের সঙ্গেও তার একাধিক বৈঠক হয়।’

এদিকে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি শাহরিয়ারও ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক মেঘনাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করেছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন। আমরা তার সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছি। অনেক জায়গায় মিটিং হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মাজেদ দীর্ঘদিন পরিচয় গোপন করে ভারতে লুকিয়ে ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা সদস্যদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি তাদের পরিবারের সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও দেন। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে চাকরির প্রস্তাবও দিয়েছিলেন জিয়া।

১৯৭৮ সালে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার থেকে মুক্তি প্রদান করেন। সামরিক ক্ষমতাবলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে মোটা বেতনে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই মূল খুনি মেজর ফারুক ও রশিদকে লিবিয়ায় বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা লিবিয়ায় বসবাস করলেও বাংলাদেশেও কোটি কোটি টাকার ব্যবসার জাল বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের আগস্টের অভ্যুত্থান শাসক হিসেবে সামরিক বাহিনীর উত্থানের পথ প্রশস্ত করে। জিয়া শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১) তাদের পরিপক্বতার একটি নতুন উচ্চতা অর্জনে সহায়তা করেছিল। আর এরশাদের শাসনামল একত্রীকরণের সময় হিসেবে পরিণত হয়েছিল। আগস্টের অভ্যুত্থান দেশে ধারাবাহিক পাল্টা অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থানের ভীত রচনা করে।

জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানকে স্বৈরাচারী আদেশের অধীনে নিয়ে আসে। সামরিক আইন অধ্যাদেশ জারি করে তিনি সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধের সংশোধনী নিশ্চিত করেন। সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ জিয়ার সামরিক শাসনামলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যাংশ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যা নিছক একজন ব্যক্তি হত্যা নয়, ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির আত্মাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন সামরিক স্বৈরশাসকরা তার কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই মুছে দিতে চেয়েছিল। জনগণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু যে অটুট বন্ধন ছিল, সেটিও ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন জিয়া, কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টা সাময়িক সাফল্য পেলেও চিরস্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার স্বপ্ন, সোনার বাংলাদেশ গঠনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাঙালি জাতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গোটা দুনিয়ায় প্রশংসিত। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদেরও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছে বাংলাদেশ। জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আজ চিহ্নিত ও প্রমাণিত।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি কমিশন গঠন করে তদন্তের দাবি দীর্ঘদিনের। ধারণা করা হচ্ছে এই কমিশন গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার আরও অনেক তথ্য সামনে বেরিয়ে আসবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এ বিভাগের আরো খবর