আমার চেম্বারে দুই পাশে দুটো বড় স্ক্রিনের টিভি ঝোলানো আছে। সাউন্ড কমিয়ে, প্রেসক্রিপশন করার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে টিভির পর্দায় চোখ রেখে দেশ-বিদেশের হাল-হকিকত সম্বন্ধে নিজেকে সজাগ রাখার এটা এক ধরনের চেষ্টা। চেষ্টাটা খুব একটা জুতসই না হলেও খুব একটা খারাপও না। এভাবেই বেশ তো চালিয়ে নিচ্ছি। সেদিন হঠাৎ চোখে পড়ল একটা নামকরা নিউজ চ্যানেলের টকশোর শিরোনামটা ‘দূতাবাসপাড়ায় রাজনীতি’।
শিরোনামটা এখন পুরোনো। খবরটাও বাসি। নির্বাচনের মৌসুমে তো বটেই, যেকোনো অজুহাতেই ছুতায়-নাতায় দূতাবাসপাড়ায় রাজনীতিকে নিয়ে ছোটা আর জনে জনে দেশের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে নিজেদের কাজটা বাগিয়ে নেয়ার এই টেকনিকটা বিএনপি বহু দিন ধরেই প্রয়োগ করে আসছে। এবারের এই শিরোনামটি সেই দেউলিয়া রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। এর আগেও তারা অজস্রবার একই কাজ করেছে। আর বরাবরের মত এবারও তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন দূতাবাস।
এ যাত্রায় বিএনপির মার্কিন দূতাবাস যাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ দলের মহাসচিব আর বাকি দুজনের মধ্যে অন্তত একজন দলটির পোড় খাওয়া, সিনিয়র নেতা। দেশে বিরোধী রাজনীতির যে কী দৈন্যদশা, সেটা তো এ থেকেই পরিষ্কার।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় লাঞ্চ টাইমে ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অবাধ নির্বাচন আর অহিংস রাজনীতি নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে বলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনকে সামনে রেখে অহিংস রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছে, সেটাও নাকি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে।
গত দুটো জাতীয় নির্বাচনেই যেখানে বিএনপির মূল স্ট্র্যাটেজি ছিল আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, সেই বিএনপির সাথে আর যাই হোক না কেন, অহিংস রাজনীতি তো কোনোভাবেই যায় না। এমন একটা ব্যাপার আমরা বুঝি, অথচ ঢাকায় অবস্থিত বিশ্বের সবচাইতে জাদরেল রাষ্ট্রটির জাদরেল কূটনীতিকরা বোঝেন না, এই বিষয়টি আমার কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের একটা বিষয় বলেই মনে হয়, তবে এসব নিয়ে আমার এতটা মাথাব্যথাও নেই।
কেউ যদি কোথাও গিয়ে নিজের মান-সম্মান যতটুকুইবা অবশিষ্ট আছে, তাও বিলিয়ে দিয়ে দেউলিয়া হতে মনস্থ করেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের বলার কীই বা থাকতে পারে? হাজার হোক এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে চলাফেরার আর মত প্রকাশের অধিকার আছে, তবে নাগরিকের যে অধিকারটি নেই, তা হলো নাগরিক দেশের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেন না।
শুধু বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের সংবিধানই তার কোনো নাগরিককে এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ দেয় না। পোড়া লাশের গন্ধ যাদের হাতে এখনও লেগে আছে, তাদের যদি মার্কিনিরা নিজেদের কমপাউন্ডে প্রবেশ করতে দেন, তবে তাতে আমাদের বলার কিছু নেই। আর সেই সুযোগে তারা যদি লাজশরমের বালাই না করে অহিংস রাজনীতির বুলি কপচিয়ে আসে তাতেও আমাদের থোড়াই কেয়ার, কিন্তু আমরা ব্যথিত হই যখন সেনানিবাসের আঁতুড়ঘরে জন্ম নেয়া দলটির নেতারা গণতন্ত্রের গান গেয়ে আসেন।
‘হ্যা বাক্স, আর না বাক্স’-এর নির্বাচন করে যারা নির্বাচনি ব্যবস্থাকে পচিয়ে-গলিয়ে গন্ধ ছড়িয়েছিলেন আর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনিকে জিতিয়ে এনে মহান জাতীয় সংসদকে করেছিলেন কলঙ্কিত, যারা পাঠককে ঘোষক বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হাইজ্যাক করার ছুতো খুজতে থাকেন আর সুযোগ পেলেই রাজাকারের গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে জাতির আর জাতির পতাকার মান-সম্মানকে করেন ভূলুণ্ঠিত, তাদের কাছ থেকে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক নির্বাচন আর অহিংস রাজনীতির সবক নিতে আমরা অন্তত রাজি নই।
গত নির্বাচনে দেশের মানুষ জাতীয় সংসদে এদের আসন দশের নিচে নামিয়ে ছেড়েছিল। লজ্জা হয়নি। অবশ্য হওয়ার কথাও না। তাদের রাজনীতির কালচারে ওই শব্দটির অস্তিত্ব থাকলে নিশ্চয়ই তারা মার্কিন রাষ্টদূতের এয়ারকন্ডিশনড ড্রইং রুমে বসে অমন নির্লজ্জ বাগাড়ম্বর করতে পারতেন না।
সবচেয়ে বড় কথা একটা রাজনৈতিক দল যখন রাজনীতিতে জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে বিদেশি দূতদের ড্রইং রুম থেকে ড্রইং রুমে ছোটাছুটি করতে থাকে, তখন তাদের পরিণতি যে সামনে মুসলিম লীগের চেয়েও খারাপ যাচ্ছে, সেটা তো সহজেই অনুমেয়। এখন অপেক্ষা শুধু আগামী নির্বাচনের, যেখানে তাদের পাওনাটুকু কড়ায় গন্ডায় এমনভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, যাতে আগামী জানুয়ারির পর থেকে তাদের ড্রইং রুমে প্রবেশাধিকার দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কোথাও কোনো রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রয়োজনীয় কোনো বিষয় বলে মনে হবে না।
লেখক: অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ