কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পঙক্তি ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ কবিগুরুর এই লাইনটিই মনে হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা চলার পথের পাথেয় করে নিয়েছেন।
সত্য যতই কঠিন হোক, তিনি তা বলতে কখনও দ্বিধা করেন না। কে সন্তুষ্ট হবে, কে বিরাগভাজন হবে, সেটা ভেবে তিনি কথা বলেন না।
গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের ছবক দেয় আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করেছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন, হ্যাঁ তারা যেকোনো দেশের ক্ষমতা ওল্টাতে-পাল্টাতে পারেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী?
‘কয়েক দিন আগের কথা, আমেরিকার টেনেসি অঙ্গরাজ্যে তিনজন কংগ্রেস ম্যান-এই তিনজনের অপরাধ হচ্ছে, তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করেছিল। তারা ডেমোনেস্ট্রেশন দিয়েছিল যে, এভাবে যার তার হাতে অস্ত্র থাকা আর এভাবে গুলি করে শিশু হত্যা বন্ধ করতে হবে। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই অপরাধে দুই জনকে কংগ্রেস থেকে এক্সপেলড করা হয়। জাস্টিস জন ও জাস্টিস পিয়ারসন। একজন সাদা চামড়া ছিল বলে বেঁচে যান। তাদের অপরাধ হলো তারা কালো চামড়া। সেই কারণে তাদের সিট আনসিট হয়ে যায়। তো এখানে মানবাধিকার কোথায়? এখানে গণতন্ত্র কোথায়? এটা আমার প্রশ্ন?’
এই বক্তব্যের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন, শেখ হাসিনার শক্তি-সাহসের উৎসটা আসলে কী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর সাহসের যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি এখন স্বনির্ভর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বের তিনজন সৎ সরকারপ্রধানের একজন এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু উপমহাদেশই নয়, বিশ্বের অন্যতম অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান নেতা। তিনি জানেন কখন কোথায় কতটুকু বক্তব্য দিতে হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টেই বল ঠেলে দিয়েছেন। তিনি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন, আবার অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যে অসাধু পন্থায় যেকোনো দেশের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে, সেটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সেদিনের বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের গনতন্ত্রের চিহ্নিত শত্রুদের মুখোশ উন্মোচন করে জনগণকে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা এবারই প্রথম করেছেন, এমনটা নয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে তাঁকে হারিয়েছে সে কথা তিনি বারংবার অকপটে বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমেরিকান কোম্পানি আমাদের দেশের গ্যাস তুলে বিক্রি করবে, কিন্তু আমি বললাম, গ্যাসের মালিক জনগণ। আমাদের জনগণের জন্য ৫০ বছরের রিজার্ভ নিশ্চিত করতে হবে। তারপর গ্যাস বিক্রির সিদ্ধান্ত হবে।
‘দেশের মানুষের এই স্বার্থ দেখেছিলাম বলে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হলো, ষড়যন্ত্র হলো। আওয়ামী লীগ ভোট বেশি পেয়েছিল, কিন্তু আমরা ক্ষমতায় আসতে পারলাম না। দেশের মানুষের স্বার্থ দেখার কারণে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়া হলো না।’
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী ও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেছিল। তারা বিচারের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি; বরং আইন করে বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন পর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। দেশি-বিদেশি মহারথীদের প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও খুনিদের বিচারের আওতায় এনে রায় কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র নাক গলানোর চেষ্টা করেছে।
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফাঁসি বন্ধের অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে অনুরোধ রাখেননি; দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী রায় কার্যকর করেছেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। ড. ইউনূসের অনুরোধে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঋণ বন্ধে প্রভাব খাটিয়েছিলেন। তখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘোষণায় তখন পুরো জাতি অবাক হয়েছিল। অনেকই মনে করেছিল শেখ হাসিনা এটা কথার কথা বলেছেন।
বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও বলেছিলেন, এটা অসম্ভব। আবার অনেকে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংককে চটিয়ে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হবে। অন্যান্য প্রকল্পে ঋণ স্থগিত হয়ে যাবে।
সকল আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক একটুও ক্ষতি হয়নি, বরং উন্নতি হয়েছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেমবন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। আমরা এই সেতুর গুরুত্ব স্বীকার করি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ বিপুল অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ায় আমরা আনন্দিত। খুশি লাগছে বাংলাদেশ এ সেতুর মধ্য দিয়ে লাভবান হবে। দীর্ঘদিনের সহযোগী হিসেবে আমরা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের পাশে আছি।’
নির্বাচন এলেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিটি নির্বাচনের আগে মার্কিন দূতাবাস সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের লক্ষ্য থাকে জনভিত্তিহীন কোনো দল কিংবা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা।
২০০১ সালে ষড়যন্ত্র করে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল। আবার ২০০৭ সালে তাদের আজ্ঞাবহ ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মার্কিন দূতাবাস সক্রিয় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন থাকার কারণে তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।
২০২৪ সালের নির্বাচনকে টার্গেট করে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে মার্কিন দূতাবাস। অবাধ নির্বাচনের কথা বলে তারা বিএনপিকে সামনে থেকে নাচাচ্ছে, কিন্তু পেছনে আছে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র।
বিএনপি বিদেশিদের কাছে না ঘুরে জনগণের কাছে আসতে হবে। এ জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শেখ হাসিনার শক্তির উৎস এ দেশের জনগণ। তিনি কখনও কোনোদিন বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসেননি। এ দেশের জনগণের ভালোবাসার কারণেই তিনি বারবার ক্ষমতায় এসেছেন। এখনও দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন শেখ হাসিনার সাথে আছে। জনসমর্থন ছাড়া কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং হবে, কিন্তু শেখ হাসিনার প্রতি দেশের জনগণের অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে বলেই তিনি সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই দুর্বার দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.