বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছাত্রলীগের কী লাভ হলো?

  •    
  • ২৭ মে, ২০২২ ১৩:১৭

গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন ছিল। সংবাদ সম্মেলনটি করতে পারলে সেটি পত্রিকায় ভেতরের পাতার সংবাদ হতো। কিন্তু ছাত্রলীগ সেটি হতে দেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার আগেই ছাত্রদলকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। তাতে অবশ্য ছাত্রদলের লাভই হয়েছে। ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য স্থিতিশীলতা। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থিতিশীলতায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সবাই। দেশের আর সবক্ষেত্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দারুণ স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কোনো মারামারি নেই, সেশনজট নেই। সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা খুশি, অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট। কিন্তু সারা দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও এই স্থিতিশীলতার রহস্য কী? আসলে তেমন রহস্য নেই। রাজনীতির মাঠ থেকে একটি পক্ষকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ছলেবলেকৌশলে, মানে মামলা-হামলায় একটি পক্ষকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ব্যস, চারদিক শান্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। স্বাধীনতার আগে-পরে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তাই ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ মানেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। আওয়ামী লীগের গত এক যুগের শাসনামলে কোটা সংস্কার আন্দোলন বাদ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ক্ষমতাসীনদের একক নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ মানে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একক নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ৯০-এর গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এরশাদ আমল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই কোনো ক্ষমতাসীনদের দখলে ছিল না। বরং ক্ষমতাসীনরা ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পারত না। স্বৈরাচার এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল জাতীয় ছাত্রসমাজ। কিন্তু এরশাদের ৯ বছরের প্রবল প্রতাপশালী শাসনামলেও ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেনি। বরং ছাত্রসংগঠনগুলোর ইস্পাতকঠিন ঐক্যেই রোপিত হয়েছিল এরশাদের পতনের বীজ। এরশাদ আমলে ছাত্রসমাজ আর ছাত্রশিবির ছাড়া আর সব ছাত্র সংগঠনেরই অবাধ বিচরণ ছিল ক্যাম্পাসে।

তখন আমরা জানতাম, ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়া ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাড়া ছাত্রলীগের। তখন কৌতুক ছিল, ছাত্রদলের মূল সংগঠন বিএনপি যেহেতু উত্তরপাড়ায় গঠিত, তাই ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়াই তাদের পছন্দ। আর ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়া মানে মহসিন হল, সূর্যসেন হল, জসিমউদ্দিন হল, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়া হল। এই হলগুলোতে ছাত্রদলের আধিপত্য ছিল। আর দক্ষিণপাড়া মানে জহুরুল হক হল, এসএম হল, জগন্নাথ হল, শহীদুল্লাহ হল ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এভাবেই স্বৈরাচারী আমলে ক্যাম্পাসে অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল। মাঝেমধ্যে খুটখাট লাগত বটে, তবে উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া মিলে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতিই বহাল ছিল।

স্বৈরাচারের পতনের পর অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়। ৯০-এর আগে যেখানে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদের ঢোকাই মুশকিল ছিল, ৯০-এর পর থেকে সেখানে ক্ষমতাসীনদের একক নিয়ন্ত্রণ। যখন যে দল ক্ষমতায়, তাদের ছাত্র সংগঠনের দখলেই গোটা ক্যাম্পাস, উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া, পুবপাড়া-পশ্চিমপাড়া সব। আজ যে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে উপর্যুপরি মার খাচ্ছে, সেই ছাত্রদলের হাতেই এই একক আধিপত্যের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির’ যাত্রা শুরু হয়।

’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলকে সরিয়ে ছাত্রলীগ একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এভাবেই চলে আসছে। ব্যাপারটি এতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে বাংলাদেশে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আগের ক্ষমতায় থাকা দলের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়। নতুন ক্ষমতায় আসা দলের ছাত্র সংগঠনকে দখল কায়েম করতে কোনো লড়াইও করতে হয় না। নিজ থেকেই দখল ছেড়ে চলে যান।

আমাদের ছাত্রজীবনে দেখতাম নতুন ছাত্রদের দলে টানার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। নিজেদের আদর্শ বোঝানো, নবীনবরণের আয়োজন। এখন সেসবের বালাই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানেই অটো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের মুখ বনে যাওয়া। হলে সিট পেতে হলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাতেই হবে। এখন যেমন ছাত্রলীগ, একসময় সেটা ছিল ছাত্রদল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একযুগ ধরে স্থিতিশীল। কোনো মারামারি নেই, কোনো সেশনজট নেই। সব শান্ত। আপনাদের যেমনই লাগুক, এই শান্তি আমার ভালো লাগে না। কবরের নিস্তব্ধতাকে স্থিতিশীলতা বলে না। গণতন্ত্র মানে বহু দল, বহু মত, বহু পথ। কোনো সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণ মানে আর যা-ই হোক স্থিতিশীলতা নয়, গণতন্ত্র তো নয়ই। এই একযুগে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কতটা কাছে যেতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাব হলো, কোনো কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ছাত্রলীগের ক্যাম্পাস ছাড়া হতে এক মিনিট সময় লাগবে।

একযুগ ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্রদল নানাভাবে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করছে। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন ছিল। সংবাদ সম্মেলনটি করতে পারলে সেটি পত্রিকায় ভেতরের পাতার সংবাদ হতো। কিন্তু ছাত্রলীগ সেটি হতে দেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার আগেই ছাত্রদলকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। তাতে অবশ্য ছাত্রদলের লাভই হয়েছে। ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।

একদিনের বিরতিতে আরেকদফা চেষ্টা করেও মার খেয়ে বিতাড়িত হতে হয়েছে ছাত্রদলকে। সবার চোখের সামনে চর দখলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে রেখেছে ছাত্রলীগ। মূল প্রতিপক্ষ ছাত্রদলকে ঢুকতেই দিচ্ছে না। কিন্তু তাতে কারোই কিছু যাচ্ছে আসছে না। যেন সাধারণ মারামারির ঘটনা। অনেকে আগ বাড়িয়ে বলছেন, ছাত্রদল গেল বলেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হলো। ছাত্রদল না গেলেই পারত। যেন ছাত্রদলের যাওয়াটাই অপরাধ। তাদের ওপর হামলা চালানোটা অপরাধ নয়।

আসলেই দেশে এখন গণতান্ত্রিক ধারণাটাই উঠে গেছে। সংবিধানে দেয়া সংগঠন ও সমাবেশ করার অধিকার নেই কারো। হামলাকারীদের ছবি ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের তাতে কিছুই যায় আসে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে; এর নাম আর যা-ই হোক গণতন্ত্র নয়।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর