বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দেশে পর্যাপ্ত কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান, আধুনিক রাইস মিল, হিমাগার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কৃষি খাতের সম্ভাবনা পূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
কৃষি উৎপাদনের চিত্র: বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ, যেখানে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে ধান ও চাল প্রধানতম খাদ্যশস্য। বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩৫০–৩৮০ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চাল উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়, যা দেশের জনগণের প্রধান খাদ্যচাহিদা মেটাতে সহায়তা করে। সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৬.৫ থেকে ১৯ মিলিয়ন টন সবজি উৎপাদিত হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ সবজি উৎপাদক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন মৌসুমি সবজি দেশের বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে। ফল উৎপাদনের দিক থেকেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। প্রতি বছর প্রায় ১৪.৮ মিলিয়ন টন ফল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে কলা, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ও অনারস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌসুমি ফলের পাশাপাশি সারাবছর বিভিন্ন ফলের সরবরাহ কৃষকদের আয়ের উৎস এবং জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সহায়ক। মৎস্য খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫০.১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫.২৯ লাখ মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশকে বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষস্থান অধিকারী করেছে। মাছ বাংলাদেশের জনগণের প্রোটিন চাহিদার প্রধান উৎস, একইসঙ্গে রপ্তানি আয়েরও গুরুত্বপূর্ণ খাত। সব মিলিয়ে, ধান, সবজি, ফল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেশের অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তাকে শক্তিশালী করেছে। এই উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও কোল্ড চেইন অবকাঠামো উন্নয়ন আরও জরুরি। এতে কৃষক লাভবান হবে এবং টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভাব ও কৃষকের বঞ্চনা: বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ। এদেশের উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়া বছরে বিপুল পরিমাণ ধান, ফল, সবজি, মাছ ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে সহায়তা করে। কিন্তু এই বিপুল উৎপাদনের সঠিক ব্যবহার ও কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কৃষকরা উৎপাদন করেও আর্থিকভাবে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। প্রথমত, দেশে আধুনিক রাইসমিল ও শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের অভাব প্রকট। অধিকাংশ কৃষক ধান বা গম কাঁচা অবস্থায় বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে তারা ধানের পূর্ণ মূল্য পান না। একইভাবে হিমাগার ও কোল্ড চেইন অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে উৎপাদিত ফল ও সবজি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে মৌসুমে প্রচুর উৎপাদন হলেও তা দ্রুত বাজারজাত করতে গিয়ে কৃষকরা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়ত, ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব কৃষকদের সম্ভাবনা সীমিত করে রেখেছে। অনেক দেশে টমেটো, আম, লিচু, আনারস ইত্যাদি ফল থেকে রস, জুস, আচার বা ক্যানজাত পণ্য তৈরি হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষকরা শুধু মৌসুমেই নয়, সারা বছর ধরে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি করতে পারতেন। একইভাবে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ভিত্তিক শিল্পের অভাবে মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি পণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করার সুযোগ অনেকাংশে হাতছাড়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ না থাকায় অতিরিক্ত উৎপাদনের সময় বাজারে দাম পড়ে যায়। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অতএব, কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে দেশে দ্রুত আধুনিক রাইসমিল, হিমাগার, কোল্ড চেইন, ফল-সবজি ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। শিল্প ও কৃষির এই সমন্বয়ই কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: কৃষকের আয় কমে যায়, ফলে তারা কৃষিকাজে আগ্রহ হারায়। বেকারত্ব বাড়ে, কারণ কৃষিভিত্তিক শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। রপ্তানি সম্ভাবনা নষ্ট হয়, কারণ আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি হয় না। কৃষিখাতে আয় হ্রাসের ফলে শ্রমশক্তির উৎসাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের হার কমিয়ে দেয়। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সংকট তীব্রতর হয়, কারণ কৃষিভিত্তিক শিল্পসমূহ পর্যাপ্ত স্কেল-আপ সক্ষমতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি, মূল্য সংযোজন ও গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে অন্তর্ভুক্তির অভাবে রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়।
করণীয় ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের কৃষি খাতকে শিল্পায়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ কৃষিভিত্তিক শিল্পে উৎসাহিত করা। প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন। কৃষক প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ উন্নয়ন। রপ্তানিভিত্তিক কৃষি শিল্প গড়ে তোলা। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বিশ্বমানের হলেও, এর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কৃষি ভিত্তিক শিল্পায়ন অপরিহার্য। স্বাধীনতা পরবর্তী এপর্যন্ত তেমন কোনো রকম কৃষিভিত্তিক কলকারখানা, সবজি ও ফল সংরক্ষণে হিমাগার, কৃষি শিল্পভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন, এসব নিয়ে তেমন কিছু দৃশ্যমান কৃষক বান্ধব কার্যক্রম হাতে নেয় নাই বিগত দিনের সরকার গুলি। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ , হিমাগার স্থাপন ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা না থাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠে নাই বলে মত প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। আন্ত:জেলার সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষিবান্ধব করা না গেলে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হবে না বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষি খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা না গেলে, টেকসই কৃষি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না এবং সেই সঙ্গে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাবে আমাদের কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয় না, ফসলের যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের সুযোগ সীমিত থাকে, ফলে তারা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য তারা পায় না এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নতির সুযোগ হারায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হলে শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টেকসই হবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।