ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগডাসে। গত ১৬ বছরে কথাটির বাস্তব প্রমাণ যেন দিয়ে গিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের মানুষের শ্রম আর ঘামের পয়সা তুঘলকি উপায়ে লুটে নিয়ে অবিশ্বাস্য অংকে বিদেশে পাচার করার নতুন নজির গড়েছিল তারা। এই লুটপাটের অন্যতম একটি খাত ছিল বিদ্যুৎখাত আর কুইক রেন্টাল কেরামতি। যেখানে মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকার বিদ্যুৎ রাতারাতি সরকার কেনা শুরু করে সর্বোচ্চ ২৬ টাকায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির অন্তরালে গড়ে ওঠা, দুর্নীতি এবং অপচয় বিদ্যুৎখাতকে ক্রমেই করে তুলেছে জনসাধারণের অর্থ লোপাটের কারখানা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কুইক রেন্টাল নামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক অস্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজো দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের একটি বড় শুভাঙ্করের ফাঁকি হিসেবে থেকে গেছে।
২০০৯ থেকে শুরু করে গত দশকজুড়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুততা আনতে ‘কুইক রেন্টাল’ ব্যবস্থা চালু হয়। তবে, এই ব্যবস্থার আওতায় তৈরি হওয়া কেন্দ্রগুলো প্রায়শই তাদের সক্ষমতার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাদবাকি সময় এসব পাওয়ার প্ল্যান্ট বসে থাকলেও সরকার চুক্তি অনুযায়ী তাদের পূর্ণ ক্ষমতার জন্য ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বা স্থায়ী পেমেন্ট দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে একদিকে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকলেও, তা পূর্ণ ব্যবহার হয় না, এবং সরকারকে বছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে এই কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে মাত্র ৬ টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ কেনা হয় সর্বোচ্চ ২৬ টাকা মূল্যে। যার দায় মেটাতে হয় দেশের সাধারণ মানুষের।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০,৭৮৭ মেগাওয়াট, যেখানে চাহিদা প্রায় ১৮,০০০ মেগাওয়াটের আশেপাশে। এর ফলে প্রায় ১২,৭৮৭ মেগাওয়াট অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলেও, এ অতিরিক্ত ক্ষমতার জন্যও সরকারের পকেটে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। উপরন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়টি ঘটে চলে ক্রমাগত। আর তাই প্রশ্ন ওঠে এত খরচ আর এত অর্থ পাচারের মচ্ছবে আমরা কি পুষছি সাদা হাতি? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, আওয়ামী লীগের আমলে এ খাতে হওয়া দুর্নীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা তো দূরের বিষয় বর্তমান সরকারের সময়ে কুইক রেন্টালের অর্থ কোথায় যাচ্ছে গণমাধ্যমে সে তথ্যও আসছে না।
দেশে কুইক রেন্টাল ব্যবস্থার এই উত্থান এবং অর্থ হরিলুটের পেছনে ছিলো ২০১০ সালে প্রণীত ‘দায়মুক্তি আইন’ (Quick Enhancement of Electricity and Energy Supply Act, 2010), যার মাধ্যমে দরপত্র ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে সংযোগে থাকা ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রুত কুইক রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনের আওতায় ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে সুবিধাভোগী হিসেবে গড়ে ওঠে। যদিও আইনটি বর্তমানে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলো এখনো বহাল রয়েছে এবং দ্রুত বাস্তবায়নে আইনি জটিলতা ও ক্ষতিপূরণ ইস্যু রয়ে গেছে।
সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হিসেবে কুইক রেন্টাল চুক্তি পুনর্বিবেচনা ও বাতিলের কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক কেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্যের অতিরিক্ত অর্থ বাকি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ সরকার প্রায় ২৬,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। সরকারের সামগ্রিক ভর্তুকি ও অতিরিক্ত খরচ মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে অপচয়ের পরিমাণ বছরে ৬০,০০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরেই ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার (৬০ হাজার কোটি টাকা) দুর্নীতি ও অর্থপাচার হয়েছে, অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বকেয়া বিল আদায়ে কিছু অগ্রগতি হলেও, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে অনিয়ম ও অপচয় রোধে এখনো কাঙ্খিত পদক্ষেপগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সাশ্রয়ী এবং টেকসই বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশ এই সংকট থেকে উত্তরণ পেতে পারত, তবে কুইক রেন্টালের বাইরে বিকল্প পথে যেতে সরকারের পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায়শই দেখা যায়, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাতিল বা পেছনে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি রিপোর্ট ও সংবাদ বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, কুইক রেন্টাল সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে হলে চুক্তির পুনর্বিবেচনা ও আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। তবেই বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট, এনার্জি এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে দ্রুত কাজ করতে হবে।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘লোডশেডিং আছে এবং থাকবে, কারণ সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য ফেরানো সহজ নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান বন্ধ করাই এখন সময়ের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার দামের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।’
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুধু আইন পরিবর্তন বা চুক্তি বাতিল যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই প্রকৃত সমাধান। বিদ্যুৎ খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য তা জরুরি।
গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, বিদ্যুৎ খাতের এসব দুর্নীতি আর অর্থ লুট বন্ধ করার। দেশের মানুষের শ্রম, ঘাম, আর কষ্টের টাকায় প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকার পর, আগের সরকার এর ফলাফল ঠিকই কড়ায় গণ্ডায় দেখেছে। তাই এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেয়াই ভালো। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজন দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপের, যেখানে দুর্নীতি রোধ, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত করা যাবে।
কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তি