একদিকে সব হারানোর বেদনা, অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি- এমন এক অমানিশার সময়ে তিনি ফিরেছিলেন বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। মৃত্যু তার পিছু সারাক্ষণ, তারপর অবিরাম পথচলা বাংলার পথে-প্রান্তরে। বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত এখনও বাঙালির ভাগ্যবিধাতা তিনি। আজ বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছেন, যেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি শেখ হাসিনা। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আজ তার ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তারা প্রাণে বেঁচে যান।
সময়টা ১৯৮১ সালের ১৭ মে। সেদিন রাজপথে নেমেছিল জনতার ঢল। সবার চোখের দৃষ্টি কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। পথের দুই ধারে লাখো মানুষের মিছিল। রাস্তায় ট্রাক, গাড়ির সারিবদ্ধ শোভাযাত্রা। উপলক্ষ, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন পর ঢাকায় আসছেন। দিনমজুর এক রিকশাচালকের উক্তি ছিল এমন- দেইখ্যা আসেন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট, শেখের বেটির লাগি কাতারে কাতারে মানুষ জমছে সকাল থাইক্যা। শেখ মুজিবুর যেই দিন ফিরছিল যুদ্ধের পর, এমুন মানুষ সেই দিনও হয় নাই। (সূত্র: সচিত্র সন্ধানী)
সচিত্র সন্ধানীর ভাষায়: বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষমাণ জনতার কোঁচড়ে মুড়ি-চিড়ার স্পষ্ট আভাস দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকে যাত্রা করে এঁরা এসেছেন। অসুস্থ, রুগণ, কিশোর-যুবক বাদ যাননি। সবার চোখ রানওয়ের দিকে। আসমানের অবস্থা দুইদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছে। কী জানি কেমন যাবে আজকের দিন। কালো মেঘ জমছে। বিমানবন্দর ছেয়ে গেছে গাড়ি আর মানুষে। ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকার গেট, গেটের ওপর ছাদ, লোকে লোকারণ্য। মানুষের চিৎকার, কথা, ঠেলাধাক্কা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে শেখ হাসিনার আগমনবার্তা।
কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর, জনস্রোতে মিশে প্রায় তিন ঘণ্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরে পৌঁছালেন। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি জনতার ভালোবাসার কাতারে। শেরেবাংলা নগরে অপেক্ষায় লাখ লাখ মানুষ।
বিমানবন্দর থেকে সোজা মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণসংবর্ধনা মঞ্চে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন- “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদেরকে ফিরে পেতে চাই।”
গণসংবর্ধনায় ভাষণদানকালে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।” আনন্দঘন ও হৃদয়বিদারক সমাবেশে কর্মীরা মুহুর্মুহু নানা স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিল: ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ হাসিনা, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘ঝড়বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’।
শেখ হাসিনা সেদিন বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কর্মীদের চোখেও ছিল অশ্রুধারা। তখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জন্য সময়টা অনুকূলে ছিল না। পঁচাত্তরে খুনিরা তখনও তৎপর সব জায়গায়। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার পথ ধরে জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলেন বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সেদিন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী, বিশৃঙ্খল ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। শেখ হাসিনা সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসম্প্রদায়িক চেতনায় অভিসিক্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শেখ হাসিনা স্বামী ওয়াজেদ মিয়া, বোন শেখ রেহানা, শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শিশুকন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনসহ দিল্লি পৌঁছান। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা একরকম অন্ধকারে ছিলেন। দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ পান। সেখানেই শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা জানতে পারেন। এরপর ভারতেই নির্বাসিত সময় কাটে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজখবর নিতে। এরপর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন কয়েক দফায় দিল্লিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা খবর পান, ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান। আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান।
শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করে তারা। ১৬ মে শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকালে তারা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী।
বাস্তবতা ছিল এমন- শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে যে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন একাশিতে এসে সেই বাংলাদেশ আর ফিরে পাননি। তিনি যে দেশে ফিরে আসেন, সে দেশ তখন পূর্ব পাকিস্তানের ধারায়। যেন সব হারানোর দেশ।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪১ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটি ছুঁয়ে যে কথা তিনি দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। একইভাবে সেদিন ঢাকা শহরে লাখ লাখ কর্মী যে শপথ নিয়েছিল- দেশের সব পরিস্থিতিতেই তাদের মায়ের মতো, বোনের মতো নেত্রীকে আগলে রাখবেন, সেটিই তারা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে বার বার সংকটাপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধীদের অপরাধের বিচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-এসবের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার চারবার দেশ পরিচালনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেল। স্যাটেলাইট-১-এর উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আকাশ বিজয় করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আকাশ-সমুদ্র-সীমান্ত বিজয় পূর্ণ হয়েছে। সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। রিজার্ভ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধাপে ধাপে পূরণ হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প ২০২১-এর সব কর্মসূচি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা, খাদ্য-বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে জাজ্বল্যমান পরিবর্তন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ যোগাযোগব্যবস্থায় দৃশ্যমান হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারার জন্য অর্জন করছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্ব যখন পর্যুদস্ত, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উত্তীর্ণ।
লেখক: সাংবাদিক