বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাওরে কৃষকের সর্বনাশের জবাব কী?

  • রাজন ভট্টাচার্য   
  • ৫ মে, ২০২২ ১৬:২৮

নিজের সামান্য সুবিধার জন্য মানুষের কত বড় সর্বনাশ তিনি করেছেন, তা হয়ত একবারও ভাবেননি। ব্যক্তিস্বার্থের কথা সব সময় ভাবলে মানুষের স্বার্থকে কখনই বড় করে দেখা যায় না। তিনিও একই কারণে হয়ত দেখেননি। মানুষের প্রয়োজনে রাজনীতি। সেই চিন্তা ও চেতনার বাইরে গিয়ে রীতিমতো পরিস্থিতির আগুনে ঘি ঢেলেছেন। পুড়ে অঙ্গার করে দিয়েছেন কৃষকের হৃদয়। একবারও অসহায় মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি। এখানে তার নেতৃত্ব ও মানসিকতার চিত্র ফুটে উঠেছে।

আশার ফসল আশানুরূপভাবে ঘরে ওঠেনি। তাই হাওরপাড়ের মানুষ ভালো নেই। হাসি নেই অনেকের মুখে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। হাওর-অধ্যুষিত সাত জেলার মধ্যে কমবেশি সবকটিই ক্ষতিগ্রস্ত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে সুনামগঞ্জের কৃষক। সেখানে এখনও কৃষি-অর্থনীতিনির্ভর জীবন ব্যবস্থা। বছরে ফসল একটিই। বর্ষার ধকল কাটিয়ে সবাই বোরো আবাদের প্রস্তুতি নেয়। প্রায় পাঁচমাস রাতদিন মাঠে ঘাটে থেকে সোনালি ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর থাকে সবাই।

এবার ফসল কাটার ঠিক আগমুহূর্তে পাহাড়ি ঢলে চোখের সামনে ডুবে গেছে ফসল। এ ঘটনায় হাওরপাড়ে কৃষকের চোখে হতাশার জল। ২০১৭ সালে সর্বশেষ হাওরডুবির ঘটনার পর এবার আবারও ঘটল। ভাটি এলাকা থেকে একের পর এক বাঁধ ডুবে যাওয়ার খবরের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলছিল কিছুটা আশার আলো। অর্থাৎ এখনও অনেক হাওর অক্ষত আছে। সেখানে কৃষকরা ধান কাটতে শুরু করেছে। ৮০ ভাগ ধান পাকলেই তা কেটে ফেলার পরামর্শও দিয়েছে কৃষি বিভাগ।

এই অবস্থার মধ্যে একটি খবর আরও বেশি মন খারাপ করেছে। তা হলো- একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা রাতের অন্ধকারে নিজের মাছের খামারে পানি ও মাছের জন্য বাঁধ কেটে দিয়েছেন!

নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে ২৫ এপ্রিল মেন্দিপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুরের নন্দের পেটনার বাঁধটি কেটে দেন এক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। এতে বিভিন্ন হাওরে পানি প্রবেশ অব্যাহত থাকায় মদন, ইটনা ও খালিয়াজুরীর পাঁচ হাজার কৃষকের সাতটি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়!

নিজের সামান্য সুবিধার জন্য মানুষের কত বড় সর্বনাশ তিনি করেছেন, তা হয়ত একবারও ভাবেননি। ব্যক্তিস্বার্থের কথা সব সময় ভাবলে মানুষের স্বার্থকে কখনই বড় করে দেখা যায় না। তিনিও একই কারণে হয়ত দেখেননি। মানুষের প্রয়োজনে রাজনীতি। সেই চিন্তা ও চেতনার বাইরে গিয়ে রীতিমতো পরিস্থিতির আগুনে ঘি ঢেলেছেন। পুড়ে অঙ্গার করে দিয়েছেন কৃষকের হৃদয়। একবারও অসহায় মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি। এখানে তার নেতৃত্ব ও মানসিকতার চিত্র ফুটে উঠেছে।

বাঁধ কেটে ফেলার ঘটনায় ২৬ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী বাদী হয়ে খালিয়াজুরী থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। যিনি নিজের সামান্য স্বার্থের জন্য ঠান্ডা মাথায় মানুষের এতবড় ক্ষতি করতে পারেন তার কঠোর বিচারের দাবি করা সংগত। সেইসঙ্গে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের পদে বাহল থাকবেন তা হতে পারে না। আশা করি ক্ষমতাসীন দল থেকে তাকে বহিষ্কার করে নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দেবে। যে নেতা হাসতে হাসতে মানুষের অমঙ্গল করেন তিনি আর যা-ই হোক তিনি জনপ্রতিনিধি বা নেতা হতে পারেন না।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনও বলছেন, বাঁধটি গত বছরের পুরোনো। এটি ভাঙার কোনো কারণ ছিল না। এটি পুরোনো ধনু নদীর পাশে অবস্থিত। এমনিতেই গত একমাস ধরে নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে ছিল। এই সুযোগে ফিশারির জন্য লিজ নেয়া ইজারাদাররা ২০ ফুট বাঁধটি কেটে দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করবে স্থানীয় মানুষ, এটাই স্বাভাবিক। তবে কেন জলমহাল ইজারা দেয়া হবে? জাল যার জলা তার, এই আইনের আমাদের ফিরে যাওয়া দরকার।

বাঁধ কাটার খবর পেয়ে কৃষক ও সাধারণ মানুষ ঘটনাস্থালে গিয়ে ওই সাবেক চেয়ারম্যানকে ধাওয়া করে এবং তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেল বাঁধে ফেলে দেয়। তিনি পরিস্থিতি খারাপ দেখে স্থান ত্যাগ করেন। সাধারণ মানুষ যখন জনপ্রতিনিধি বা নেতার মাধ্যমে ক্ষতির ক্ষতির শিকার হয়, তখন গণেশ উল্টে যায়- এটাই স্বাভাবিক।

এই খবরটি যখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এর আগের দিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল থেকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আহাজারির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়। যারা আহাজারি করছিলেন তাদের সবারই ফসল পানির নিচে। এক চিমটি ধানও ঘরে ওঠেনি।

ধান চাষ করতে গিয়ে দেনায় জর্জরিত। আছে এনজিওদের ঋণের কিস্তির চাপ। কীভাবে দেনা মিটবে? কীভাবে চলবে সংসারের চাকা? এ চিন্তায় একমাত্র সম্বল ধান হারিয়ে কৃষকদের আহাজারি করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে!

একই দিন জামালগঞ্জের আহমানপুর এলাকায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হালির হাওর। সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হাইজদা স্থায়ী বাঁধ ভেঙে ডিঙ্গাপোতা হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। যদিও বিশাল এই হাওরের কিছু ধান ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে। এভাবে একের পর এক কৃষকের সর্বনাশের খবর শুনলে কার মন ভালো থাকে? পুরো হাওরে ফসলের ক্ষতি মানেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা। যা গোটা দেশে ধান-চালের চাহিদাপূরণে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

ইতোমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা সুনামগঞ্জের ৩২টি হাওর পানিতে তলিয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় পাঁচ হাজার ৭৫০ হেক্টর ধান নষ্ট হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের বক্তব্য হলো- বাস্তবে ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান জলে গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরের ৪১ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৩৮, নেত্রকোনায় ৭৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৯, সিলেটে ৩৭, মৌলভীবাজারে ৩৬, হবিগঞ্জে ২৫ ও সুনামগঞ্জে ৪২ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এ বছর দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ধান আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৭ শ হেক্টর জমির ধান অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়েছে, যা মোট আবাদের শতকরা একভাগ। হাওর জেলার ৩শ ৭৩টি হাওরের মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বাধিক।

যারা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতি করেছেন তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। অপরাধীদের রাজনৈতিক দল ও জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার না থাকাটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। তেমনি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাঁড়াতে হবে, আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত স্থগিত করতে হবে এনজিওর ঋণের কিস্তি। এমনিতেই তো বানের জলে ভেসে গেছে হাওরপাড়ের মানুষের উৎসবের আনন্দ। সরকার যদি সবার পাশে দাঁড়ায়, তবে শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর