রমজানের আগে থেকেই তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে তোড়জোড় কিছু কম হয়নি। যদিও এসব উদ্যোগেরই তেমন কোনো সুফল চোখে পড়েনি। জিনিসপত্রের চড়া দাম গুনেই মানুষ কষ্টেসৃষ্টে ঈদ-উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছে,এবং উদযাপন করেছে। কিন্তু ভোজ্য তেল কিনতে গিয়ে অনেককেই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বেশি দাম দিয়েও অনেকে তেল কিনতে পারেনি। ঈদের আগে দেশের অনেক জায়গায় তেল পাওয়া যায়নি। ঈদের মতো বৃহৎ উৎসবের সামনে রান্নার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ তেল-সংকট মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলায় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। তেলের দাম মানুষের কাছে রীতিমতো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অথচ এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তাদের কার্যক্রম ভোক্তা অধিকার কতটুকু সংরক্ষণ করতে পারছে, তা একটা বড় প্রশ্ন। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তো থাকছেই।
আমাদের দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই তারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটে। সম্প্রতি দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ নিয়ে সরকার অনেক দেনদরবার করে, হুমকি-ধমকি দিয়ে, আমদানি শুল্ক কমিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তেলের দাম কমেনি।
তেলের দাম নিয়ে অনেক বেশি হইচই হলেও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও কিন্তু ক্রমাগত বাড়ছে। চাল-ডাল, মাছ-মাংস, সবজি-মসলার বাজারও স্থির নয়। এর মধ্যে চালের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছু মিলার ও ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবার চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা শুরু করছে। বাজারে চাহিদা কম এমন অজুহাত দিয়ে মিলাররা মোটা চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
মিনিকেট চালের দামও একইভাবে বেড়েছে। বাজার অস্থিতিশীল করার কাজটি করা হচ্ছে খুবই কৌশলে এবং ধীরে ধীরে, যাতে কারও চোখে বড় করে ধরা না পড়ে। বাজারে চালের দাম বেড়ে গেলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। সে কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় ভোক্তারা প্রতিনিয়ত কেবল ঠকছেই না; একই সঙ্গে তাদের সিন্ডিকেটবাজির কারণে দাম ক্রমাগত বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের চাপে দেশেও একাধিকবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপরেও বাজারে এখন সয়াবিন তেল নেই। বাজারে তেলের মজুদ ঠেকাতে খোলা তেল বিক্রির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
এদিকে সয়াবিন তেলের ৬০ শতাংশই খোলা অবস্থা বিক্রি হয়, যার মূল ভোক্তা মূলত নিম্ন ও মাঝারি আয়ের মানুষ। বাড়তি দামের কারণে বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতেও সামর্থ্যহীন তারা। নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকেই টিসিবির ট্রাকের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে, কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না, হাতাহাতিতে জড়াচ্ছে, মানুষ ট্রাকের পেছনে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে, চলন্ত ট্রাকের ওপর হামলে পড়ছে। দেশে যেন ‘দুর্ভিক্ষ’ লেগে গেছে!
একেক সময় একেক পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। কখনও লবণ, কখনো চিনি, কখনো পেঁয়াজ। যেন পালা করে একেক পণ্যের ব্যবসায়ীরা ‘সমঝোতা’ করে নেয় বা তাদের সুযোগ করে দেয়া হয়। একেকবার একেক পণ্যের নামে লুট হয়ে যায়, জনগণের পকেট খালি হয়ে যায়। বর্তমানে কারসাজি চলছে ভোজ্য তেল নিয়ে।
তেল আমাদানিকারক গ্রুপগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, ঠিকঠাক পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যেই পণ্য দেয়া হচ্ছে। সরবরাহে কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। বরং তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে বলে পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন তারা।
অপরদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘সরবরাহ ঘাটতি না থাকলে আমরা কেন মাল পাই না?’ তাদের আরও অভিযোগ, সরকার-নির্ধারিত মূল্যেও পণ্য দেয়া হচ্ছে না। এমনকি মিলে ঢুকতে ট্রাকপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করেও নেয়া হচ্ছে। তেলের বিক্রয় আদেশ (এসও) কিনে ট্রাক নিয়ে এক কোম্পানির মিল থেকে আরেক কোম্পানির মিলে ঘুরলেও সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না তারা।
পারস্পরিক অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের ফাঁক দিয়ে তেলের দাম বেড়েই চলেছে। আর এতে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। সয়াবিন তেলের বাজারের আধিপত্য হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। ফলে এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিনতর কোনো ব্যাপার নয়। এরপরও সরকার সেটি করতে পারছে না।
ফেব্রুয়ারি-মার্চে যখন ভোজ্য তেলের দাম অনেক বেড়ে যায়, তখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের থেকে বলা হয়, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেয়া হয়েছে। তাদের হিসাব মতে, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২০ লাখ মেট্রিক টন। সে অনুযায়ী এক মাসের চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো। প্রতি লিটারে যদি ১০ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়, তাহলে টাকা লোপাটের অঙ্কটা অনেক বড় হয়ে দেখা যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় সেই অঙ্ক বাড়ছেই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দামে অস্থিরতা শুরু হয়। আর্জেন্টিনা রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা এবং ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর দাম বাড়ার নতুন একাধিক রেকর্ড হয়। দেশেও দাম না পেয়ে আমদানি কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। আবার ঈদের পরে দাম বাড়বে, এমন চিন্তা থেকে মজুতের প্রবণতাও শুরু হয়। তাতে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে বাজারে অভিযান চালাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অনিয়মকারী খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু সংকট তাতে ঘুচছে না। এদিকে মিলমালিক, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ী, ক্যাব, সরকার একে অন্যকে দোষারোপ করছে।
এর আগে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকানে অভিযান পরিচালনা করে। তখন গুদামজাত তেল বাথরুম ও মাটির নিচ থেকেও উদ্ধার করা হয়। সরকার পরিস্থিতি সামলাতে লাগাতার অভিযান পরিচালনার পর সয়াবিন তেলের ওপর ১৫% ভ্যাটও প্রত্যাহার করে। পাশাপাশি তেল বিক্রিতে পাকা রসিদের নিয়ম চালু করে। তাতে কিছুদিন বাজার স্থিতিশীল থাকলেও আবার সমস্যা শুরু হয়।
আমাদের দেশে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং তেল সংকটের নেপথ্যে যারা আছে বলে অভিযোগ, সেই আমদানিকারক ও ডিলাররা কিন্তু থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ভোজ্যতেলের এ ধরনের দাম বাড়াতে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। আর সেই সিন্ডিকেটের কাছে সরকার জিম্মি, জনগণও জিম্মি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সে দামেও জনগণ কিনতে পারে না।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃঢ়, সুচিন্তিত, ধারাবাহিক কোনো পদক্ষেপও নেই। বাজারে ডিমান্ড কত, সাপ্লাই কত আর স্টক কত, সরকারের কাছে এসবের সুনির্দিষ্ট কোনো ডাটা নেই। বাজার বিন্যাস নেই। কোন আমাদানিকারক কোন মাসে কী পরিমাণ তেল আমদানি করছে, ঘাটতি থাকছে কি না, যে পরিমাণ তেল আমদানি করা হচ্ছে, তা যথাযথভাবে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, কে মজুদ করছে, কে বেশি দামে বিক্রি করছে, এসব বিষয়ে কোনো মনিটরিং নেই। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় নানা রকম কারসাজি করছে। আর সরকার সিনেমার দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এদিকে তেলের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের তেল ঝরে যাচ্ছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেই না, উল্টো তাদের অপরিণামদর্শী মন্তব্য অনেক ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে। এর আগে সরকারের এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘রমজানে তেলের দাম কমবে না, আরও বাড়বে।’ সামনে ভালো দাম পাওয়া যাবে- এ আশায় ব্যবসায়ীরা তখন তেল মজুদ শুরু করে।
সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরকার নিজেই যদি বলে যে, দাম কমবে না, তাহলে সুযোগসন্ধানি ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করবেই। সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কথা বলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। জনগণের স্বার্থে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। তা না হলে তেলের আমদানি আরও কমে যাবে। বাজারে আরও বেশি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হবে। দাম আরও বেড়ে যাবে। মূল্যবৃদ্ধির তেলে জনগণ আরও ভাজাভাজা হবে।
লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা।