হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের আকাশপথের প্রাণকেন্দ্র। এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী চলাচলের মাধ্যম নয়, বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানির অর্থনীতিরও মূল প্রবেশদ্বার। গত শনিবার বিকেলে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় হঠাৎ লাগা ভয়াবহ আগুন সেই কেন্দ্রটিকেই এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়। ধোঁয়ার কালো স্তম্ভ আকাশে উঠে দৃশ্যমান হয় শহরের বহু স্থান থেকে। একে একে স্থগিত হয় সব ফ্লাইট, বন্ধ হয়ে যায় টার্মিনাল কার্যক্রম, দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় দমকল, নিরাপত্তা ও বিমান কর্তৃপক্ষের। এই দৃশ্য কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, নিরাপত্তা-পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার এক নির্মম পরীক্ষা।
বিমানের কার্গো টার্মিনালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শাখাও ঘটনাস্থলে যুক্ত হয়। একটি জাতীয় কৌশলগত স্থাপনায় একাধিক বাহিনীর দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। উন্নত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ‘ইন্টার-এজেন্সি কো-অর্ডিনেশন’ বা সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রতিক্রিয়া যেভাবে অনুশীলিত হয়, সেদিকে বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়া একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত রাখে। তবে ঘটনাটির প্রকৃত কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কার্গো ভিলেজের কোনো ইলেকট্রিক্যাল প্যানেল বা স্টোরেজ ইউনিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যে এলাকায় আগুন লাগে, সেখানে বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য, প্যাকেজিং সামগ্রী ও কাঠের বাক্স রাখা ছিল। এসব দাহ্য বস্তু দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে দীর্ঘ। এখানেই প্রথম বড় প্রশ্ন- কার্গো টার্মিনালের মতো উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত ছিল? আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর ‘ফায়ার রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ প্রতিবছর হালনাগাদ করা হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে এই মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ জোনে থাকে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার, সেন্সরভিত্তিক অ্যালার্ম সিস্টেম ও আগুনের বিস্তার রোধক দেয়াল। শাহজালাল বিমানবন্দরের এই ঘটনায় দেখা গেছে, আগুনের খবর পাওয়া এবং প্রথম ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ মিনিট। এই সময়ই আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
দুর্ঘটনার পরপরই বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটি ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। এই কমিটির মধ্যে রয়েছেন বিমানের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের প্রধান, সিএএবি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন কারিগরি বিশেষজ্ঞ। এটি প্রশাসনিকভাবে সঠিক পদক্ষেপ হলেও প্রশ্ন রয়ে যায়- এই রিপোর্ট কেবল অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি জনসমক্ষে প্রকাশিত হবে? উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যেমন যুক্তরাজ্য, জাপান বা কানাডায় এ ধরনের দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে দেওয়া হয়। তাতে দায় নির্ধারণ, ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ প্রতিরোধের সুপারিশ তুলে ধরা হয়। জনজবাবদিহিতার সেই সংস্কৃতি এখনো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় অনুপস্থিত।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘রয়টার্স’ ও ‘ইকোনমিক টাইমস’-এর খবরে দেখা যায়, আগুনের পর অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল ও চারটি বিকল্পভাবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থগিত থাকে সমগ্র বিমান চলাচল। এতে শুধু যাত্রীই নয়, বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্যÑবিশেষ করে তৈরি পোশাক ও ঔষধ সামগ্রীÑঅবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থনীতির এই প্রভাব হয়তো এখনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায়নি, কিন্তু ক্ষতিটা বাস্তবে গুরুতর। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে, যার অধিকাংশ পণ্য বিমানযোগে পাঠানো হয়। একটি বিমানবন্দর ঘন্টার পর ঘন্টা অচল থাকলে এর অভিঘাত পড়ে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, ক্রেতা আস্থা এবং সরবরাহ-চেইন ব্যবস্থায়।
এই দিক থেকে দেখলে, একটি আগুনের ঘটনা আসলে আমাদের প্রশাসনিক পরিকল্পনার গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। বিমানবন্দর কেবল যাত্রীবাহী নয়, এটি অর্থনৈতিক প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ তার কার্গো বিভাগে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার যথাযথ প্রস্তুতি না থাকা, নিরাপত্তা তদারকি যথাসময়ে না করা- এসবই আমাদের দীর্ঘদিনের ‘রিঅ্যাকটিভ’ প্রশাসনের প্রতিফলন। উন্নত রাষ্ট্রগুলো “প্রোঅ্যাকটিভ” ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত, প্রশিক্ষণ ও মহড়া সম্পন্ন, জরুরি বাজেট বরাদ্দ এবং বিকল্প পরিকল্পনা নির্ধারণ করে রাখে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল ও দেরিতে তথ্যপ্রদান নিয়ে যাত্রীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে আটকে ছিলেন, অনেকে জানতেন না কখন ফ্লাইট ছাড়বে। আমরা দেশ হিসেবে ডিজিটালি এখনো কেন পিছিয়ে আছি, কেন রিয়েল-টাইম তথ্য ব্যবস্থার অভাব এই ঘটনার মধ্যেও চোখে পড়ে? উন্নত দেশগুলোতে বিমানবন্দরের যেকোনো সংকট মুহূর্তে যাত্রীদের মোবাইল বার্তা, অ্যাপ ও অনলাইন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক আপডেট দেওয়া হয়। আমাদের এখনো সে রকম নাগরিক সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তবে সব দিকই হতাশার নয়। এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের শতাধিক সদস্য, বিমানবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ও সিভিল এভিয়েশন কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। কোনো প্রাণহানি হয়নি- এটিই সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয়। দ্রুত বিমান চলাচল পুনরায় চালু করার যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়; উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এমন প্রতিক্রিয়াকে নিয়মিত রূপ দিতে হবে, কেবল একবারের জন্য ঘটনাপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বিমানবন্দর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সিঙ্গাপুর, কাতার ও জাপান আদর্শ উদাহরণ। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে বছরে অন্তত ছয়বার অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয়, যেখানে দমকল, পুলিশ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এমনকি বেসরকারি এয়ারলাইনসমূহও অংশ নেয়। তাদের প্রতিটি টার্মিনালে তিন স্তরের সেফটি জোন, স্বয়ংক্রিয় সেন্সর-ভিত্তিক ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ‘ইনস্ট্যান্ট রেসপন্স প্রোটোকল’ সক্রিয় থাকে। আমাদের শাহজালাল বিমানবন্দরে যদি এমন ব্যবস্থাপনা থাকত, তাহলে হয়তো আগুনের ক্ষতি অনেকটাই কমানো যেত।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রশ্নও নতুনভাবে সামনে এসেছে। যেহেতু বিমানবন্দর একটি কৌশলগত স্থাপনা, তাই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল সিএএবি বা বিমানের দায়িত্ব নয়; বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। রাষ্ট্র যদি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়- বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, শিল্পাঞ্চল-সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তাহলে যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলা সহজতর হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ‘ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোটেকশন ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে এমনই একটি নীতি অনুসরণ করে, যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা বার্ষিকভাবে সরকারের কাছে জমা দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন কাঠামো এখন অত্যাবশ্যক।
অগ্নিকাণ্ডের আরেকটি মাত্রা হলো, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিমা ব্যবস্থার কার্যকারিতা। বিমানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কার্গোতে থাকা পণ্যের একটি অংশ বীমাকৃত ছিল, তবে পুরো ক্ষতি কাভার করা সম্ভব হবে না। উন্নত রাষ্ট্রে শিল্প-বাণিজ্যিক বিমা কার্যক্রম অনেক বেশি সক্রিয় থাকে; এমনকি দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যাতে তাদের উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের দেশে বিমা ব্যবস্থার সেই গতিশীলতা এখনো গড়ে ওঠেনি।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া। উন্নত রাষ্ট্র মানে নিখুঁত রাষ্ট্র নয়, বরং ভুল থেকে দ্রুত শেখার রাষ্ট্র। জাপানের তোহোকু ভূমিকম্পের পর দেশটি তার পুরো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর পর বিমান নিরাপত্তা নীতিতে বিপ্লব এসেছে। বাংলাদেশকেও এখন সেই শিক্ষা নিতে হবে- শুধু বিমানবন্দর নয়, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রস্তুতি প্রোটোকল তৈরি করতে হবে।
এই আগুনের ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটায় আমরা আপাতত স্বস্তি পেতে পারি, কিন্তু এই স্বস্তিই যেন আত্মতুষ্টিতে পরিণত না হয়। আমাদের প্রশাসনকে আরও দ্রুত, সমন্বিত ও স্বচ্ছ হতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, দায় নির্ধারণ করতে হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জনগণের জানার অধিকার ও নিরাপত্তা দুটোই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির অংশ। আজকের আগুন আমাদের জন্য কেবল আতঙ্ক নয়, বরং এক বাস্তব আয়না, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমরা কতটা প্রস্তুত, আর কতটা পিছিয়ে। সেই আয়নায় নিজেদের সৎভাবে দেখার সাহসটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কারণ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া শুধু বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নয়, বরং এমন সংকট মুহূর্তে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমেই সম্ভব।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।