বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঈদ আনন্দ  ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

  •    
  • ৪ মে, ২০২২ ১৩:৩৭

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েকদিন পর পর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের ওপর এমন আঘাতের উৎস কোথায়? আওয়ামী লীগ এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতেই দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব কীভাবে বাড়ছে, তার কারণ অনুসন্ধানের কোনো আগ্রহ কি দলটির মধ্যে আছে?

এবার ঈদে ঢাকা থেকে যারা বাইরে গিয়েছে বা বাইরে থেকে ঢাকা ফিরছেন, তাদের পথকষ্ট বাড়বে বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা তেমন হয়নি বা হবে না বলা চলে। যাত্রা অনেকটাই বিড়ম্বনামুক্ত। কোথাও কাউকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়নি, গরমে সেদ্ধ হতে হয়নি। কীভাবে এটা সম্ভব হলো সে আলোচনায় না গিয়ে অন্য কিছু প্রসঙ্গে দুচার কথা বলা যাক।

দুই বছর করোনার চোখ রাঙানিতে ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছে। এবার করোনা কমে আসায় মানুষ খুশি। তবে মূল্যবৃদ্ধির দাপট মানুষকে কিছুটা কাহিল করেছে। এটাও ঠিক যে আমাদের দেশের মানুষ সব সময় অনুকূল অবস্থায় চলতে পারে না। কোনো না কোনো সমস্যা থাকেই। ঈদের আনন্দ তাতে খুব ম্লান হয় না। সাধারণ মানুষ অল্পে তুষ্ট। তাই তারা সামান্য কিছু পেলেই বর্তে যাই।

বার যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে অনেকের ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও রেকর্ডেড শুভেচ্ছা বার্তা, তবুও প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠ নিজের হাতের মোবাইলে শুনতে পেয়ে সবাই না হলেও অনেকেই যারপরনাই খুশি হয়েছেন। তবে সব মোবাইল নম্বরে বার্তাটি পাঠালে আরও ভালো হতো। যারা বার্তা পাননি তারা কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছেন, বঞ্চিত বোধ করেছেন। পরের ঈদে হয়তো এই বৈষম্যের অবসান ঘটবে।

এবার সাংবাদিকদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঈদের সালামিও পেয়েছেন। আগে এমন হয়েছে বলে শোনা যায়নি। টাকার পরিমাণ হয়তো বেশি নয়, কিন্তু জাতির অভিভাবকের কাছ থেকে ঈদের সালামি পেলে মন কার না ভালো হয়! তবে এ নিয়ে নিন্দা করার লোকেরও অভাব নেই। যারা হিংসুটে স্বভাবের তারা বলছেন, ‘দালাল’ সাংবাদিকদেরই এই সালামি দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলি আছে, সব পেশাতেই আছে। তবে বিএনপি বা অন্য দলের সমর্থকদের দালাল বলা হয় না। দালাল শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেই। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যারা সালামি পাঠানোর দায়িত্বে ছিলেন তারা বুদ্ধিমান হলে বিএনপিপন্থি কয়েকজনকেও সালামি পাঠাতে পারতেন। সামান্য সালামিতেই যদি কাউকে কেনা যায় তাহলে এমন সালামির পাওয়ার তালিকা একটু লম্বা হলে বেশি ক্ষতি হতো কি?

এবার ঈদের আগে অনেক ভিটেমাটিহীন নিঃস্ব পরিবারকে ঘর উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি নিজস্ব ঘর, নিজের একটি ঠিকানা ছিল স্বপ্নের, তাদের স্বপ্নপূরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের সব মানুষের মন ভালো করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী একাই যেভাবে পালন করছেন, তার প্রশংসা না করা অন্যায়। এই যে কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটি তিনি এলাকাবাসীর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন, তাতে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের মানুষের মন ভালো হয়ে যায়নি? স্থানীয় সংসদ সদস্য, পুলিশ, মন্ত্রী কেউ যখন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গরজ বোধ করেননি, তখন প্রধানমন্ত্রী ঠিক তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এখন যদি বলা হয়, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারো কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ নয়, তাহলে কি তাকে অতিরিক্ত ‘তেলের’ ব্যবহার বলে মনে করা হবে?

বাংলাদেশের অনেক সমস্যা। সব সমস্যার রাতারাতি সমাধান করা অলৌকিক ক্ষমতাধর ছাড়া কারো পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে যেগুলো সমাধানের জন্য বিপুল অর্থসম্পদ প্রয়োজন হয় না, দরকার হয় আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। আমাদের দেশে অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারো মধ্যেই আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা দেখা যায় না।

সেজন্য তার হস্তক্ষেপ ছাড়া সাধারণ কোনো সমস্যারও সুরাহা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক মানবিক, তিনি পরিশ্রমী, তিনি দরদি, তার নজর সব দিকে; এটা যেমন ভালো, তেমনি এর খারাপ দিকও আছে। একজন মানুষের ওপর অতিনির্ভরতা এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হলেও এক সময় এটা বিপদের কারণও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী একজন মানুষ, তার মানবিক ত্রুটি-দুর্বলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাকে সহযোগিতা করার জন্য, পরামর্শ দেয়ার জন্য যদি চৌকস ও স্বার্থত্যাগী কিছু মানুষ না থাকে তাহলে এক সময় তা খারাপ ফল দিতে বাধ্য। সব কিছু যদি প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয়; তাহলে এতবড় মন্ত্রিসভা, এত বিস্তৃত আমলাতন্ত্র, এতসব বাহিনী রেখে লাভ কী? কলাবাগান মাঠ রক্ষার আন্দোলন আমাদের অনেক দুর্লতাই সামনে এনেছে।

মাঠ বাঁচানোর আন্দোলন করার অপরাধে সৈয়দা রত্না এবং তার কিশোর সন্তানকে পুলিশ ধরে নিয়ে না গেলে হয়তো আমাদের নাগরিক সমাজেরও অনেকের ঘুম ভাঙত না। পুলিশের অতি উৎসাহ এবং পুলিশ মন্ত্রীর পক্ষপাত শাপে বর হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এভাবে কি চলতে পারে, না চলতে দেয়া উচিত?

চট্টগ্রামের পটিয়ায় ইফতার মাহফিলে হামলা চালিয়ে হাইদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিতেন কান্তি গুহকে গাছে বেঁধে মারধর করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে কতটা আবর্জনা জমেছে তা আবার স্পষ্ট করে দিয়েছে। যিনি জিতেন গুহকে মারধর করেছেন তার নাম বি এম জসিম । তিনি হাইদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে সম্প্রতি।

হাইদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যে ইফতার মাহফিলে জিতেন কান্তিকে লাঞ্ছিত ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে, ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল স্থানীয় সাংসদ সামশুল হক চৌধুরীর। জিতেন কান্তি ছিলেন বিশেষ অতিথি । কিন্তু ব্যানারে ইউপি চেয়ারম্যান বি এম জসিমের নাম ছিল না। জিতেন গুহকে মারধরের পর ইফতার মাহফিল পণ্ড হয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘আমরা অনুষ্ঠানস্থলে কয়েকজন বসেছিলাম। তখনও ইফতারের অনেকটা দেরি। এ সময় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে (বি এম জসিম) লোকজন এসে আমাদের ইউনিয়নের আহ্বায়ক মাহফুজুল হকের নাম ধরে অশ্রাব্য গালি দিতে থাকে। এরপর হঠাৎ তারা জিতেন গুহকে মারধর শুরু করে। তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করে রক্তাক্ত করে। গত ইউপি নির্বাচনে জিতেন গুহ ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসানের নৌকা মার্কার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট। সেই আক্রোশ থেকে তাকে মারধর করা হয়েছে।’

চট্টগ্রামের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশেই আওয়ামী পরিবারের ভেতরে এমন সমস্যা আছে। কিন্তু মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরা এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে বরং কোন্দল জিইয়ে রাখতে পছন্দ করেন । আবার কোনো ক্ষেত্রে হয়তো সমস্যা সমাধানের যোগ্যতাও তাদের নেই। কোনো না কোনো প্রভাবশালীর প্রশ্রয়ে দলের মধ্যে এমন চক্র গড়ে উঠেছে যে চক্রকে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

জিতেন গুহকে নির্যাতনের ঘটনাটি কি সাম্প্রদায়িক? আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন মনে করেন, ‘এটি একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা এবং জিতেন গুহ সাম্প্রদায়িকতার শিকার।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েকদিন পর পর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের ওপর এমন আঘাতের উৎস কোথায়? আওয়ামী লীগ এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতেই দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব কীভাবে বাড়ছে, তার কারণ অনুসন্ধানের কোনো আগ্রহ কি দলটির মধ্যে আছে?

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া যে কিছু হয় না, তা দেখা যাচ্ছে। তাহলে প্রধানমন্ত্রীও কি দলের ভেতর থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করতে চান না? নাকি লোম বাছতে গেলে কম্বল উজাড়ের আশঙ্কা তার মনেও আছে? বলা হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে খবর না পৌঁছালে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কিন্তু সব তথ্য তার কাছে পৌঁছানোর উপায় কী? সবার পক্ষে তো তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়? তাহলে? আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া বা মারমুখী হওয়া কোনো সমাধান নয়। এতে বরং আরও অপরাধ বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়।

প্রধানমন্ত্রী কি নিজে কোনো উপায় ভাববেন? সামনে নির্বাচন। এই নির্বাচনে সহজে বিজয় ছিনিয়ে আনা যাবে বলে মনে হয় না। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে, যাবে। নির্বাচনে মানুষের সমর্থন পাওয়াটাও নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রীর ওপরই। সবাইকে টেনে নেয়ার জন্য এমন কিছু করতে হবে যাতে দুষ্টরা সমঝে চলবে আর সাধারণ মানুষ খুশি হবে।

মন্ত্রী, এমপি এবং দলের নেতাদের প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনা দিতে পারেন যে, কোনো এলাকায় দলীয় কোন্দল থাকলে, দলের মধ্যে অবাধ দুর্নীতি চললে, সাম্প্রদায়িকতা ছড়ালে তার আর আওয়ামী লীগে থাকা চলবে না। যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ইতোমধ্যেই উঠেছে, তাদের কয়েকজন দল বা মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দিলে অন্যদের কাছে সতর্ক বার্তা যাবে। সবুজ সংকেত নয়, এখন লাল কার্ড দেখানোর সময় হয়েছে। ফাউল গেম বন্ধ না হলে বিজয়ের আনন্দ স্থায়ী হবে না। নীতি এবং দুর্নীতি বা নীতিহীনতার মধ্যে একটি বেছে নেয়ার চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার বিকল্প নেই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর