দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমঝোতার অভাব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সব সময়ই সংকটময় করে তোলে। বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে ঘিরে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। সেনাবাহিনী সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সংবেদনশীল নাম। কারণ জনগণের আস্থা, বাহিনীর শক্তি এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য শুধু সেনাসদস্যদের উদ্দেশে নয়, বরং জাতির উদ্দেশে একটি পরোক্ষ বার্তাও বটে। এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জাতীয় নির্বাচন, সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া। তিনি সেনাসদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশ এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই কথার মধ্যে শুধু একটি অনুপ্রেরণা নেই, বরং এর মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা রয়েছে যে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট হবে না। বাংলাদেশে অতীতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় একটি প্রত্যাশা কাজ করেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিলো গৌরবান্বিত। এবার সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাহিনী কেবল রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে কাজ করবে, কোনো দলের হয়ে নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন এবং দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না। নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে সেনাদের উপস্থিতি জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক হলেও, একই সঙ্গে এটি এক ধরনের অনেকেরই ভয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায় তারা বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং যে কোনো মূল্যে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তাই সেনাপ্রধানের এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে বাহিনীকে অবশ্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এটি কেবল নির্বাচন নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই বাহিনী নিয়ে নানা মন্তব্য, সমালোচনা এমনকি অপপ্রচার চালানো হয়। সেনাপ্রধান এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব মন্তব্যে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। যারা করছে, তারা অনেকেই তরুণ এবং তাদের বয়স সেনা সদস্যদের সন্তানের বয়সি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এই ধৈর্যশীল মনোভাব বাহিনীর মনোবল রক্ষা করার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। কারণ সেনাবাহিনী যদি সমালোচনার মুখে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাত, তবে তা গণমানুষের সঙ্গে অযাচিত দূরত্ব তৈরি করত। বরং সহনশীল মনোভাব দেখিয়ে সেনাপ্রধান এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন—সেনাবাহিনী জনগণের বিপরীতে নয়, বরং জনগণের সঙ্গেই আছে।
বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার বিষয়েও সেনাপ্রধান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এক সেনাসদস্যের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে এবং প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইভাবে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগও তদন্তাধীন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে কোনো অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না। এখানে দুই দিকের বার্তা রয়েছে, একদিকে সেনাবাহিনী কোনো অনৈতিকতা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সহ্য করবে না, অন্যদিকে বাহিনীর সদস্যদের অধিকার ও ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা হবে। এই ভারসাম্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই আলোচনায় থাকে। জনগণ প্রায়শই আশা করে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে, জালিয়াতি বা অনিয়ম কম হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে অভিযুক্ত করে থাকে যে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। সেনাপ্রধান এই প্রেক্ষাপটে ঘোষণা দিয়েছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন, যা এর আগে হয়নি। তাই জনগণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এখন জরুরি।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার নির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের সময় বাহিনী কেবল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে না, বরং মানুষের আস্থা অর্জন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি জনগণ সেনাদের উপস্থিতিকে আশ্বাস হিসেবে না দেখে, বরং ভয় হিসেবে দেখে, তাহলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেনাপ্রধানের বার্তা ছিল আস্থা ফিরিয়ে আনার কৌশল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক অস্থির বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এখনো মীমাংসিত হয়নি। জনগণের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কোন পথে হাটবে এবং কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন হবে কি না। যদিও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বারবার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেই আস্থার প্রতিশ্রুতি বহন করে। তিনি আগেই বলেছিলেন, নির্বাচনের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করবে একটি নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমাধানের অংশ নয়, বরং একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করবে। কেবল নির্বাচনই নয় সেনা প্রধান তার বক্তব্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তা হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিবর্তে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি কেবল সেনাবাহিনীর জন্য নয়, দেশের সার্বিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—অপরাধ দমনে প্রতিরোধই প্রধান সমাধান।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রসঙ্গও তিনি তুলেছেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। এই বার্তা শুধু সেনা সদস্যদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা বোঝাচ্ছে, বাহিনী এসব প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেবে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেস ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে সেনাসদস্যদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে সেনাবাহিনী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বক্তব্য এক ধরনের স্থিতিশীলতার বার্তা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কারণ নির্বাচনের সময় কেবল সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহনশীল না হয়, তবে সেনাবাহিনী যতই পেশাদার হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবেই। তাই সেনাপ্রধানের বার্তাটি আশ্বাসজনক হলেও, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিলতা তা কতটা বাস্তবায়িত হতে দেবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
সব মিলে বলা যায়, সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দিকনির্দেশনা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তাও। তিনি পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের ওপর জোর দিয়ে জাতিকে এক ধরনের আস্থা দিতে চেয়েছেন। যখন রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিভাজন ও অবিশ্বাস তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বার্তা জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেনাবাহিনী দেশের জন্য, কোনো দলের জন্য নয়। আর সেই কারণেই এই বক্তব্য বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।