প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম এক সদস্য লাল পিঁপড়া ছোট অথচ পরিবেশে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এই ক্ষুদ্র প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা শুধুমাত্র এক পোকা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিঃশব্দ এক প্রহরী। কিন্তু আজ এই নীরব প্রহরীর অস্তিত্ব বিপন্ন। অসংযত ও অবাধ শিকারে তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই তাদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।
পিঁপড়া সামাজিক, পরিশ্রমী ও চতুর প্রাণী। আমাদের দেশে খুদে পিঁপড়া, ডেঁয়ো পিঁপড়া, সুড়সুড়ে পিঁপড়া, বিষ পিঁপড়া, লাল পিঁপড়া ছাড়াও বহু প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। একটু কম বিষাক্ত বড়ো আকৃতির লাল পিঁপড়ারা বন্য এবং দলবেঁধে গাছের মাথায় বাসা বানিয়ে থাকে। ভাওয়াল ও মধুপুরের গজারী বনে গাছের মাথায় এদের বাসা বেশি দেখা যায়। এ এলাকায় স্থানীয় নাম ‘গজারী কুত্তা’। অনেকে ‘রামকুত্তা’ ‘কুড়িলের’ বলেও ডাকে। তাছাড়া সারা দেশে আম, লিচু, মেহগিনি গাছসহ অনেক গাছেই লাল পিঁপড়ার বাসা চোখে পড়ে। ওখানেই জীবনচক্রের ধাপগুলো সম্পূর্ণ করে।
বিচিত্র এদের জীবন। দলবদ্ধভাবে রানির অধীনে বাসা তৈরির কাজ করে ওরা। গাছের মগডালে প্রথমে অনেকগুলো পাতা জোড়া দিয়ে বল আকৃতির বানায়। লালার সাহায্যে এক রকম আঠা তৈরি করে পাতা জোড়া লাগায়। শক্ত চোয়াল দিয়ে পাতা মুড়িয়ে গোল করার আগে ভেতরে আলাদা আলাদা কুঠুরি বানায়। কর্মী পিঁপড়ারা ভবিষ্যতের খাবার সংগ্রহ করে রাখে। গোল আকৃতির বাসা এত মজবুত হয় যে বৃষ্টির পানি পর্যন্ত ভেতরে ঢোকে না। বসন্তকালে একটি কলোনিতে বেশ কিছু পুরুষ ও রানি পিঁপড়া জন্ম নেয়। এই সময় উভয়ের ডানা গজায়। এক সময় বাইরে এসে বংশ বৃদ্ধির জন্য ঝাঁক বেঁধে উড়াল দেয়। মিলনের পর নতুন রানি ডিম পেড়ে পৃথক কলোনির সৃষ্টি করে। ডিম দেখতে চিকন সাদা মুড়ি বা ভাতের মতো দেখায়। বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষে। মাছ ধরার টোপের জন্য লাল পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা বেশি। লাল পিঁপড়ার ডিমের টোপ বড়ো মাছেরা সহজেই গেলে। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই ডিমের চাহিদা বেশি।
লাল পিঁপড়া শুধু একটি ক্ষুদ্র পোকা নয়; তারা বন্যপ্রাণী হিসেবে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বনের গাছে, মাঠে, মাটির নিচে, এমনকি মানব আবাসের আশপাশেও তারা বাসা গড়ে দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করে। রানির নেতৃত্বে পিঁপড়ারা জটিল সামাজিক ব্যবস্থা মেনে কাজ করে; খাদ্য সংগ্রহ, বাসা নির্মাণ, বংশবৃদ্ধি সবকিছুই দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়।
তাদের বাসা সাধারণত গাছের উপরের পাতাগুলো থেকে তৈরি হয়, যেখানে পাতা একত্র করে লালা দিয়ে শক্তিশালী বাসা বানানো হয়। বসন্তকালে ডানা গজিয়ে তারা উড়াল দিয়ে নতুন কলোনি গড়ে বংশ বিস্তার করে।
পরিবেশে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম ও বহুমাত্রিক। প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি তার অবিস্মরণীয় ভূমিকার মাধ্যমে জীবজগতে সমতা ও সুষমতা বজায় রাখে। প্রথমত, লাল পিঁপড়া কৃষিক্ষেত্রে এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা শুঁয়োপোকা, মশা, মাছি ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিস্তার রোধ করে, যা আমাদের ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান উন্নত করে। এই কারণে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পায়। পরিবেশে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং জলবায়ুর ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, তাই লাল পিঁপড়ার এই প্রাকৃতিক ভূমিকা পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিকভাবে, লাল পিঁপড়া পরিবেশের এক নীরব কর্মী, যারা আমাদের কৃষি, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রাখে। তাই তাদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও আইনগত ব্যবস্থা, যাতে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদটি আগামী প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
অপরিকল্পিত শিকার ও রাসায়নিক ব্যবহার লাল পিঁপড়ার বিপন্নতার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীকে ধ্বংস করতে অবাধ শিকার চালানো হয়, যা তাদের প্রজাতি সংকটের মুখে ফেলে। পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রে ও পরিবেশে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগ করা হয়, যা লাল পিঁপড়াসহ অন্যান্য গুণান্বিত জীবজন্তুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, ফসলের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। তাই, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য লাল পিঁপড়াসহ প্রাকৃতিক জীবজগতের সুরক্ষা ও অবাধ শিকার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা
লাল পিঁপড়া বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অতি মূল্যবান উপাদান হলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নেই, যার ফলে তারা সঠিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অবৈধ শিকার রোধে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। লাল পিঁপড়ার উপর সুনির্দিষ্ট আইনগত সুরক্ষা না থাকায় তাদের বাসস্থান বিনষ্ট হওয়া, অবৈধ শিকার ও পরিবেশ দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হলে অবৈধ শিকার ও বাসস্থান ধ্বংস প্রতিরোধ সম্ভব হবে, যা লাল পিঁপড়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সমাজে তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কার্যকর মনিটরিং ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধও বৃদ্ধি পাবে, যা টেকসই উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। তাই লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে সফলতা অর্জনের জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে করণীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যার মধ্যে অন্যতম হলো আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ, যা লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। এতে বাসস্থান রক্ষা, অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং জরিমানা বিধানসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। একই সঙ্গে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃতির এই অনন্য উপাদানের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারে। এছাড়াও, ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশবান্ধব আয়সূত্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা তাদের জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত করবে। বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য লাল পিঁপড়ার জীবনচক্র, বাসস্থান, প্রজনন ও বিপদ নির্ণয়ের ওপর নিয়মিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সবশেষে, স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকৃতির সুরক্ষায় তাদের দায়বদ্ধ করা হলে সংরক্ষণ কার্যক্রম অধিক কার্যকর ও টেকসই হবে। এই সমন্বিত উদ্যোগেই লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে বাস্তব পরিবর্তন আসবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে কার্যকর ও টেকসই ফলাফল অর্জনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এর আওতায় প্রথমত, লাল পিঁপড়ার ঘন ঘন আবাসস্থলগুলো সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যা সংরক্ষিত জোন হিসেবে পরিচিত হবে এবং সেখানে বিশেষ সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, ডিম আহরণ বা পিঁপড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, যাতে অবৈধ শিকার ও অতিরিক্ত আহরণ রোধ করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। তৃতীয়ত, অবৈধ শিকার, বাসা ভাঙা ও পরিবেশ বিনষ্টের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণ করে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের deterrent হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষ, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশ মনিটরিং ও প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এইসব উপাদান নিয়ে গঠিত একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করবে এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
সেলিম রানা,
গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট