বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাদা পাথর সমাচার

  • সম্পাদকীয়   
  • ২২ আগস্ট, ২০২৫ ০০:১৪

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাদা পাথরে কালো হাত পড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জের ‘সাদাপাথর’। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ, যেন এক বিরাণভূমী। এই নজিরবিহীন পাথর লুটের ঘটনায় দেশবাসী হতবাক। এক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আরো সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল। এদিকে পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক দুই শত কোটি টাকার উপরে। এটি সত্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পাথর লুট শুরু হলেও এতদিন নিস্ক্রিয় ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ এক বছর ধরে সাদা পাথর লুটপাট চলেছে। এখন বলতে গেলে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বাংলাদেশের আলংকারিক সৌন্দর্যের একটি অনন্য প্রপঞ্চ।

যতদূর চোখ যায়, কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ পানি, ওপরে নীল আকাশ, আর সবুজ পাহাড়ে মেঘের আলিঙন। সেহেতু যে ভাবেই বলি না কেন, এটি প্রকৃতির এক অপরূপ স্বর্গরাজ্য। বস্তুত সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে প্রকৃতির এই রূপের আধার হলো উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এখানের সাদা পাথর, রোপওয়ে, পাথর কোয়ারি, আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ধলাই নদের বুকে স্বচ্ছ পানি, আর সাদা পাথরের মুগ্ধতায় মন ভরে যায় পর্যটক’সহ সবার। এটি লক্ষ্যনীয় যে যে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাদা পাথর। মনে হয় যেন, প্রকৃতি শুভ্র বিছানা বিছিয়ে রেখেছে। মাঝখানে স্বচ্ছ ঢেউ খেলানো নীল পানি। চারদিকে ঘিরে আছে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়; আর তার ওপর যেন আছড়ে পড়েছে মেঘ। এতদ্ব্যতীত চারপাশে আছে সবুজ প্রকৃতি। সব মিলিয়ে প্রকৃতির যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এই অপূর্ব স্থানটি উপভোগের জন্য ছুটে আসেন এই সাদা পাথরের দেশে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভোলাগঞ্জ সীমান্তে প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা। একদিকে যোগানদাতা হিসেবে ধলাই নদের পানি। অন্যদিকে ঝরনার পানি প্রবাহ ভোলাগঞ্জকে রূপে রানী করে সাজিয়ে তুলেছে। তাছাড়া সবুজ পাহাড় ও সাদা-কাল মেঘের হাতছানি। বস্তুত বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুনে। বর্ষায় এই নদের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা পাথরের বিছানা নদীর শোভা বাড়িয়ে তুলে। তাছাড়া সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায়।

২০২১ সালে আমার এখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের উৎস মুখের পাথর পরিবেষ্টিত জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা সাদা পাথর নামে পরিচিত। আসলে সাদাপাথর এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তূপের কারণে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে তৈরি এ স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে অভিহিত। মজার ব্যাপার হলো যে, ধলাই নদ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে চারপাশ ঘুরে আবার মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের পানির সঙ্গে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর সাদা পাথর নেমে আসে। আর এই পাথর উত্তোলনকে সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোলাগঞ্জ থেকে সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ এই রোপওয়ে চলে গেছে ছাতক পর্যন্ত, যা ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে রোপওয়ের টাওয়ারগুলো কেবল কালের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। রোপওয়ে বন্ধ হলেও থেমে নেই পাথর উত্তোলন। এখনো অনেক স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস এই পাথর উত্তোলন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে সাদা পাথর তুলে নিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত সাদা পাথর কংকাল সার করে তুলেছে। এই পাথর লুট নিয়ে পাল্টাপাল্টি অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আইনগতভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নাকি করা হয়েছে বলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করছেন। তথ্যমতে জানা যায় যে, পাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরিপূর্বক ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদা পাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পূনস্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আবার প্রতিপাদ্য কথাই ফিরে আসি। সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পট সাদা পাথর এখন বিরাণভূমি। কোথাও আর পাথর নেই। উল্লেখ্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদা পাথর এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ছবি ভাইরাল হয়। তারপর থেকেই দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমালোচনা ও প্রতিবেদনকে তোয়াক্কা না করেই দেখা গিয়েছে যে শত শত ট্রাকে সাদা পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান একটি পত্রিকাকে বলেন, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ১৯১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আছে আরও ৩১০ জন। এরমধ্যে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। সাদা পাথর লুট হওয়া নিয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা চাই একটি পাথরও যেন লুট না হয়। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এর মধ্যে ১৭/০৮/২০২৫ তারিখের আর একটি পত্রিকায় দেখলাম ৩২টি মামলা হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে ১৭ জনের নাম বার বার আসছে।

প্রকাশ থাকে যে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেতো, দেখা যেতো সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। অথচ সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি। বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়েছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।

পূর্বেও কিছুটা উল্লেখ করা হলেও আবারও বিশ্লেষনের জন্য আলোকপাত করতে হচ্ছে। বস্তুত সিলেট নগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। ঠিক এক বছর আগেও এই স্থানের সৌন্দর্যের সুবাদে হৃদয় আবেগময় হয়ে কবি মন হয়ে দাঁড়াতো। কেননা ‘যতদূর চোখ যায়, দুই দিকে কেবল সাদা পাথর, আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল আরেকদিকে পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। মনে হতো কাশ্মীরের মতো স্বর্গরাজ্য। সৌন্দর্যের যেন এক অনবদ্য ক্যানভাস।’ কিন্তু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবস্থা নেয়ার পরও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকে সংশয় পোষন করে থাকেন।

সত্যি কথা বলতে কি, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে মূলত সাদা পাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনের স্থবিরতা বা ভীতিই এই পাথর লুট হওয়ার কারণ। আসলে প্রশাসনের কঠোর না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা উক্ত স্বচ্ছ পানির আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়। এদিকে এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ংকর রকম তোড় তৈরি হয়। এর মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি, সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে এদিক ওদিক প্রবাহপূর্বক টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ।’ শুধু তাই নয়, পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোন ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হলে, তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। এটি সত্য যে, ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি। আর এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতি তৈরির অভিঘাত সৃষ্টির পথ সুগম করে। তাই সঙ্গতকারণেই যথেচ্ছার ভাবে পাথর লুট বা সরানো মোটেই কাম্য নয়।

ইতোমধ্যে সাদা পাথর লুট হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ঠিক চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এর ন্যায়। যাহোক, এই সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিয়ামক নয়। এর সুবাদে পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, ভবিষ্যতে যাতে এ রকম অনাহুত নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সে ক্ষেত্রে সবাই সজাগ থাকতে হবে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। আর এর পেছনে, বাইরের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তাও তলিয়ে দেখতে হবে।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর