সুরা লুকমান, পর্ব ১০
অনুবাদ
(৩৩) হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, আর সেদিনকে ভয় করো, যেদিন কোন পিতা তার পুত্রের কোন উপকারে আসবে না, এবং কোন পুত্রও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেনো তোমাদের ধোঁকা না দেয় এবং মহাপ্রতারক (শয়তান) যেনো তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। (৩৪) নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনি জানেন মাতৃগর্ভে কি আছে। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। আর কেউ জানে না, সে কোথায় মারা যাবে। আল্লাহই সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
মর্ম ও শিক্ষা
আলোচ্য আয়াতগুচ্ছের মধ্য দিয়ে সূরা লুকমানের উপসংহার টানা হয়েছে। সূরাটিতে নানাভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত, আখিরাত ইত্যাদিসহ ঈমানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টি জগতের প্রকৃতির বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এগুলো আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের নিদর্শন বহন করে। মানুষের সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত ও আখিরাতের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে। মানুষের হৃদয়ের গভীরেও আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ ও প্রভূত্বের বীজ অঙ্কুরিত রয়েছে। এমনকি বাতিলপন্থীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এ সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা কে, তখন তারাও স্বীকার করে যে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। এতসব দলীল প্রমাণের পর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, তাহলে মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক থাকা, যেদিন সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং কেউ কারো উপকারে আসতে পারবে না। সে কিয়ামতের দিন সত্য ও সঠিক। কিয়ামতের সেই ক্ষণ কবে আসবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কাজেই প্রতিটি মানুষের উচিত মৃত্যু ও কিয়ামত সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেতন থাকা।
তাকওয়া: আল্লাহভীতি
গোটা সূরায় এই সত্যটি যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সবকিছু প্রতিপালন করেন। তিনি মানুষকে অগণিত এবং সীমাহীন নিয়ামত দান করেছেন। আসলে গোটা সৃষ্টিকেই আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব অনর্থক নয়, বরং এগুলোর একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। তা হলো এই যে মানুষ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, তার গোটা জীবনকে আল্লাহর সামনে সমর্পণ করে দেবে, আল্লাহর বিধি-নিষেধ ও জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করবে। তা না করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। দুনিয়াতেও আল্লাহ তার নেয়ামত ছিনিয়ে নিতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, এমনকি গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তারপর রয়েছে পরকালের জবাবদিহি এবং অনন্তকালের শাস্তি। সুতরাং প্রতিটি মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। আলোচ্য আয়াত দুটির প্রথমেই আল্লাহর নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষ যেনো আল্লাহকে ভয় করে, তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে।
আখিরাতে বিশ্বাস
আল্লাহকে ভয় করা প্রসঙ্গে সেদিনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেদিন আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকে কোন উপকার করতে পারবে না। বলাবাহুল্য, সে দিনটি হলো কিয়ামত, যা দিয়ে আখিরাতের অনন্তকালের জীবন শুরু হবে। এভাবে এখানে আখিরাতে বিশ্বাসের বিষয়টি বলিষ্ঠভাবে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এ দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের জীবনের যাত্রা শুরু, যে জীবনের শেষ নেই, যে জীবন অনন্তকালের। মানুষ তার দুনিয়ার কর্মজীবনের ফলাফল ভোগ করবে আখিরাতে। এ বিশ্বাস হলো ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের প্রধান প্রেরণা হলো আখিরাতের সে জীবন।
আখেরাতের জীবনের অবস্থা নির্ভর করে কর্মের উপর
আখিরাতে মানুষ শান্তিতে বাস করবে নাকি শাস্তি ভোগ করবে, তা নির্ভর করে তার নিজের কর্ম ও আমলের উপর। প্রত্যেকের আমল অনুযায়ী কিয়ামতের দিন বিচার হবে, এবং সে বিচারের রায় অনুযায়ী অনন্তকালের জীবন যাপন করতে হবে। নিজ আমল দিয়ে যদি সেদিন মুক্তির ব্যবস্থা না হয়, তাহলে কেউ সেখানে কোন উপকারে আসবে না। আয়াতে বলা হয়েছে, পিতাও তার সন্তানের কোন উপকার করতে পারবে না, এবং সন্তানও তার পিতার কোনো উপকার করতে পারবে না। অর্থাৎ যত আপনজনই হোক, কেউ সেদিন কারো উপকার করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বরং সেদিন মানুষ তার অতি প্রিয় প্রিয়জনের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না। সুতরাং সে বিচারের প্রেক্ষাপটে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।
দুনিয়ার জীবন হলো ধোঁকা: প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়
এ দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবন হলো ধোকা। মরীচিকার মতো। অনেক আকর্ষণীয় জিনিস মানুষকে আহবান করে এবং শান্তি দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। আসলে তা হলো মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতারণা। সে আশ্বাস পেয়ে মানুষ দুনিয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, হন্যে হয়ে ঘুরে এবং ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে সম্পদের পাহাড় গড়তে চেষ্টা করে। আলোচ্য আয়াতে এমন ধোকার আশ্বাসে প্রতারিত না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান
শুধু দুনিয়ার অবাঞ্ছিত ও আকর্ষণীয় জিনিসই নয়, বরং আরো আছে শয়তানের ধোকা ও প্রতারণা। জিন শয়তান মানুষের রন্ধ্রে রন্দ্রে ঘুরে মন্দ কাজের দিকে প্রতারিত করে। এছাড়া মানুষ শয়তান মানুষকে মন্দ কাজের দিকে উৎসাহিত করে এবং মন্দ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এ ধরনের সকল প্রকার শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান করেছেন, যেনো আমরা শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত না হই।
গায়েবের খবর আল্লাহর নিকট রয়েছে
আল্লাহ মানুষকে অত্যন্ত সীমিত জ্ঞান দিয়েছেন। এ সীমিত জ্ঞান দ্বারা মানুষ খুব কম বিষয়ই জানতে পারে। সেহেতু মানুষের উচিত সকল ব্যাপারে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। এমনিতে সকল গায়েবের খবরই আল্লাহ নিকট রয়েছে, তবে এক সাহাবীর প্রশ্নের বরাতে আয়াতে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম, কিয়ামতের জ্ঞান। কিয়ামত কখন হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। দ্বিতীয়, বৃষ্টিপাতের সময়। এ ব্যাপারে আবহাওয়া অফিস থেকে হয়তো কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে তা নির্ভরযোগ্য হয় না। তৃতীয় বিষয় হলো মাতৃগর্ভে কি আছে, তার জ্ঞান। এ ব্যাপারে সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহর নিকটই আছে। আজকাল আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভে কি আছে, তা জানা যায়। কিন্তু তার মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির গুণগত দিক সম্পর্কে জানা যায় না। সে কি জ্ঞানী হবে নাকি বোকা, তার আচার ব্যবহার কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় কেউ জানে না। এসব বিষয় শুধু আল্লাহরই জানা আছে। আর কারো নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে কারো কিছু করারও নেই। শুধু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে দোয়া করা উচিত।