বর্তমান সরকার নিজেদের গণমাধ্যমবান্ধব সরকার হিসেবে দাবি করে। এ দাবি অযৌক্তিক নয়। বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকবান্ধব। কোভিড পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা প্রটোকলের কারণে ইদানীং কিছুটা ভাটা পড়লেও সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার পাশেই ছিল। বিরোধী দলে থাকার সময় তো বটেই, এমনকি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনার যোগাযোগ বহাল থেকেছে। দেশের বাইরে থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করাকে রেওয়াজে পরিণত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তার সংবাদ সম্মেলন হয় প্রাণবন্ত, সাংবাদিকদের সব প্রশ্নেরই উত্তর দেন তিনি।
প্রয়োজনে পাল্টা প্রশ্ন করেন, সমালোচনার হুল ফোটানো জবাব দেন, খুনসুটি করেন, মজা করেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গেও সাংবাদিকদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হয়েছেন বলে নয়, মন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে তার যোগাযোগের শুরু। মন্ত্রী হওয়ার পরও সে যোগাযোগে ভাটা পড়েনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর একটি ফোনকলের দূরত্ব। সাবেক তথ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগ রাজপথ থেকে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই সাংবাদিকরা কারণে-অকারণে, সুখে-দুঃখে তাকে পাশে পেয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নীতিনির্ধারকরা সহজাতভাবে সাংবাদিকবান্ধব হলেও বর্তমান সরকারের আমলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি হয়েছে। বর্তমান সরকারের একযুগে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ। তাই সাংবাদিকরা লিখতে, বলতে ভয় পায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম থেকে রাজনৈতিক কার্টুনের চলটাই উঠে গেছে, ধারণা করি ভয়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের আগে সাংবাদিকদের মতামত নেয়া হলেও রাখা হয়নি।
আইনটি প্রণয়নের আগে বার বার বলা হয়েছে, এটি সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের জন্য নয় এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এটি প্রয়োগও করা হবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনই এখন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সবচেয়ে সহজ অস্ত্র, ভয় দেখানোরও। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পূর্বসূরি তথ্য-প্রযুক্তি আইনও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে কালো আইন হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকতে থাকতেই আরেকটি সম্ভাব্য আইন নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে তোলপাড়। গত ২৮ মার্চ সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হয়েছে গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০২১। বিলটি যাচাই-বাছাই করে ৬০ দিনের মধ্যে সংসদে রিপোর্ট দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য একটি আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রণীত নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অর্ডিন্যান্স পরে বিএনপি সরকার বাতিল করে দিলে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের ধারণাও বদলে গেছে এবং অনেক বিস্তৃত হয়েছে। পত্রিকার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন এবং রেডিওর ব্যাপক বিস্তার নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তাকে আরও জরুরি করে তোলে। তাই সাংবাদিকদের দাবির প্রেক্ষিতেই নতুন একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুরুতে সবার মতামত নেয়া হলেও সংসদে উত্থাপনের আগে বিলটি সম্পর্কে স্টেকহোল্ডারদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি।
সাংবাদিকদের অন্ধকারে রেখে সংসদে উত্থাপিত বিলটি নিয়ে কিছু শঙ্কা এবং বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন, বেসরকারি বেতার মাধ্যমের সাংবাদিক, আলোকচিত্রীসহ সব কর্মচারীদের অধিকার, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আইনটি করা হচ্ছে, এমন কথা বলা হলেও সাংবাদিকদের এবং মালিকদের প্রায় সব সংগঠন এই আইন নিয়ে সমালোচনামুখর। মূল আপত্তি সংজ্ঞায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নন, এমন কর্মীরাও কাজ করেন। প্রস্তাবিত আইনে সবাইকে ‘গণমাধ্যম কর্মী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সবচেয়ে বড় শঙ্কা এ আইন প্রণীত হলে ইউনিয়ন করার সুযোগ থাকবে কি না!
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক দাবি করেছেন, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে সাংবাদিকরা রুটি-রুজি এবং অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে না৷ তারা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না৷ প্রস্তাবিত আইনে সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তার।
তার দাবি প্রস্তাবিত আইনের ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টিই সাংবাদিকবান্ধব নয়৷ সাধারণত বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিক ইউনিয়নের অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মালিকদের সংগঠন নোয়াব। কিন্তু এখানে দুইপক্ষের অভিন্নমত। নোয়াব এবং সম্পাদক পরিষদও মনে করে প্রস্তাবিত আইনের ৩৭টি ধারাই সাংবাদিকবান্ধব নয়। বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘আইন নাই এটা একটা কষ্ট। কিন্তু আইন করতে গিয়ে যেন খারাপ কিছু না করা হয়।’
এটা ঠিক প্রস্তাবিত আইনটিতে সাংবাদিকদের নিয়োগ, বেতন, ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ছুটি, অবসরসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে এর অনেক কিছু আগেও ছিল। এসব সুযোগ-সুবিধা আসলে কাজীর গরুর মতো, কিতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। বাংলাদেশে বড় জোর ১০টি পত্রিকায় ওয়েজবোর্ড মেনে নিয়মিত বেতন-ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু ডিএফপির তালিকা দেখলে আপনি অবাক হবেন, সেখানে দাবি করা আছে, বাংলাদেশের শতাধিক পত্রিকায় ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করা আছে।
যে পত্রিকা পৃথিবীর কোনো স্টলে পাওয়া যায় না, এমন পত্রিকার সার্কুলেশনও সরকারি হিসাবে লাখের ওপরে। ডিএফপির হিসাব সত্যি হলে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো প্রতিদিন বিক্রি হয়, এক কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার। এটা সত্যি হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু চোখে ঠুলি পরা ডিএফপির কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া বাংলাদেশের আর সবাই জানে এটা মিথ্যা। বাংলাদেশে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৫ লাখ পত্রিকা বিক্রি হয়। মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গণমাধ্যমকে আপনি আইন দিয়ে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দিতে বাধ্য করতে পারবেন না। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের কর্মীরা ৩০ বছরের চাকরি শেষ করেন শূন্যহাতে। তাই আইনে বড় বড় কথা লেখার চেয়ে বাস্তবায়ন, নজরদারি জরুরি।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলেই সরকারের নীতিনির্ধারকরা গণমাধ্যমের বিপুল বিস্তারের কথা উল্লেখ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। কিন্তু কোয়ানটিটি কখনও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। প্রয়োজন কোয়ালিটি। সেখানে যে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা সবাই জানেন।
এটা ঠিক বিপুল এবং বহুমুখী বিস্তৃত গণমাধ্যমে শৃঙ্খলা আনতে একটি আইনের প্রয়োজন। আমরা শৃঙ্খলা চাই, তবে শৃঙ্খলিত হতে চাই না। অতীতে তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে, তাই এখন দই দেখলেও ভয় পাই। প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কর্মী আইনটি চুন না দই, তা সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে। আশার কথা তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হাসানুল হক ইনু আইনটি পাস করার আগে স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেয়া এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো মতামত নেয়া হলো, কিন্তু রাখা হলো না; এমন ঘটনা যেন না ঘটে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক