বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাওরের বোবাকান্না, কৃষকজীবন ও রাজনীতি

  • দীপংকর গৌতম   
  • ২১ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:১৮

প্রতিবার ধানের ফলন দেখে কৃষক যখন স্বপ্ন দেখে তখনই তার হাওররক্ষা বাঁধ ভেঙে ধানের হাওর ডুবে যায়। এমনি বিধান যেন। অনেক আগে থেকে হাওর রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প আসে। প্রকল্পের টাকা কোথায় যায় কেউ জানে না। এ ব্যাপারে সরকারের আইন বিভাগ জেগে ঘুমায়। ফলে বছরের পর বছর একই অনিয়ম তাড়িয়ে বেড়ায় হাওর এলাকাকে। যার কারণে হাওর এলাকার কৃষকের জীবন বিপন্ন হয়। কারণ ধান বুনতে ঋণ আনতে হয়। আর ধান যখন ঢলে ডুবে যায়, তখন অনাহার আর এনজিওর কিস্তি গুণতে গুণতে জীবন ঝিমিয়ে আসে।

বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও কিশোরগঞ্জে প্রচুর হাওর-বাঁওড় রয়েছে। এসব অঞ্চলে গেলে চোখে পড়বে ধু-ধু হাওর। এক এক মৌসুমে হাওর এক এক রূপ ধারণ করে। শীতে এসব হাওর- বাঁওড়ে পাখির মেলা বসে। আবার গ্রীষ্মে মৌসুমি ধান চাষ হয়। এসব হাঁওড়ে এক বছর ধান হলে ৫ বছর খেতে পারে কৃষক। বর্ষাকালে এর রূপ আবার ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সাগরের মতো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে হাওর।

বিশাল আকারের ঢেউ মুহূর্তে ডুবিয়ে দেয় নৌকা বা ছোট-খাট নৌযান। হাওরের এই রুদ্রমূর্তি ও ঢেউকে স্থানীয় ভাষায় ‘ফাল-আফাল’ বলে। এই ফাল-আফালের মধ্যে বসেই জেলেরা মাছ ধরে। এক বতরে (মৌসুম) একজন জেলে যে মাছ পায় তাতে তার অনেক দিন ভালোমতোই কাটে। তার মানে হাওরে ধানের মৌসুমে যেমন ধান ফলে আবার বর্ষা-শীতে মাছের নৌকাও ভারী হয়। হাওর পাড়ের কৃষকদের বোরা ধান চাষ সিলেট-নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের খাবারের জোগান দেয়, যদি ধান সময়মতো ঘরে তুলতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে ৮০ ভাগ মানুষ এক সময় কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন সে অবস্থা না থাকলেও হাওরের বোরো ধানের ওপর মানুষের নির্ভরতা এখনও কমেনি। বিভিন্ন অত্যাচারের মধ্যেও হাওরগুলো টিকে আছে। এ অঞ্চলে কৃষকের তিনবেলা খাবারের জন্য হাওরের বিকল্প নেই। এই হাওর-অধ্যুষিত এলাকা এতটাই কৃষিনির্ভর যে, এ অঞ্চলে একসময় বড় বড় কৃষক-আন্দোলনও সংঘটিত হয়েছে।

হবিগঞ্জে ব্রিটিশের সময়ে ভানুবিল কৃষক আন্দোলন ছিল মনিপুরী সম্প্রদায়ের বিশাল আন্দোলন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের নানকার বিদ্রোহ ও ভাসান পানি-আন্দোলন মাইলফলক দুটি গণসংগ্রাম। নানকার বিদ্রোহ সিলেট অঞ্চলের একটি কৃষক-আন্দোলন, ১৯৪৯ সালে এটি সংঘটিত হয়। জমিদারি আমলের এই প্রথাকে ‘নানকারপ্রথা’ বলা হতো। বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৫০ সালে জমিদারপ্রথা বিলুপ্ত করার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড অজয় ভট্টাচার্য।

আশির দশকে হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠে ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার আন্দোলন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ভাসান পানির অধিকারের দাবিতে সংগঠিত এই গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন কমরেড বরুন রায়। বাংলাদেশের কৃষক-আন্দোলনের ইতিহাসের তিনটি বড় আন্দোলনই হাওর-বাঁওড়-বিলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় যে, বড় একটি জনগোষ্ঠীর মানুষের দাবি-দাওয়া ছাড়া এতবড় বড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি।

বর্তমান কৃষির ব্যাপ্তি কমেছে। কৃষকের সংখ্যা কমেছে। কৃষকনির্ভর রাজনীতিও টিকে আছে কোনোমতে। তাই হাওর অঞ্চলে যে সংকট চলছে তা নিয়ে কথা বলার কোনো লোক নেই। অসহায় কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর রাজনীতির প্রদীপও জ্বলছে টিমটিম করে।

হাওর অঞ্চলের মানুষ হাওরের মাছ ও ধানের ওপর নির্ভরশীল। অজস্র কৃষক স্বপ্ন নিয়ে হাওরে ধান বোনে। ধানের ভালো ফলন হওয়া নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রতিবার দেখা যায় একই চিত্র; ধান কাটার মৌসুম যখন আসে তখন পার্শ্ববর্তী দেশের পাহাড় থেকে ঢল নামে। সেই ঢলে উথলে ওঠে হাওরসংলগ্ন সব নদী। মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যায় কৃষকের স্বপ্ন। হাওরের কৃষকরা শুধু ধান বোনে না, বোনে স্বপ্নও। এই ধান গোলায় উঠলে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেবে, আত্মীয়স্বজন আসবে, গরম ভাতের ধোঁয়ায় মুখরিত হবে হাওর অঞ্চল। কিন্ত প্রতিবছর সবার বাড়া ভাতে ছাই দিতে যেন প্রস্তুত একটি গোষ্ঠী। প্রতিবার ধানের ফলন দেখে কৃষক যখন স্বপ্ন দেখে তখনই তার হাওররক্ষা বাঁধ ভেঙে ধানের হাওর ডুবে যায়। এমনি বিধান যেন।

অনেক আগে থেকে হাওর রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প আসে। প্রকল্পের টাকা কোথায় যায় কেউ জানে না। এ ব্যাপারে সরকারের আইন বিভাগ জেগে ঘুমায়। ফলে বছরের পর বছর একই অনিয়ম তাড়িয়ে বেড়ায় হাওর এলাকাকে। যার কারণে হাওর এলাকার কৃষকের জীবন বিপন্ন হয়। কারণ ধান বুনতে ঋণ আনতে হয়। আর ধান যখন ঢলে ডুবে যায়, তখন অনাহার আর এনজিওর কিস্তি গুণতে গুণতে জীবন ঝিমিয়ে আসে।

এসব খবর রাষ্ট্র জানে। কিন্তু কৃষকের ক্ষতি হলে রাষ্ট্রের কিছুই যায় আসে না। পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এমন, এখন রাজনীতিকরা ব্যবসা করে আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে। ফলে কৃষকের পক্ষে কোনো আন্দোলন নেই। কৃষকের কোনো প্রতিনিধি সংসদে কথা বলে না। আমাদের দেশ এক সময় কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। কৃষকরাই ছিল এখানের মূল শক্তি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই দিন আর নেই।

এখন চাল আমদানি করা হয় অথচ ঠিকমতো চাষাবাদ করলে কৃষকের ঋণের ব্যবস্থা রাখলে খাদ্য রপ্তানি করা যায়। কিন্তু কী কারণে সেসব চিন্তা কোনো পরিকল্পনাতে নেই। বরং কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্র কিছু বলে না। কিন্তু কৃষকের পাঁচ হাজার টাকার জন্য তাকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে থানায় আনা হয়। এই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে চলছে কৃষি ও কৃষক। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো কৃষক-আন্দোলনও গড়ে ওঠে না। কৃষক মেহনতি মানুষের সংগঠনের যে সংকট তা বরাবরই লক্ষ করা যাচ্ছে।

সম্প্রতি হাওর অঞ্চলে এলাকাগুলো উজানের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেল হাজার হাজার হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান। তারপরও কৃষক হাওরে তলিয়ে যাওয়া আধাপাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছে। কোনোমতে যদি শেষ রক্ষা হয়। নতুবা সে কী খেয়ে বাঁচবে? কৃষকের স্বপ্ন এখন জলের নিচে। দাদন এনে জমি চাষ করে এখন নিঃস্ব কৃষক। সারা বছর থাকবে অভাব। এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঋণের বোঝা বইবে কৃষক।

হাওরজুড়ে আতঙ্ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গত সোমবার কিশোরগঞ্জের ফসলের জমি নতুন করে প্লাবিত হয়। মেঘনা, ঘোরাউত্রা, বাউলাই ও কালনি নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হবিগঞ্জের প্রায় সব হাওরের ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। নেত্রকোনায় হাওর অঞ্চলে ফের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।

পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতে তাহিরপুর উপজেলার নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি প্রবেশ করে ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। এরপর একে একে আরও ১০-১১টি বাঁধ ভেঙে কৃষকের চোখের সামনে ডুবে গেছে হাওরের সোনালি ফসল। ফসলডুবির পর যে বাঁধগুলো আশা জাগিয়ে রেখেছে সেগুলোতেও ফাটল ও ধস নামায় হাওরপাড়ের কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

চাষিরা যেনতেন প্রকারে ফসল কেটে ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ধান কাটার মৌসুমি কৃষিশ্রমিক। তাদের রক্ষার কেউ নেই, কিছু নেই। সরকারের সব সংস্থা মাইকিং করে বাঁধ রক্ষা করতে চাইছে। মাইকিংয়ে কি ঢল থামে? সারা বছর ভেরেণ্ডা ভাজলে এখনতো এমনই হওয়ার কথা। হাওররক্ষা বাঁধ দ্রুত নির্মাণের কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকার বলেছে- হাওরের উপর দিয়ে ১২ কিলোমিটির উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। তাতে বন্যা কমবে?

হাওরের উপর দিয়ে ১২ কিলোমিটার কেন, ১২ শ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণ করলেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। বরং কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে এটা হবে পণ্ডশ্রম। ‘হাওররক্ষা বাঁধ’ স্থায়ীভাবে নির্মাণ করতে না পারলে কৃষকের এ সংকট নিরসন সম্ভব নয়। প্রতিবছর একই ঘটনা কীভাবে ঘটে আমরা বুঝি না! কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, বৃহত্তর সিলেটের অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির সংস্থানের জায়গা হাওর। এটা সবার জানা।

শুষ্ক মৌসুমে এ এলাকার বাঁধ শক্তভাবে নির্মাণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কেন এটা হয় না? চোখের সামনে যেসব কৃষকের সর্বনাশ হলো আর সবাই মিলে দেখলাম তাতে একবার কি বোধগম্য হয় না এদের ঈদ বা পরবর্তী সময় কীভাকে কাটবে? এসব ক্ষতিগ্রস্তদের কি প্রণোদনা দেয়া যায় না? সরকার এটা করলে কৃষকের গতি থাকবে নতুবা কৃষকের ভবিষ্যৎ কষ্টে ভরে থাকবে। বাঁচবে হয়তো, কিন্তু সেটাকে বাঁচা বলে না।

কৃষকরাজনীতি জোরালো থাকলে, একজন অজয় ভট্টাচার্য, একজন বরুন রায় বেঁচে থাকলে চিত্রটা হয়তো বদলে যেত। আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি মুখে কলুপ এঁটে বসে আছেন। কে কথা বলবে? মধ্যবিত্ত সমাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে সবাই ঘরে বসে বায়স্কোপ দেখবে- এইতো বাস্তবতা! ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পলিসি ঠিক? নাকি আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন? এ বিতর্ক চায়ের দোকানে যখন চলে তখন শনির হাওরের পাড়ে দাঁড়িয়ে একজন সবুর মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আহাজারি করে বুক চাপড়িয়ে বলে, আল্লারে সারা বছর কী খাওয়াইতা?

লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর